• শনিবার , ১৮ মে ২০২৪

মাদকের সাম্রাজ্যে ৬৮ কারাগারে


প্রকাশিত: ৮:৫৯ পিএম, ৩০ এপ্রিল ২৪ , মঙ্গলবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ২৫ বার

রাজত্ব করছে কয়েদী হাজতী কারারক্ষী-

লাবণ্য চৌধুরী : দেশের কারাগারাগুলো এখন মাদকের সাম্রাজ্যে পরিণত হয়েছে। অবস্থা এমন হয়েছে যে, মাদকের হাট বাজারে পরিণত হয়েছে কারাগারগুলো। জেলের কয়েদী, কারারক্ষী ও হাজতীদের সহায়তায় সার্বিক নিয়ন্ত্রণে চলছে মাদক বাণিজ্য।সব ধরনের জেলের ভিতরের দায়িত্বশীলদের খুশী রেখেই চলছে এ অবৈধ মাদক বাণিজ্যে।বিনিময় চলছে লাখ লাখ টাকা।

কারা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, দেশের ৬৮টি কারাগারে ৪২ হাজার ৮৬৬ জন ধারণক্ষমতার বিপরীতে ৮২ হাজারের বেশি বন্দি রয়েছেন। এর মধ্যে তিন ভাগের এক ভাগ হলো মাদক মামলার আসামি। যাদের বেশির ভাগই মাদকাসক্ত। গত দুই দিন আগে শরীয়তপুর জেলা কারাগার থেকে আদালতের নির্দেশে জামিনে মুক্তি পান একজন। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, কারাগারে ৪০০ আসামির মধ্যে ৩০০ জনই মাদক মামলার।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারের প্রধান ফটকে তল্লাশি করা হয় ওই কারাগারেরই প্রধান কারারক্ষী সাইফুল ইসলামকে। একাধিক সংস্থার সদস্যের উপস্থিতিতে তল্লাশির সময় সাইফুলের কাছে ৩০০ পিস ইয়াবা পাওয়া যায়। পরবর্তীতে তাকে পুলিশে সোপর্দ করে কারা প্রশাসন।

এর ঠিক এক সপ্তাহ আগে একই কারাগারে সোহেল রানা নামের আরেক কারারক্ষীর হেফাজত থেকে চারটি গাঁজার প্যাকেট জব্দ করে কারা প্রশাসন। পরবর্তীতে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তারই হেফাজত থেকে ১ কেজি গাঁজা উদ্ধার করা হয়। তাকেও কারা কর্তৃপক্ষ পুলিশে সোপর্দ করে। এর আগে সেপ্টেম্বর মাসে কাশিমপুর কারাগার-২-এর এক রক্ষীকে ২০০টি ইয়াবা ট্যাবলেটসহ গ্রেফতার করা হয়।

চলতি বছরের শুরুতে গ্রেফতার হয়ে কাশিমপুর-১ কারাগারে ঠাঁই হয়েছিল অমিয় হাজরা (ছদ্মনাম) নামের এক হাজতির। টানা এক মাস ১০ দিন কারাভোগের পর গত ফেব্রুয়ারি মাসে জামিনে বের হয়ে আসেন তিনি। তিনি জানান, কী লাগবে আপনার? সবকিছুই পাওয়া যায় কারাগারে। বিশেষ করে মাদক ব্যবসা তো ওপেন সিক্রেট।

কাশিমপুরের বেশির ভাগ কারারক্ষী মাদক ব্যবসায় জড়িত। দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে এমন বন্দিদের কাছ থেকে তিনি জানতে পেরেছেন, কালেভদ্রে অভিযান হয়। তাও আবার লোকদেখানো। এদিকে রাজধানীর গুলশান, বাড্ডা এবং ভাটারা এলাকার শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী রাসেল ওরফে ভাস্তে রাসেল কারাগারে থেকেও সক্রিয় ছিলেন মাদক ব্যবসায়।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে গ্রেফতার হওয়া ভাস্তে রাসেলের কাছে নিয়মিত মাদক সরবরাহ করতেন তারই সহযোগীরা। ব্যবহার করা হতো কারারক্ষীদের। কারারক্ষীও মাদক বাণিজ্যের জন্য ব্যবহার করেন বিশ্বস্ত কয়েদিদের। একাধিক সংস্থার কর্মকর্তারা প্রযুক্তির মাধ্যমে তার যোগাযোগের বিষয়টি নজরদারি করে অবাক করা তথ্য পান। রীতিমতো চোখ কপালে উঠেছিল গোয়েন্দাদের।তিনি বলেন, ভাস্তে রাসেলের মাধ্যমে কারা অভ্যন্তরের অনেক তথ্য পেয়েছি। বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদক দেশের বর্তমান প্রজন্মের জন্য একটি বড় হুমকি। সব অপরাধেরই হাতেখড়ি মাদক। সংশোধনের জন্য কারাগারে যাওয়ার পরও মাদকের সংস্পর্শে অব্যাহত থাকার কারণে বিষয়টি আরও ভয়ংকর হয়ে উঠছে। অনেকে কারাগারে যাওয়ার আগে মাদকসেবী না থাকলেও জামিনে বের হওয়ার পর মাদকাসক্ত হয়ে বের হচ্ছেন এমন তথ্যও পাওয়া যাচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেন, কারাগারের ব্যবস্থা নিয়ে আরও গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে। সংশোধনের জন্য যাওয়ার পরও অনেকে অপরাধের হাতেখড়ি নিয়ে বের হওয়াটা খুবই আতঙ্কের।

