• শুক্রবার , ১৫ নভেম্বর ২০২৪

পুলিশে ভানুমতির খেল! আইন হাতে তুলে নিচ্ছে মানুষ


প্রকাশিত: ৪:৩৩ এএম, ২৮ জুলাই ১৫ , মঙ্গলবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ২২৫ বার

igp-www.jatirkhantha.com.bd----------------বিশেষ প্রতিবেদক.ঢাকা:‘আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না।’ জনপ্রিয় এই সংলাপটি দীর্ঘদিন মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে। তবে মুখে মুখে চালু থাকলেও তাৎপর্যপূর্ণ সংলাপটি মানুষের মনে প্রভাব ফেলতে পারেনি। বাস্তবে অসংখ্যবার মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছে, নিচ্ছে। কিন্তু চলচ্চিত্রের মতো শেষ দৃশ্যে বাস্তবে পুলিশ আসে না। উল্টো পুলিশের বিরুদ্ধে গণপিটুনিতে মানুষ হত্যায় মদদ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ রকম হত্যাকাণ্ডের পর মামলা নিতে গড়িমসি করা, টাকার বিনিময়ে চিহ্নিতদের বাদ দিয়ে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করা, মূল আসামিদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করা, খবর পেয়েও ঘটনাস্থলে পৌঁছতে দেরি করাসহ বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নির্লিপ্ততা ও তাদের ওপর আস্থার ঘাটতির কারণে মানুষের মধ্যে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। আইনের শাসনের অভাব ও মূল্যবোধের অবস্থায়ও এর জন্য অনেকখানি দায়ী। মানুষের সম্পর্কগুলো ঠুনকো হয়ে যাচ্ছে।

প্রায় তিন বছর আগে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে কিশোর শামছুদ্দিন মিলনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় পুলিশের সহায়তা ছিল। পুলিশ ভ্যানগাড়ি থেকে মিলনকে নামিয়ে এলাকার লোকজনের হাতে তুলে দেয়। আর জনতা তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। পুলিশের করা প্রাথমিক তদন্তেও ওই ঘটনায় পুলিশের সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলেছে। পরে কোম্পানীগঞ্জ থানার তৎকালীন ওসি রফিক উল্লাহকে প্রত্যাহার করা হয়। আরো তিন পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কিন্তু আজও মামলার বিচার হয়নি।

চুরির অভিযোগ তুলে গত ৮ জুলাই সিলেটের কুমারগাঁওয়ের যে ওয়ার্কশপটিতে রাজনকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়, সেখান থেকে মাত্র ১০ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে জালালাবাদ থানা। অথচ নির্যাতনকারীরা রাজনকে পেটাতে পেটাতে মেরে ফেললেও পুলিশ কিছু জানতেই পারেনি। মামলা করতে গেলে রাজনের বাবার সঙ্গে উল্টো দুর্ব্যবহার করে পুলিশ। মামলার অন্যতম আসামি কামরুল ইসলামকে বিদেশে পালিয়ে যেতেও সাহায্য করে তারা। গাফিলতির দায়ে ইতিমধ্যে জালালাবাদ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আলমগীর হোসেন, এসআই আমিনুল ইসলাম ও জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীর কাজীনগর গ্রামের তিন ভাই হারুন, কামাল ও বাবলুকে গত ঈদের দিন পিটিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষ রফিক বাহিনীর লোকজন। ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে বাবলুদের সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়েছিল রফিকরা। পরে তা রূপ নেয় সংঘর্ষে। সেই সুযোগে তিন ভাইকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে রফিক ও তার সঙ্গীরা।

পুলিশ অনুসন্ধান করে নিশ্চিত হয়েছে, মসজিদ নির্মাণের জন্য ২৬ শতাংশ জমি নিয়ে রফিকদের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই বিরোধ ও মামলা চলছিল বাবলুদের। রফিকরা সেই প্রতিশোধ নেয় তিন ভাইকে হত্যা করে। এ ঘটনায় থানায় হত্যা মামলা হয়েছে। কিন্তু মূল অপরাধীরা পালিয়ে গেছে।
যদিও নোয়াখালীর এসপি মোহাম্মদ ইলিয়াস শরীফ বলেন, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারাই জড়িত তাদের ক্ষমা নেই। এ পর্যন্ত এক নারীসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

