• বুধবার , ১৩ নভেম্বর ২০২৪

`ঢাকা সফর ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির জন্য একটি ‘টেস্ট কেস’


প্রকাশিত: ২:২৬ পিএম, ৭ জুন ১৫ , রোববার

নিউজটি পড়া হয়েছে ১৫০ বার

modi-bangobandu-www.jatirkhantha.com.bdআবদুল গাফফার চৌধুরী : ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকায় এসেছেন। এটা তাঁর প্রথম বাংলাদেশ সফর। তবে ভারতের প্রধানমন্ত্রীদের জন্য এটা প্রথম সফর নয়। মোদির আগে ইন্দিরা গান্ধী থেকে মনমোহন সিং পর্যন্ত অনেকেই এসেছেন। এর মধ্যে সবচাইতে স্মরণীয় ইন্দিরা গান্ধীর ঢাকা সফর। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল ইন্দিরা মঞ্চ তৈরি করে তাঁকে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের বিশাল অবদান এবং ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ ভূমিকার জন্য তাঁকে এই সম্বর্ধনা জানানো হয়েছিল।

এই সফরে ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের স্বাধীনতা, স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার ব্যাপারে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি করেন। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি দুই দেশের মৈত্রী ও সহযোগিতায় আরও দৃঢ় ভিত্তি দান করে।

এরপর ভারতের আরও অনেক প্রধানমন্ত্রী ঢাকা সফরে এসেছেন। তাঁরাও দুই দেশের সম্পর্ক আরও দৃঢ় করার চেষ্টা করেছেন। নানা কারণে দুই দেশের মধ্যে উদ্ভূত নানা সমস্যার সমাধান তাঁরা করতে পারেননি। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা ছিল, স্থলসীমান্ত চিহ্নিতকরণ, ছিটমহল ও সমুদ্রসীমানা সমস্যা; অসম বাণিজ্য; সীমান্ত সংঘর্ষ; চোরাচালান ও অবৈধ যাতায়াত ইত্যাদি। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে বাংলাদেশে যে সামরিক শাসন ও বিএনপির শাসন চলে, তাদের ভারতবিরোধী নীতি এবং ভারতের কোনো কোনো বাংলাদেশবিরোধী মহলের তৎপরতায় দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে সমস্যাগুলোর সুমীমাংসা হয়নি। সমস্যাগুলো বহুদিন ঝুলে থাকায় দুই দেশের মানুষেরই বিড়ম্বনা বাড়ছিল।

হাসিনা সরকার প্রথম দফা ক্ষমতায় এসেই বাংলাদেশের জীবনমরণ সমস্যা, গঙ্গার পানিবণ্টনের বিরোধ মীমাংসার জন্য একটি চুক্তি সম্পাদনে সক্ষম হন এবং দুদেশের সম্পর্ক উন্নয়নে দৃঢ় পদক্ষেপ নেন। ভারতের প্রথম বিজেপি সরকারের আমলে নানা টানাপড়েনের মধ্যেও সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা অব্যাহত রাখেন শেখ হাসিনা। ভারতের গত সোনিয়া-মনমোহন সরকারের আমলে ভারত দুদেশের সম্পর্কের উন্নয়নে যথার্থ আগ্রহী হয়ে ওঠে। তারা তিস্তাসহ বিভিন্ন নদীর পানিবণ্টন এবং টিপাইমুখ বাঁধসংক্রান্ত বিরোধ মিটাতেও উদ্যোগ নেন। পার্লামেন্টে কংগ্রেসের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় এবং পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতায় উদ্যোগটি সফল হয়নি।