তবে কারা সদর দফতরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক কর্নেল শেখ সুজাউর রহমান দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেন, আমরা মাঝে-মধ্যেই সারপ্রাইজ ভিজিট করে থাকি বিভিন্ন কারাগারে। মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের জিরো টলারেন্স নীতি অব্যাহত রয়েছে। মাদকের সঙ্গে যদি কেউ জড়িত থাকেন এবং এর প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
তিনি বলেন, কারা সদর দফতর থেকে ৪২টি কারাগারকে সিসিটিভির মাধ্যমে নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে। বাকি কারাগারগুলোও শিগগিরই সদর দফতরের মনিটরিংয়ের আওতায় আসবে।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গত ৮ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে চরখাম্বা মোড় এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে যশোর জেলার কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রহরী আশরাফুল মুরাদ রুবেলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তার জ্যাকেটের পকেটে ১০০টি ইয়াবা ট্যাবলেট পায় পুলিশ। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে যশোরের নাজির শঙ্করপুর এলাকা থেকে তোরাব আলী নামের আরেক মাদক ব্যবসায়ীকে ১৫০ পিস ইয়াবাসহ গ্রেফতার করে।

পুলিশ বলছে, মুরাদ নিয়মিত কারাগারের মাদকসেবী বন্দিদের কাছে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক সরবরাহ করতেন। তোরাব নিজেও একসময় কারারক্ষী ছিলেন।কারা সূত্র বলছে, শুধু গত বছরেই মাদক পাচারের জন্য কমপক্ষে ২৫ জন কারারক্ষীর বিরুদ্ধে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবুও কারাগারের অভ্যন্তরে মাদক ব্যবসা নিরবচ্ছিন্ন ছিল।

কাশিমপুর-২ কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে সম্প্রতি জামিনে বের হওয়া এক বন্দি এ প্রতিবেদককে বলেছেন, কারারক্ষীদের সঙ্গে কয়েদি, ফয়েজ, নূর হোসেন, হাজতি মনির, রোকন এবং ফয়সাল মাদক বাণিজ্য করছেন দীর্ঘদিন ধরে। তারা নিয়মিত তাদের বাড়িতে টাকা পাঠান। এ ছাড়া ওই কারাগারে ১ নম্বর বিল্ডিংয়ের কয়েদিদের মাধ্যমে বিভিন্ন ওয়ার্ডে বাণিজ্য হয়ে থাকে। ৬ নম্বর বিল্ডিংয়ের একাধিক ওয়ার্ডে মাদকের ওপেন স্পট চলছে প্রশাসনের সহায়তায়।

কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে দীর্ঘদিন ছিলেন এক বন্দি। নাম ফয়েজ আহমেদ (ছদ্মনাম)। সম্প্রতি এ প্রতিবেদককে তিনি বলছিলেন, ওই কারাগারের কয়েদি রাজধানীর শাহজাহানপুরের রিপন, সাহেদ, মোহাম্মদপুরের রিপন, কয়েদি রতন এবং কয়েদি পিচ্চি লিটন কারা প্রশাসনের সহায়তায় দীর্ঘদিন ধরে মাদক ব্যবসা করে আসছেন। এ ছাড়া গাজী বিল্ডিংয়ের একাধিক রুমে মাদকের ওপেন স্পট পরিচালনা হচ্ছে। তিনি একজন বন্দির উদাহরণ দেন, যিনি মার্চের শুরুতে মাদক সেবন করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েন এবং পদ্মা ভবনের লেভেল-৪ এর ৪ নম্বর ওয়ার্ড থেকে কারাগারের রক্ষীদের ৫ হাজার টাকা দিয়ে ছেড়ে দিতে হয়।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন প্রতিবেদককে বলেন, তাদের কাছে তথ্য রয়েছে যে, কারাবন্দিদের একটি অংশ মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এবং কারাগারের অভ্যন্তরেও মাদক সেবন চলে। যদিও কারাগারের অভ্যন্তরে অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে তাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে, জেল কর্তৃপক্ষ নিয়মিতভাবে তা করে এবং ব্যবস্থাও নেয়।
জানা গেছে, গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত-৩ কাশিমপুর কারাগার-২-এর রক্ষী আজিজার রহমানকে বন্দিদের মাদক সরবরাহের দায়ে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন। ২০১৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর কয়েকজন রক্ষী শহিদুল ইসলাম নামে এক বন্দিকে তার কাছে ১০০টি ইয়াবা ট্যাবলেটসহ পাওয়ার পর এ ঘটনা ঘটে। জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, আজিজারের কাছ থেকে শহিদুল মাদক নিয়ে এসেছিলেন। আরও অনুসন্ধানে আজিজারের বাড়িতে ৬০০টি ইয়াবা ট্যাবলেট এবং ১০০ গ্রাম গাঁজা পাওয়া গেছে।