• বুধবার , ১ মে ২০২৪

কবি শামসুর রাহমান-কবিতার আত্মমুখরতা সমষ্টির কলরবে কান পেতে দেওয়া…


প্রকাশিত: ৩:৫০ এএম, ১৬ আগস্ট ১৪ , শনিবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৭৯৮ বার

 

সৈয়দ মনkkkk--------------------জুরুল ইসলাম    :   ডব্লিউ বি ইয়েটস তাঁর ‘এন অ্যাকর অব গ্রাস’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘নিজেকেই পুনর্নির্মাণ করি আমি।’পুনর্নির্মাণ অর্থাৎ প্রতিটি নতুন কবিতাতেই পুরোনো পথ ছেড়ে কিছুটা বেরিয়ে যাওয়া, নিসর্গের বাস্তবের শরীরের এমনকি পরাবাস্তবের একটুখানি ভিন্ন ভূগোলে ঢুকে পড়া, নিজের অভিজ্ঞতা-অনুভূতি-স্বপ্ন-কল্পনার সঙ্গে নতুন একটা বোঝাপড়ায় নামা, ভাষাশৈলী বয়ান অথবা নাটকের নতুন একটা ব্যঞ্জনা তৈরি করা; আর এসব করতে গিয়ে নিজেকে কিছুটা হলেও পূর্ণতর ভাবা। কবি শামসুর রাহমান এ কাজটি নিরন্তর করে গেছেন। তা না হলে প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগের পথেই চলত তাঁর রৌদ্র করোটিতে, জারি থাকত সেই রোম্যান্টিক আবহ, সেই লিরিক্যাল মেজাজ। অথচ মাত্র তিন বছরের দূরত্বে লেখা তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থটি যেন এ কবিকে টেনে বের করল জগতের রাস্তায়, তাঁর আন্তর্জাতিক বোধটিকে করল তীব্র, এক অত্যাশ্চর্য ভাষা দিল, একটা সামাজিক-রাজনৈতিক দায়িত্ব-তালিকা ধরিয়ে দিল তাঁর হাতে। সে বই পড়ে বাংলা কবিতার পাঠকেরা জয়ধ্বনি তুলল, ‘কবি এসে গেছেন।’ রাহমান সত্যিই এলেন, দেখলেন, জয় করলেন। কিন্তু রৌদ্র করোটিতে তিনি থেমে থাকলেন না। চার বছর পর বিধ্বস্ত নীলিমায় উৎসার ঘটালেন নতুন সময়-চিন্তার, জটিল নাগরিক মানসের, নিবিষ্ট হলেন ব্যক্তির মনোজগতের নানা সমীকরণ মেলাতে। তাঁর শেষ বইটি পর্যন্ত তিনি তা করে গেছেন। এটি করতে গিয়ে অনেক চিন্তা, অনেক ভাবনা, বোধ অথবা অভিজ্ঞতায় বারেবারে ফিরে গেছেন। এ জন্য রাহমানের কবিতায় পুনরাবৃত্তি আছে, কিন্তু প্রতিটি পুনরাবৃত্ত চিন্তা অথবা দৃশ্যশব্দকল্প স্থাপিত হয় নতুন এক অভিজ্ঞতা-বোধ-ঘটনার আবহে, ফলে তাদের বিন্যাসের নতুন মাত্রাটি পাঠককে খুঁজে নিতে হয়। তাঁর কবিতা পড়া তাই সজাগ পাঠকের জন্য একটি আনন্দের অনুভূতি, তাঁর পুরান ঢাকার মতো তাঁর কবিতার অলিগলির প্রতিটি মোড়ে নতুন চমক আর দৃশ্যপট অপেক্ষা করে।