দিল্লিতে কংগ্রেস শাসনের অবসান এবং মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর আশংকা করা হয়েছিল দুদেশের সম্পর্ক হয়তো উন্নতির পথে এগুবে না। বিজেপি সরকার বাংলাদেশে সেকুলার আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি অনুকূল মনোভাব দেখাবেন না এবং সহযোগিতার হাত বাড়াতে চাইবেন না। আশংকাটি সঠিক প্রমাণিত হয়নি। নরেন্দ্র মোদি দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসে প্রমাণ করতে চাইছেন যে, তিনি গুজরাটের সাবেক মূখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আর নন। তিনি দেশপরিচালনায় ভারতের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য অনুসরণ করছেন এবং প্রতিবেশি দেশগুলোর দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশের হাসিনা সরকারের সঙ্গে তিনি চমৎকার সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন এবং ইতোমধ্যেই স্থলসীমান্ত চুক্তিসহ একাধিক সমস্যার সমাধান ঘটিয়েছেন। বাংলাদেশে তাই ভারত-বিরোধিতার জোয়ার কমেছে এবং বাংলাদেশের মানুষ তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানাতে আগ্রহ দেখাচ্ছে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইন্দিরা গান্ধী দুদেশের সম্পর্কের যে ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন নরেন্দ্র মোদি তাকে আরও শক্তপোক্ত করার ব্যাপারে এগুতে সক্ষম হয়েছেন বলে মনে হয়। এই ব্যাপারে তাঁর সদিচ্ছা রয়েছে এবং এই সদিচ্ছা পূরণের ব্যাপারে পার্লামেন্টেও তাঁর একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। এ জন্যই বলা চলে, ইন্দিরা গান্ধী দুদেশের মধ্যে দৃঢ় সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে যে শুভ উদ্বোধন ঘটিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদির হাতেই হয়তো তার নবরূপায়ণ ঘটবে।

তেতাল্লিশ বছর আগে ইন্দিরা গান্ধী ঢাকা সফরে এসেছিলেন এবং এবার এলেন নরেন্দ্র মোদি। এই চার দশকে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক নানা টানাপড়েনের ভেতর দিয়ে গেছে। কখনও কখনও মনে হয়েছে ভারত বড় প্রতিবেশির ঔদ্ধত্য নিয়ে সকল সমস্যা মীমাংসার ব্যাপারে বাংলাদেশকে নতজানু করতে চায়। আবার কখনও কখনও অভিযোগ উঠেছে পাকিস্তানের ভারতবিরোধী নীতির লেজুড়বৃত্তি করে বাংলাদেশ অহেতুক নিজেকে ভারতের শত্রু করে তুলছে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতেও এতকাল কোনো ভারসাম্য ছিল না। ভারত-চীন বিরোধে একটি ক্ষুদ্র প্রতিবেশি হিসেবে বাংলাদেশের যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলা উচিত ছিল তা সামরিক সরকার ও বিএনপি সরকারের আমলেও করা হয়নি। কখনও মার্কিন ধমকের কাছে নতজানু হওয়া এবং কখনও অতিরিক্ত চীনপ্রীতি দেখিয়ে ভারতকে বিরূপ করে তোলা ঢাকার সামরিক সরকার ও বিএনপি আমলের বিদেশনীতির বিশেষ প্রবণতা ছিল।

শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে এই প্রবণতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেন এবং অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছেন। তিনি সকল ব্যাপারে আমেরিকা এমনকি বিশ্ব ব্যাংকের ধমকের কাছেও নতজানু হননি এবং ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্করক্ষায় একটা ইতিবাচক ভারসাম্য রাখতে সক্ষম হয়েছেন। ফলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সাহায্যদানে চীন যেমন এগিয়ে এসেছে, তেমনি ভারতও এগিয়ে আসতে দ্বিধা করছে না।

শেখ হাসিনা তাই দাবি করতে পারেন বাংলাদেশ এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি নয়। অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সাফল্য দেখিয়েছে এবং গণতান্ত্রিক বিধিবিধান কিছুটা এড়িয়ে হলেও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনে অগ্রগতি ঘটাচ্ছে। বাংলাদেশ-ভারত স্থায়ী মৈত্রী এই স্থিতিশীলতা স্থায়ী করবে বলে অনেকে আশা করেন।