মাস দুয়েক আগে বরিশালের হিজলায় ডাকাত সন্দেহে তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তাঁরা হলেন গোবিন্দপুরের হারুন বেপারী, মিরাজ মোল্লা ও বাউশিয়ার হানিফ। পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে, জমিজমাসংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে তিনজনকে ডাকাত সাজিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষ।

দেশে এখন প্রায়ই এ রকম গণপিটুনিতে মানুষ মারা হচ্ছে। চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারী সন্দেহে ধরা পড়লেই চলে গণপিটুনি। জমিজমাসহ বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিরোধের জের ধরেও প্রতিপক্ষকে গণপিটুনিতে ঘায়েল করা হচ্ছে। আইনশৃক্সখলা রক্ষাকারী বাহিনী এসব ঘটনা প্রতিরোধ করতে পারছে না। উল্টো অভিযোগ রয়েছে, টাকার বিনিময়ে পুলিশ উল্টো আসামিদের পালিয়ে যেতে সহায়তা করে। এ ছাড়া গণপিটুনি দিয়ে হত্যাকাণ্ডের বেশির ভাগ মামলারই বিচার হয়নি। অথচ দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারায় বলা আছে, ‘কাউকে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলা হলে তা হত্যা হিসেবে গণ্য হবে, যার শাস্তি হবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা ১০ বছরের সশ্রম বা বিনা শ্রম কারাদণ্ড ও জরিমানা।’

২০১১ সালের ১৭ জুলাই শবেবরাতের রাতে রাজধানীর উপকণ্ঠে আমিনবাজারের বরদেশী গ্রামে ডাকাত সন্দেহে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ছয় ছাত্র সেখানে ঘুরতে গিয়ে হত্যার শিকার হয়। এরপর চার বছর পেরিয়ে গেলেও আজও মামলার বিচার শেষ হয়নি।

স্থানীয়দের অভিযোগ, ঘটনার পর পুলিশ গণহারে গ্রেপ্তার শুরু করে। পরে টাকার বিনিময়ে অনেককে ছেড়ে দিয়েছে। আমিনবাজারের ব্যবসায়ী জুলহাস মিয়া বলেন, ‘পুলিশ আমাকে ধরে নানাভাবে হয়রানি করেছে। সাভার থানা পুলিশ আমাকে ধরেই এক লাখ টাকা নেয়।’

২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের অবরোধের মধ্যে পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করে দর্জি দোকানি বিশ্বজিৎ দাসকে। গত ৮ এপ্রিল মেহেরপুরে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয় তিনজনকে। গত ২৬ জানুয়ারি নরসিংদী সদর উপজেলার পাঁচদোনা ইউনিয়নের ভাটপাড়া ও টাকশাল গ্রামে ডাকাত সন্দেহে সাতজনকে পিটিয়ে হত্যা করে গ্রামবাসী। ফরিদপুরে গত দেড় মাসের ব্যবধানে ডাকাত সন্দেহে ছয়জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পারিবারিক বিরোধের জের ধরে গত ঈদের দিন গোপালগঞ্জে এক যুবককে তাঁর চাচাতো ভাইয়েরা দুই হাত কেটে ও চোখ উপড়ে হত্যা করে।

ঈদের আগের দিন সাভারের জিঞ্জিরা এলাকায় গৃহবধূ সুখী আক্তারের এক চোখ তুলে ফেলে তাঁর ¯^ামী ও শ্বশুর বাড়ির লোকজন। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে কবুতর চুরির অভিযোগে সিমন (১০) ও ইমন (১২) নামের দুই শিশুকে আটকে রাতভর নির্যাতন করা হয়। এ ঘটনায় জড়িতদের এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। গত ২০ জুলাই সাভারের পৌরসভার বক্তারপুর এলাকায় ১০ বছরের শিশু সাগর হোসেনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। সাগরের মা তারা বানু সাংবাদিকদের জানান, মাদক সেবনের মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে সাগরকে পিটিয়ে আহত করা হয়। হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা সাগরকে মৃত ঘোষণা করেন।