kkkkkkkkkkkkk-----------পুরান ঢাকা যখন পুরান ঢাকা ছিল, এক ডুরি আঙুল লেনের সামান্য এমাথা-ওমাথায় যত বৈচিত্র্য, রহস্য আর উষ্ণতার দেখা আমি পেতাম। এখন পুরো বারিধারা ঘুরেও তা পাই না। রাহমানের কবিতায় ওই বৈচিত্র্য ছিল, অতিচেনা দৃশ্যপট ছিল (অথচ সন্ধ্যার বাতি জ্বললে অথবা রাত গভীর হলে সেগুলো কেমন যেন অচেনা হয়ে যেত), জীবনের উত্তাপ ছিল, হাহাকার-কোলাহল-হাসি ছিল, ভাষার মুগ্ধতা ছিল, ঘাম-উষ্ণতা-কাম-প্রেম-রিরংসা—এসব ছিল। ছিল মানে আছে, থাকবে। সজাগ পাঠক একটি কবিতার বই হাতে নিলেই এসব পেয়ে যান।
kkkk-----আরও পেয়ে যান একটা ইউরোকেন্দ্রিক আধুনিকতার অবয়ব, কল্লোল যুগের ইউরো-বঙ্গীয় আধুনিকতার অনুরণন, ইকারুস-বেহুলার মতো ভূগোলবিস্তারি মিথ, আসাদের শার্ট, বন্দীশিবির থেকে লেখা চিঠি, গোরস্তানে কোকিলের করুণ আহ্বান। একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম শামসুর রাহমানের ৬৫তম জন্মবার্ষিকীতে, তাঁর কবিতায় তাঁর নিজেকে পুনর্নির্মাণের প্রসঙ্গ নিয়ে। প্রসঙ্গটি এ জন্য উঠেছিল যে অনেকে বলছিলেন, শামসুর রাহমানের কবিতা পুনরাবৃত্ত হচ্ছে, তাঁর কবিতার শরীরে অবসাদ ও নির্লিপ্তি জমেছে, তিনি অতিশয় লিখে যাচ্ছেন। ওই প্রবন্ধে আমি লিখেছিলাম, তাঁর কবিতা আমার কাছে মোটেও নির্লিপ্ত মনে হয় না, বরং একটা তাড়া যেন অনুভব করি, যেন নিজেকে নতুন করে দেখতে চাইছেন, নিজের ভাবনাগুলো নানা সমীকরণে মেলাতে চাইছেন। এ জন্য শৈশব ও তারুণ্যে তিনি বারবার ফিরে গেছেন, যেন বা মধ্যষাটে দাঁড়িয়ে তিনি একজন তরুণের অবয়বে সাজাতে চাইছেন নিজেকে। সে বছর তাঁর একটি বই বেরিয়েছিল—আকাশ আসবে নেমে। এরপর ২০০৬ সাল পর্যন্ত বেরোয় তাঁর আরও ২২টি কবিতার বই! কোনো কোনো বছর দুটি করে। যেকোনো হিসাবেই অতিশয় লেখা। রাহমান নিজেও স্বীকার করেছেন এই সংখ্যাধিক্যের বিষয়টি। কিন্তু আসলেই কি তিনি পুনরাবৃত্তি করছিলেন, নতুন বোতলে পুরোনো মদিরা ভরে দিচ্ছিলেন; তাঁর কবিতায় দেখা দিচ্ছিল অবসাদ? ওই প্রবন্ধে যা লিখেছিলাম, তার বাইরে এই প্রশ্নের উত্তর আমি পেয়েছি দুটি পর্বে। প্রথম পর্বটি আবদুল মান্নান সৈয়দের সঙ্গে কথোপকথন, দ্বিতীয় শামসুর রাহমানের মৃত্যুর দু-তিন বছর পর তাঁর শেষ চারটি বই পড়া। সেই উত্তরের সারাংশটি এই: ইয়েটস অথবা নেরুদা অথবা পুনরাবৃত্তির অভিযোগ যাঁদের শুনতে হয়, সেই সব বড় কবির মতো রাহমানও আসলে যা করতেন, তা পুনরাবৃত্তি নয়, পুনর্নির্মাণ; বদলে যেতে থাকা জগৎ ও পরাজগতের আয়নায় নিজেকে দেখা ও নিশ্চিন্ত হওয়া যে তিনি আছেন। পুনরাবৃত্তি নিশ্চিতির খোঁজও বটে, সময় ও স্থানের উল্লম্ব এবং আনুভূমিক রেখার পরিবর্তনশীল পরিপ্রেক্ষিতে নিজের অবস্থানটাকে ধরে রাখা, যেমন বন্দরে ভাসতে থাকার জন্য নোঙর ফেলে জাহাজ। মান্নান সৈয়দ আমার প্রবন্ধটি পড়েছিলেন, আমায় জানালেন, তিনিও বিশ্বাস করেন প্রতিটি নতুন বইয়ে রাহমান আবির্ভূত হন নতুন এক মাত্রায়, পুরোনো বিষয়ের গভীরে ঢুকে নতুন করে তাকে সাজান; একটা নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে হঠাৎ পুরোনো বিষয়কে দেখতে গিয়ে নতুন কোনো সৌন্দর্যের রূপের কল্পের সন্ধান পেয়ে যান। মান্নান সৈয়দের মতে, রাহমানের মূল শক্তি তাঁর গীতিকবিতায়। একই সঙ্গে তিনি লিখেছেন, সৈয়দের ভাষায়, কাহিনি-আভাসিত কবিতাও। কিছু কবিতা যদি হয় গীতল, মনোনাট্যের আদলে গড়া, কিছু অন্য কবিতা তখন একটা বয়ানকে ধরে এগোয়, যে বয়ান জীবনের, বাস্তবের; অথচ যেগুলো খণ্ডে খণ্ডে সাজিয়ে একটা গভীর স্তরে তাদের সমন্বয় করেন শামসুর রাহমান। মান্নান সৈয়দ বিশ্বাস করতেন, গীতিকবিতায় রাহমান অনেকটাই আত্মমুখর, অর্থাৎ নিজেকে নিয়ে, তাঁর অহং ও আমিত্বকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত ছিলেন তিনি। একই সঙ্গে কাহিনি-আভাসিত কবিতায় তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন অনাত্মতাকে।
মান্নান সৈয়দের বিরল প্রতিভা ছিল কবিতাকে দর্শনতত্ত্ব-ইতিহাস ও কবিতার নানা শর্ত অনুষঙ্গ বিচারে পড়ার। শামসুর রাহমান সম্পর্কে তাঁর অবলোকন স্বচ্ছ, প্রমাণনির্ভর। এই যে রাহমান শুরুর একান্ত ‘আমি’ থেকে পরবর্তী সময়ে ‘আমরা’র সামূহিক সত্তাটি ধারণ করলেন, এটি ছিল তাঁর কবিতার আত্মমুখরতা থেকে সমষ্টির কলরবে কান পেতে দেওয়া।