• রোববার , ২৮ এপ্রিল ২০২৪

এমভি আব্দুল্লাহ নাবিকরা আতংকে


প্রকাশিত: ১১:৫৯ পিএম, ১৪ মার্চ ২৪ , বৃহস্পতিবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ২০ বার

 

কূটনৈতিক রিপোর্টার : এমভি আব্দুল্লাহ নাবিকরা আতংকে দিনাতিপাত করছে। অপহৃত বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর সবশেষ অবস্থান অবশেষে জানা গেছে। ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের অপহরণ করা বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ আজ বৃহস্পতিবার (১৪ মার্চ) সোমালিয়া উপকূলের গারাকাড থেকে প্রায় ৭ নটিক্যাল মাইল দূরে নোঙর ফেলেছে। তবে জলদস্যুদের কেউ এখনও জাহাজের মালিকপক্ষের সাথে যোগাযোগ করেনি। এই প্রেক্ষাপটে, নাবিকদের উদ্ধারের প্রক্রিয়া শুরু করেছে জাহাজটির মালিকপক্ষ।

এ সম্পর্কে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব শাখাওয়াত হোসেন দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেন, নাবিকদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনতে জাহাজটির মালিকরা মুক্তিপণ দিতে চান। এর আগেও তাদের একটি জাহাজ অপহরণ করেছিল সোমালি দস্যুরা। ফলে এই পরিস্থিতি ভালোভাবে সামলানোর মতো যথেষ্ট অভিজ্ঞতা তাদের রয়েছে।

তিনি আরো বলেন, অপহৃত জাহাজটি সোমালিয়ার উপকূলে নেওয়া হলেও, দস্যুরা এখনও মুক্তিপণ চেয়ে যোগাযোগ করেনি। “তারা সাধারণত সরাসরি জাহাজের মালিকদের সাথে যোগাযোগ করে বড় মুক্তিপণ দাবি করে। ধারণা করা হচ্ছে, আর দিন-দুয়েকের মধ্যে তারা যোগাযোগ করবে। প্রথমেই একটি বড় অংকের মুক্তিপণ চায় তারা, পরে আলোচনার পর উভয়পক্ষের সম্মতির ভিত্তিতে একটা দফারফা হয়।

ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ব্যুরোর (আইএমবি) তথ্য আরও জানায়, আজ সকাল ৬টা পর্যন্ত জাহাজটি গারাকাড উপকূল থেকে ৭২ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছিল। তবে রাত ৮টা নাগাদ এই প্রতিবেদন লেখার সময়ে জাহাজটি উপকূল থেকে ৭ নটিক্যাল মাইল দূরে নোঙ্গর করেছে। আইএমবি জানিয়েছে, এমভি আবদুল্লাহ’র সব নাবিক সুস্থ আছেন।

চট্টগ্রামভিত্তিক কবির গ্রুপের (কেএসআরএম) কোম্পানি এসআর শিপিং এর মালিকানাধীন জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। কোম্পানিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুল করিম দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে জানান, বেলা সাড়ে ১২টার দিকে জাহাজটি সোমালিয়ার উপকূলে নোঙ্গর করেছিল, আর নাবিকরা সবাই সুস্থ ও অক্ষত আছেন। তাঁরা (নাবিকরা) আমাদের সাথে আর যোগাযোগ করেনি, তবে বিকল্প উপায়ে তাঁরা পরিবারের কাছে বার্তা পাঠাতে পেরেছেন। পরিবারের সদস্যদের থেকেই আমরা জেনেছি যে, তাঁরা সবাই ভালো আছেন”- যোগ করেন তিনি।মেহেরুল করিম আরো বলেন, জলদস্যুদের কেউ আমাদের সাথে এখনও যোগাযোগ করেনি। কিন্তু, আমরাও বসে নেই। জলদস্যুদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে যত দ্রুত সম্ভব নাবিকদের উদ্ধারের জন্য আমরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে বৈঠক করেছি।

তিনি আরও বলেন, নাবিকদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনতে জাহাজটির মালিকরা মুক্তিপণ দিতে চান। এর আগেও তাদের একটি জাহাজ অপহরণ করেছিল সোমালি দস্যুরা। ফলে এই পরিস্থিতি ভালোভাবে সামলানোর মতো যথেষ্ট অভিজ্ঞতা তাদের রয়েছে। এই ক্ষেত্রে, পিঅ্যান্ডআই (প্রটেকশন অ্যান্ড ইনডেমনিটি) ক্লাবও মধ্যস্ততাকারী হিসেবে সম্পৃক্ত হতে পারে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈঠক-

জাহাজের নাবিকদের উদ্ধার প্রক্রিয়া নিয়ে বৃহস্পতিবার সকালে একটি জরুরী সভা করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আন্তঃমন্ত্রণালয় এ সভায় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম।

রাজধানীর সেগুনবাগিচায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এই সভা হয়, সভাশেষে খুরশেদ আলম সাংবাদিকদের জানান, বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর ২৩ বাংলাদেশি নাবিক সুস্থ আছেন। তাদেরকেসহ জাহাজ ফেরত আনাই প্রথম লক্ষ্য বলে জানান তিনি। এর কৌশল নির্ধারণে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়।

মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব বলেন, ২০১০ সালের নভেম্বরে মালয়েশিয়ান জাহাজ আল-বেদো জলদস্যুদের কবলে পড়ে। ওই জাহাজে সাতজন বাংলাদেশি, দুইজন ইরানি, তিনজন ভারতীয়, দুইজন পাকিস্তানি ও পাঁচজন শ্রীলঙ্কান নাবিক ছিলেন। কিন্তু মালয়েশিয়ার মালিকপক্ষ কোনো দায়িত্ব না নেওয়ায় জাহাজটি আটকে থাকে। আমরা পুরো সময়টাজুড়েই কাজ করেছি এবং প্রায় তিন বছর চার মাস পরে আমরা নেগোসিয়েশন করে কেনিয়ার সেনাবাহিনী দিয়ে বাংলাদেশি নাবিকদের অক্ষত উদ্ধার করে এনেছি– যোগ করেন তিনি।

