• বৃহস্পতিবার , ২ মে ২০২৪

ইমরানের বোলিংয়ে কাবু পলিটিশিয়ানরা


প্রকাশিত: ২:৪৪ পিএম, ২৬ জুলাই ১৮ , বৃহস্পতিবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ১৬২ বার

 

বিশেষ প্রতিনিধি : এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা ইমরান খানের! কত শিগগির তিনি পাক প্রধানমন্ত্রীর মসনদে বসছেন। তার এই জেতায় পাকিস্তানের তৃতীয় শক্তি’র জয় হয়েছে! পাক এই ‘উর্দি’রা এবার খেলবে ইমরানকে নিয়ে! ইমরানের ফাস্ট বোলিংয়ে ধরাসায়ী হবে ঝানু পলিটিশিয়ানরা। উর্দিরা বাঁশি বাজালেই ইমরান বল মেরে কাবু করবে একের পর এক পলিশিয়ানকে?

দেখা গেছে, তুরস্কের এরদোয়ান একনায়কতা করলেও সেনাতন্ত্রকে বশে রাখতে পারছেন। কিন্তু পাকিস্তান সেনা ফাঁসে বারবার মাথা গলাতে ভালবাসছে। সেনাবাহিনীর মদদে এবং রাজনৈতিক ডিগবাজির যোগ্যতায় ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন। মুসলিম লীগের (এম) প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ ভারতঘেঁষা, ফলে তিনি বাদ। পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর নাতি আর বেনজীর ভুট্টোর পুত্র বিলওয়ালের প্রতিও তাদের ততটা আস্থা নেই। সুতরাং ইমরান খানের তেহরিক-ই-পাকিস্তান (পিটিআই) হলো তাদের পেয়ারের পার্টি।

শেষ খবর এই; ইমরানের পিটিআই পেয়েছে ১১৩ টি আসন। নওয়াজ শরীফের মুসলিম লীগ ৬৫ এবং বেনজীর ভুট্টোর পুত্র বিলাওয়াল ভুট্টোর সম্বল ৪৩ টি আসন। বেশ কিছু আসনের ফল পাওয়া এখনো বাকি। কিন্তু ইমরান খান যে জয়ী হতে যাচ্ছেন, তা নিয়ে আর সন্দেহ নেই। কিন্তু কীভাবে এল এই জয়?

আগের দুটি নির্বাচনে পরাজয়ের পর এবার ইমরানের জন্য মাঠ ফাঁকা থাকার দরকার ছিল। প্রথম ধাপে সরানো হয় ক্ষমতাসীন নওয়াজ শরীফকে। পানামা পেপার্সে নওয়াজের পরিবারের সদস্যদের নাম থাকায় সেই মওকা মিলল। বিচার বিভাগ থেকে যৌথ তদন্ত দল (জেআইটি) গঠন করা হলো। এর সদস্যদের মধ্যে থাকেন ইমরানের প্রকাশ্য সমর্থক থেকে শুরু করে প্রভাবশালী সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এবং এমআইয়ের সদস্যরাও।

তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে নওয়াজ ক্ষমতা হারান। বিচার করে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করতে গেলে অনেক সময় লেগে যেত; তাতে নওয়াজ ঘুরে দাঁড়াবার সুযোগ পেতেন। সুতরাং সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে তড়িঘড়ি করে পথের প্রধান কাঁটা সরল । অন্যদিকে দেশে-বিদেশে মুসলিম লীগ নেতা আসিফ জারদারির ইমেজ ‘মি. টেন পার্সেন্ট’ হওয়ায় তাঁকে নতুন করে বাণ মারতে হলো না। আর সেনাবাহিনীও এই রেসের ঘোড়ার প্রতি ততটা ক্রুদ্ধ ছিল না; কেননা ঘোড়াটা আর দৌড়াতে পারে না।

শুধু নওয়াজ এবং তাঁর মুসলিম লীগ চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকলেন ইমরান তথা সামরিক বাহিনীর জন্য। অতএব নির্বাচনের ঠিক আগে আগে তাঁকে সকন্যা কারাগারে ঢোকানো হলো। গণমাধ্যম হত্যা, অপহরণ ও ভয়ভীতির কারণে সাক্ষি গোপাল। প্রধান দুই দলের নেতাকর্মীরা হত্যা-জেল ও হয়রানিতে নাজেহাল—ইমরানের জন্য আর কী লাগে?

তাছাড়া নির্বাচনটা হচ্ছে সেনা নজরদারির মধ্যে। তাদের দেওয়া হয়েছে ম্যাজেস্ট্রেসির ক্ষমতা এবং ৯০০ কোটি রূপীর বিরাট খরচ—অতীতের যে কোনো নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে দেয়া খরচের চাইতে বেশি। অধিকাংশ কেন্দ্রে সাংবাদিকরা ঢুকতেই পারেনি। ফলে, ইমরান চাইলেও কি আর হারতে পারতেন?