মোদি দুদেশের শান্তিকামী মানুষের মনে অনেক প্রত্যাশা সৃষ্টি করে ঢাকায় এসেছেন। অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের ধারণা, তিনি বাংলাদেশের মানুষের মনে যে প্রত্যাশা সৃষ্টি করেছেন তার অনেকটাই পূরণ করতে পারবেন। এবারের সফরে তিস্তা ও টিপাইমুখ বাঁধ সমস্যার যয়তো পুরো সুরাহা না হতে পারে, তবে তার মীমাংসার পথ আরও সহজ হবে। তা যদি হয়, বাংলাদেশ-ভারত সহযোগিতা বৃদ্ধি পায়, তা দুই দেশেই জঙ্গিবাদ দমনে এবং দুই দেশকে উন্নয়নমুখী করে তুলতে সাহায্য যোগাবে।

২৯ মে শেখ হাসিনা ঢাকায় জাতীয় নাগরিক কমিটির দেওয়া সংবর্ধনা সভায় বলেছেন, “এটা এখন প্রমাণিত যে, ১৯৭১ সাল থেকে প্রতিবেশি ভারত আমাদের বন্ধু। তারা আমাদের মুক্তিসংগ্রামে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে এবং আমাদের শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে বিরাট সাহায্য যুগিয়েছে।’’

প্রধানমন্ত্রীর এ কথা সঠিক, কিন্তু সেই সঙ্গে এ কথাও সত্য যে, ভারতের শাসক মহলের কোনো কোনো অংশ এবং আমলাতন্ত্র ছোট প্রতিবেশির সঙ্গে কখনও কখনও সমমর্যাদার মনোভাব দেখায়নি এবং সঠিক আচরণও করেনি। বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক এবং প্রতিক্রিয়াশীল মহলও তার সুযোগ নিয়ে ভারত-বিরোধিতার আবরণে দেশটিতে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের শক্তি যুগিয়েছে। এই দুটি সমস্যা এখন দুটি দেশেই ক্রমশ মাথা তুলেছে। বাংলাদেশে যেমন জামায়াত, হিজবুত তাহরির ও এই ধরনের মৌলবাদী জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর উৎপাত বাড়ছে, তেমনি ভারতেও হিন্দুত্ববাদী আরএসএস, শিবসেনার মতো উগ্র জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রতাপ বাড়ছে।

অনেকের ধারণা, নরেন্দ্র মোদি বিদেশনীতিতে সাফল্য অর্জন করলেও দেশের অভ্যন্তরীন সংকট কাটিয়ে উঠতে এই হিন্দুত্ববাদীদের প্রভাবের ফলে তেমন সফল হতে পারছেন না।

তিনি যদি বিজেপির সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ির মতো সাহসের সঙ্গে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেন এবং প্রতিবেশি দেশগুলার সঙ্গে সমঅধিকার ও সমমর্যাদার ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেন তাহলে এশিয়ায় শান্তি ও সমৃদ্ধির এক নব যুগের হাওয়া তিনি বহাতে পারবেন। আর এই ব্যাপারে ব্যর্থতা হবে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের জন্য একটি বড় ব্যর্থতা।

ঢাকা সফর ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির জন্য একটি ‘টেস্ট কেস’। তিনি আমেরিকা, চীন, জাপানসহ বহু বড় বড় দেশ ঘুরেছেন, কিন্ত আমার মতে তাঁর বাংলাদেশ সফরের উপরেই তাঁর নেতৃত্বের সাফল্য পরীক্ষিত হবে। ইন্দিরা গান্ধীর যে অসফল স্বপ্ন- ‘ভারত মহাসাগরীয় এলাকাকে শান্তির এলাকা করে তোলা’- সেই স্বপ্ন তিনি যদি সফল করতে পারেন তাহলে ভারতের ইতিহাসে তিনি নবরূপকার হিসেবে স্থান পাবেন।

তাঁর এবারের বাংলাদেশ সফরেই বোঝা যাবে তিনি ইতিহাসে কোন স্থানটি গ্রহণ করতে যাচ্ছেন।