• রোববার , ২৮ এপ্রিল ২০২৪

দেশে ১ লাখ কোটিপতি- সংকটেও বাড়ছে টাকাওয়ালা


প্রকাশিত: ১:৩৪ এএম, ১২ আগস্ট ২৩ , শনিবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ২৬ বার

Computer generated 3D photo rendering.

অর্থনৈতিক রিপোর্টার : সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণির মানুষ বর্তমান সংকটের সময়ও তাদের আয় বাড়ছে। অনেকের এই সময়ে অতিরিক্ত আয় যোগ হয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশে অতিরিক্ত আয়কারী কোটিপতি অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ১ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। যদিও ধনী-গরিব সবার আয়েই ধাক্কা দিয়েছে দীর্ঘমেয়াদি করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক অবস্থা। কিন্তু তাতেও কমেনি ক্রোড়পতির সংখ্যা। বরং বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান তাই বলছে।

বলা হচ্ছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে যখন দেশের দরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের হিমশিম দশা, তখন সেই জীবনযাত্রার বাড়তি ব্যয় মেটানোর পরও সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণির মানুষের এই সময়ে অতিরিক্ত আয় যোগ হয়েছে। এই আয়ের একটি অংশ ব্যাংকে আমানত হিসেবে গচ্ছিত আছে। দিনদিন তাদের এই আমানতের পরিমাণও বাড়ছে। যার মাধ্যমে দেশে কোটিপতি আমানতকারীদের সংখ্যা আরও সমৃদ্ধ হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সম্পর্কিত হালনাগাদ প্রতিবেদন তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সবশেষ গত তিন মাসে ব্যাংকে কোটি টাকার ওপরে হিসাবধারী আমানতকারীর সংখ্যা বেড়েছে ২৪৬টি। আর এক বছরের ব্যবধানে এই সংখ্যা বেড়েছে ৬ হাজার ৫৯৫টি। বর্তমানে দেশে কোটিপতি আমানতকারীর হিসাব সংখ্যা ১ লাখ ১০ হাজার ১৯২টি, তাদের মোট আমানতের পরিমাণ ৬ লাখ ৯০ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা; যা ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতের প্রায় ৪২ দশমিক ৮৩ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন পর্যালোচনায় আরও দেখা যায়, চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে মোট আমানতকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪ কোটি ১১ লাখ ৩৭ হাজার ২৫৬টি। এসব হিসাবে মোট আমানত রয়েছে ১৬ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে কোটিপতি অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ১ লাখ ১০ হাজার ১৯২টি, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ৫৯৭টি।

আর ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এক কোটি টাকার বেশি আমানত রয়েছে—এমন ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৯ হাজার ৯৪৬টি। সেই হিসাবে, গত তিন মাসে কোটি টাকার ওপরে হিসাবধারীর সংখ্যা বেড়েছে ২৪৬টি। আর ডিসেম্বর শেষে এসব হিসাবে জমা ছিল ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বর্তমানে মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষ যখন দিশেহারা, তখন এক শ্রেণির মানুষের অর্থবৃদ্ধি দেশে আয় বৈষম্য বাড়ার বহিঃপ্রকাশ। তাদের মতে, করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আশঙ্কাজনক হারে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। কিন্তু সে অনুযায়ী মানুষের আয় বাড়েনি। এতে করে নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। এমন অবস্থায় অর্থ জমানো দূরের কথা, অনেকে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। এই সময় দেশের একটি শ্রেণির মানুষের আয় বেড়েছে।

তারা হচ্ছেন পুঁজিপতি, বিত্তবান ও বড় বড় প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী। তাদের আয় আগেও বেশি ছিল, এখন আরও বেড়েছে। মূলত আয়বৈষম্যের কারণেই দেশের কোটি টাকার আমানতকারীর সংখ্যা বাড়ছে। এ ছাড়া দুর্নীতির মাধ্যমে কালো টাকা অর্জন, হন্ডির মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা পাচারে কিছুটা প্রতিবন্ধকতা, প্রণোদনা প্যাকেজের টাকা ভিন্ন খাতে স্থানান্তর, করনীতিতে অসামঞ্জস্য, ধনীদের কাছ থেকে কম হারে কর আদায়ও দেশের আয় বৈষম্যের অন্যতম কারণ। এসব কারণে এক শ্রেণির মানুষের বৈধ ও অবৈধ উপায়ে আয় বাড়ছে। তবে আয় কমেছে—এমন মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এ অবস্থায় বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর ওপর সরকারকে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।

এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি এম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, কোটিপতি আমানতধারীর সংখ্যা বৃদ্ধি হলো সমাজের আয় বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করার একটা অন্যতম দৃষ্টান্ত। দেশে বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান কমে যাওয়ার কারণেই এই আয় বৈষম্য বাড়ছে। তাই বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান বাড়ানো না গেলে সামনে এটি আরও বাড়তেই থাকবে।

তবে একই বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, কোটি টাকার হিসাব মানেই কোটিপতি ব্যক্তির হিসাব নয়। কারণ, ব্যাংকে এক কোটি টাকার বেশি অর্থ রাখার তালিকায় ব্যক্তি ছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। আবার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কতটি ব্যাংক হিসাব খুলতে পারবে, তার নির্দিষ্ট সীমা নেই। ফলে এক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির একাধিক হিসাবও রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কোটি টাকার হিসাবও রয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, মার্চ শেষে ৫ কোটি ১ থেকে ১০ কোটির মধ্যে রয়েছে ১২ হাজার ৪০টি হিসাব। এসব অ্যাকাউন্টে টাকার পরিমাণ ৮৪ হাজার ৬৫১ কোটি টাকা।এ ছাড়া ১০ কোটি ১ থেকে ১৫ কোটি টাকার হিসাব রয়েছে ৩ হাজার ৮৭৫টি। ১৫ কোটি ১ থেকে ২০ কোটি টাকার মধ্যে ১ হাজার ৮৭৪টি অ্যাকাউন্টে আমানত ৩৩ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা।

২০ কোটি থেকে ২৫ কোটি টাকার মধ্যে অ্যাকাউন্ট ১ হাজার ১৪৫টি, ২৫ কোটি ১ থেকে ৩০ কোটির মধ্যে হিসাব রয়েছে ৯২৭টি। ৩০ কোটি ১ থেকে ৩৫ কোটি টাকার হিসাব রয়েছে ৪৯৯টি। ৩৫ কোটি থেকে ৪০ কোটির মধ্যে ৩২৭টি, ৪০ কোটি ১ টাকা থেকে ৫০ কোটি টাকার অ্যাকাউন্ট সংখ্যা ৬৪৬টি। এ সময়ে ৫০ কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা ব্যক্তির সংখ্যা কিছুটা কমে ১ হাজার ৭৫৮টিতে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি আমানতকারী ছিল ৫ জন, ১৯৭৫ সালে তা ৪৭ জনে উন্নীত হয়। ১৯৮০ সালে কোটিপতি হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল ৯৮টি। এরপর ১৯৯০ সালে ৯৪৩টি, ১৯৯৬ সালে ২ হাজার ৫৯৪টি, ২০০১ সালে ৫ হাজার ১৬২টি, ২০০৬ সালে ৮ হাজার ৮৮৭টি এবং ২০০৮ সালে ছিল ১৯ হাজার ১৬৩টি। ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে তা একলাফে বেড়ে দাঁড়ায় ৯৩ হাজার ৮৯০টিতে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বেড়ে কোটিপতি হিসাব দাঁড়ায় ১ লাখ ১ হাজার ৯৭৬টি।