ইমরান জিতলেও কি জিতল পাকিস্তান? কিংবা এটা কি দেশটির প্রতাপশালী সেনাবাহিনীর সফলতা? পাকিস্তানের যাবতীয় দুঃখের দায় সেনাবাহিনীর ওপরই বর্তাবে। আইয়ুব-ইয়াহিয়ার কারণে তারা গণতন্ত্র ও বাংলাদেশকে একযোগে হারিয়েছে। সঙ্গে উপহার পেয়েছে লজ্জাজনক সামরিক পরাজয় এবং নৃশংসতার খেতাব। পাকিস্তানের নির্বাসিত লেখক ও সংগ্রামী তারিক আলি লিখেছিলেন , ‘তারা কেবল নিজেদের যুদ্ধের মুখে দেশ রক্ষাকারী হিসেবেই ভাবে না; তারা মনে করে দেশে একমাত্র তারাই সবচেয়ে সংগঠিত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ প্রতিষ্ঠান।

অতএব, দেশ চালানোয় তারাই সবচেয়ে যোগ্য…কিন্তু যতবারই তাঁরা শাসনে এসেছেন, ততবারই বিপর্যয় সৃষ্টি করেছেন। আইয়ুবের স্বৈরতন্ত্র পাকিস্তান ভাঙার জন্য দায়ী। জেনারেল জিয়ার স্বৈরতন্ত্রে দেশে ইসলামি চরমপন্থা জোরদার হয়।’আশির দশকে তালেবান বানিয়ে আফগানিস্তানে যুদ্ধ রপ্তানির মার্কিন ঠিকাদারির কাজটা তারাই করে। আবার ৯-১১ এর পর তালেবান দমনের নামে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধে সামিল করেন পাকিস্তানকে।

ফল হয়েছে এই, তালেবান এখন তেহরিক-ই তালেবান নামে পাকিস্তানের স্থিতিশীলতার বড় হুমকি হয়ে বসেছে। পাকিস্তানের সাবেক সেনাপ্রধান রাহেল শরিফ সৌদি নেতৃত্বাধীন তথাকথিত ‘মুসলিম’ ন্যাটো বাহিনীর প্রধান হয়ে আছেন। এই সৌদি আরব সরাসরি ইয়েমেনে ধ্বংস-দুর্ভিক্ষ-মহামারির জন্য এবং পেছন থেকে সিরিয়ার বিপর্যয়ের অন্যতম কারিগর।

ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে জঙ্গিবাদ রপ্তানি করতে গিয়ে তারা ভারতের তরফে কাশ্মীরের স্বাধীনতা সংগ্রামকে জঙ্গি বিচ্ছিন্নতাবাদ হিসেবে আন্তর্জাতিক ময়দানে প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্যই করেছে। বেলুচ, পশতুন ও মোহাজিরদের দমনের ফল হলো এই, পাকিস্তান রাষ্ট্রে নতুন নতুন ফাটলের বিকাশ।

রাজনীতিবিদরাও দেশটার কম ক্ষতি করেননি। দুর্নীতির রেকর্ডে নওয়াজ পরিবারের বনাম ভুট্টো পরিবারের ফারাক ঊনিশ-বিশের বেশি না। সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা তাঁরা করেছেন, দুর্নীতি ও মাফিয়াতন্ত্রের মাধ্যমে রাজনীতির অপরাধীকরণ করে। তাঁরা যখন টাকা বানাতে ব্যস্ত, তখন পাকিস্তান অর্থনৈতিক উদরাময় নিয়ে চীনের বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যের অংশ হয়ে গিয়েছে।

আর পাকিস্তানের প্রতিটি ব্যর্থতায় তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত। আর যতই ভারতের হাতে তারা মার খেয়েছে, ততই ভারত বিরোধিতার পালে বাতাস লাগিয়ে ফুলে ফেঁপে উঠেছে জেনারেলদের সম্পদ-শক্তি ও প্রভাব। দিনের শেষে আমেরিকার ‘ডার্লিং’ হলো ভারত, পাকিস্তানের জন্য রইল সমস্যামুখর সীমান্ত।

ইমরানের জয়ে জয় হলো তৃতীয় শক্তির। প্রথমত তিনি দুই দলের বাইরের তৃতীয় শক্তি, দ্বিতীয়ত রাষ্ট্রের ভেতর রাষ্ট্র হয়ে বসা তৃতীয় শক্তি সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি। এবং তাঁর নিজের ইমেজ ও পন্থারও জোর আছে। তিনি পাকিস্তানকে আমেরিকার ওয়ার অন টেররের অক্ষ থেকে সরিয়ে চিনের বেল অ্যান্ড ওয়ে’র মহাসড়কে ওঠাতে চান। তিনি ভারত প্রশ্নে ততটা আপসপন্থি নাও হতে পারেন। তালেবানদের তিনি আপসের ‘সুপথে’ আনার পক্ষপাতি।

রাজনৈতিক কৌশল, সততা ও দেশপ্রেম থাকলে হয়তো পরিবর্তন আনা তাঁর পক্ষে সম্ভব। আর তা করতে হলে, মুরুব্বি সেনাবাহিনীর সঙ্গেই হবে তাঁর আখেরি খেলা। তার জন্য পাকিস্তানের প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলগুলির অন্তত একটিকে সঙ্গে নেয়া তাঁর দরকার হবে। সরকার গঠনে হয়তো তাই তিনি পিপলস পার্টির নেতা বিলাওয়াল ভুট্টোর সাহায্য চাইতে পারেন।

রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু না থাকলেও ক্যাপ্টেন ইমরানের জন্য অপেক্ষা করছে এক আখেরি খেলা। একদিকে সেনাবাহিনী, যুদ্ধ, দুর্নীতি, জঙ্গিপনা এবং স্বৈরাচার; অন্যদিকে গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল ও অর্থনৈতিকভাবে সফল পাকিস্তানের কর্মসূচী।