সময়সাপেক্ষ উদ্ধার তৎপরতা-

নৌপরিবহন খাতের অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেন ও প্রকৌশলীরা জানান, এমন ঘটনার ক্ষেত্রে জাহাজ ও নাবিকদের উদ্ধারের জন্য দরকারি সকল প্রক্রিয়া সফলভাবে সম্পন্ন করতে যথেষ্ট সময় লাগে। এরমধ্যে জাহাজের মালিকপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য পরিস্থিতির সুযোগ নেয় দস্যুরা।

সমুদ্রের যেসব জায়গায় জলদস্যুরা বেশি তৎপর বা সংঘাতপূর্ণ অঞ্চল– সেখান দিয়ে চলাচল করতে হলে আগাম সতর্কতা হিসেবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে বিমা করান জাহাজ মালিকেরা। জলদস্যুতা, অপহরণ ও মুক্তিপণ-জনিত সম্ভাব্য ক্ষতি পূরণের জন্য তারা মোটা অংকের বিমা প্রিমিয়ামও দেন। তবে বাংলাদেশের এই জাহাজটির এ ধরনের বিমা ছিল কিনা তা জানায়নি মালিকপক্ষ।

বাংলাদেশে কয়েকটি আন্তর্জাতিক বিমা কোম্পানির প্রতিনিধি ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন কাদের জাহাজ ও নাবিকদের উদ্ধার প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোকপাত করে বলেন, যখন একটি জাহাজের বিমা করানো থাকে, তখন বিমা কোম্পানির পক্ষ থেকেই একটি টিম অপহরণকারীদের সাথে যোগাযোগ করে। এছাড়া, জলদস্যুদের দাবীকৃত মুক্তিপণের বিষয়ে বিভিন্ন মধ্যস্ততাকারী সংস্থা তাদের হয়ে আলোচনায় যুক্ত থাকে। এরপর মুক্তিপণ দেওয়ার পরে জাহাজ ও নাবিকরা ছাড়া পান।

২০০৫ সালের ৫ ডিসেম্বর প্রথম এমভি জাহানমনি নামের একটি বাংলাদেশি জাহাজকে অপহরণ করা হয়। মুক্তিপণ ও নানান শর্ত নিয়ে টানা ১০০ দিন দরকষাকষি চলে। তবে দীর্ঘসময় লাগলেও কবির গ্রুপ ২৬ জন নাবিকসহ জাহাজটি অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করতে পেরেছিল। তবে এই ধরনের প্রচেষ্টায় কত সময় লাগবে, তাঁর কোনো নির্দিষ্টতা নেই। বরং এটা নির্ভর করে মুক্তিপণ নিয়ে আলোচনা ও দস্যুদের দাবি পূরণের ওপর। সাধারণত মুক্তি আলোচনা বিলম্বিত করে জাহাজের মালিকপক্ষের ওপর চাপ তৈরি করতে দস্যুরা বিভিন্ন ধরনের কৌশলের আশ্রয় নেয়।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, স্বাভাবিকভাবেই এরকম উদ্ধার প্রক্রিয়ায় সময় লাগে। জলদস্যুরা সরাসরি কোনো ব্যাংক একাউন্টে মুক্তিপণের অর্থ নিতে চায় না, এজন্য আলোচনা আরো দীর্ঘায়িত হয়। তখন তাদের কাছে ভিন্ন উপায়ে মুক্তিপণের অর্থ পৌঁছানোর ব্যবস্থা নিতে হয়। তারা নগদ মার্কিন ডলারে মুক্তিপণ নেয়। সাধারণত সাগর বা উপকূলের একটা জায়গা নির্ধারণ করে দেয় দস্যুরা, সেখানে খুব নিচু দিয়ে উড়া বিমান থেকে ওয়াটারপ্রুফ ব্যাগে করে মুক্তিপণের অর্থ ফেলা হয়।

আতংকে সেকেন্ড অফিসার-

এদিকে, মঙ্গলবার (১২ মার্চ) বিকাল ৫টা ৮ মিনিটে পরিবারের সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয় তৌফিক ইসলামের। তিনি ভারত মহাসাগরে সোমালি জলদস্যুদের কবলে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহর সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার। মায়ের সঙ্গে শেষ কথোপকথনের সময় কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন তৌফিক। বলেছিলেন, ‘বিপদে পড়েছি মা, ক্ষমা করে দিও। পরবর্তীতে কী হবে জানি না।’

তৌফিক ইসলামের বাড়ি খুলনা শহরের সোনডাঙ্গা থানাধীন করিম নগরে। আজ বুধবার দুপুরে তার বাড়িতে মা দিল আফরোজার সঙ্গে কথা হয়।তিনি বলেন, ‘গতকাল (মঙ্গলবার) বিকালে ছেলে হোয়াটসঅ্যাপে কল দিয়ে কান্নাকাটি করছিল। আমাদের কাছে দোয়া চাচ্ছিল। বার বার ক্ষমাও চাচ্ছিল। আমি তাকে নানা দোয়া পড়তে অনুরোধ করি। একপর্যায়ে সে আমাকে মা বলে ডাক দিলে, সাড়া দেওয়ার আগেই ঠিক (বুঝতে পারি) পাই, কে যেন তার ফোনটি কেড়ে নিয়েছে। তার পর থেকে আর যোগাযোগ করতে পারিনি।’