পুলিশ ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের তথ্যানুযায়ী, গত ছয় বছরে গণপিটুনিতে দেশে ৯৫১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ২০০৯ সালে ১৫৩ জন, ২০১০ সালে ১৬৯ জন, ২০১১ সালে ১৬১ জন, ২০১২ সালে ১৬৬ জন, ২০১৩ সালে ১৬৫ জন ও ২০১৪ সালে ১৩৭ জনকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়। আর চলতি বছরের গত ছয় মাসে গণপিটুনিতে মারা গেছে ৭১ জন। গণপিটুনির বেশির ভাগ পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে নিহত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ মেলেনি।

পুলিশ বলছে, গণপিটুনির এসব ঘটনার তদন্ত হলেও বেশির ভাগ  মামলায় স্বাক্ষী পাওয়া যায় না। এ কারণে অপরাধীদেরও কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায় না। গণপিটুনির ঘটনায় সাধারণত দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারায় মামলা নেওয়া হচ্ছে। তবে পূর্বশত্রুতার জের ধরে পিটিয়ে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা হয় ৩০২/৩৪ ধারায়।

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, পুলিশ ও বিচার বিভাগের ওপর আস্থা না থাকায় মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। এক শ্রেণির মানুষ সুযোগ বুঝে গণপিটুনির নামে ঘায়েল করছে। দেশে গড়ে ১০টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মাত্র একটির বিচার হচ্ছে। বাকি ৯টি মামলায়ই আসামিদের কোনো বিচার হচ্ছে না। গণমাধ্যমে খবর এলেই পুলিশ চাপে পড়ে ব্যবস্থা নেয়। রাজনের মতো অনেকেই গণপিটুনির শিকার হচ্ছে। পুলিশ জেনেও না জানার ভান করে আছে। প্রায়ই এসব নিয়ে লুকোচুরি করে পুলিশ। অনেক সময় গণপিটুনির শিকার হয়ে নির্দোষ মানুষও মারা যাচ্ছে। থানায় মামলা হলেও বেশির ভাগ ধরা পড়ছে না কেউ। আইন ও নীতির তোয়াক্কা না করার সংস্কৃতি বিরাজ করছে সবখানে। গণপিটুনি প্রতিরোধে পুলিশকে আরো কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। না হলে এসব ঘটনা বাড়তেই থাকবে।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক বলেন, পুলিশের ওপর আস্থা ও সচেতনতার অভাবে দেশে গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে। মানুষ দিন দিন আগ্রাসী হয়ে উঠছে। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বল ভূমিকাই বেশি দায়ী। গণপিটুনির ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় এক শ্রেণির সুবিধাবাদী লোক তাদের স্বার্থ হাসিল করছে। বিরোধকে কাজে লাগিয়ে  মেরে ফেলছে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, বিনা বিচারে কাউকে হত্যা করা অপরাধ। আইন কেউ নিজের হাতে তুলে নিতে পারে না। অথচ নিরপরাধ মানুষ গণপিটুনির শিকার হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে। যথাযথ তদন্ত হয় না বলেই এসব ঘটনা বাড়ছে। পুলিশ বা র‌্যাব যদি আরো আন্তরিক হতো তাহলে কেউ আইন নিজের তুলে নিত না।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, একটি মহল আইনশৃক্সখলার অবনতি ঘটাতে গণপিটুনির ঘটনা ঘটাচ্ছে। মহলটিকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি। সম্প্রতি যেসব স্থানে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে সেগুলো তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক বলেন, ‘গণপিটুনির ঘটনায় পুলিশের কোনো গাফিলতি থাকলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নোয়াখালীতে তিন ভাইকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা এবং গোপালগঞ্জে পারিবারিক বিরোধের জের ধরে এক যুবককে পিটিয়ে ও চোখ তুলে হত্যাকারীদের বিচারের মুখোমুখি করা হবেই। পুলিশের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে।’ মানুষকে আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ারও অনুরোধ করেন তিনি।