• বৃহস্পতিবার , ১৪ নভেম্বর ২০২৪

৯টার ট্রেন কয়টায় ছাড়ে-ঈদের ট্রেনে মহাবিপর্যয়


প্রকাশিত: ৪:৩৫ এএম, ৫ অক্টোবর ১৪ , রোববার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৫৩ বার

 

নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী ট্রেন চলেনি গতকাল। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েন ঘরমুখী যাত্রীরা। হাজারো মানুষকে ট্রেনের অপেক্ষায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্ল্যাটফর্মেই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। চট্টগ্রাম থেকে গতকাল অধিকাংশ ট্রেন কয়েক ঘণ্টা দেরিতে বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। উদ্বিগ্ন মানুষের এই জনস্রোতের ছবিটি চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন থেকে বিকেলে তোলা l প্রথম আলোরংপুর এক্সপ্রেস কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ছাড়ার নির্ধারিত সময় ছিল সকাল নয়টায়। কিন্তু দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত সেই ট্রেনের খবর দিতে পারছিলেন না কেউ।
রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক কমলাপুর স্টেশন পরিদর্শনে আসার কথা বেলা তিনটায়। মন্ত্রীকে যাত্রীদের তোপ থেকে রক্ষা করতে অগত্যা দুপুর দেড়টার দিকে বিশেষ ব্যবস্থায় রংপুর এক্সপ্রেস ছাড়ার তোড়জোড় শুরু করেন রেলের কর্মকর্তারা। অবশেষে বেলা আড়াইটায় কিশোরগঞ্জ থেকে আসা এগারসিন্দুর এক্সপ্রেসের সঙ্গে কিছু কোচ জোড়া দিয়ে রংপুর এক্সপ্রেস নামে ছাড়া হলো। এটি যমুনা এক্সপ্রেস নামে বিকেলে জামালপুর যাওয়ার কথা ছিল।
বিপত্তি আরও আছে। কারণ, রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনের এসি টিকিট বিক্রি করা হয়েছে আগেই। যাত্রীরাও স্টেশনে উপস্থিত। কিন্তু এগারসিন্দুর ট্রেনে এসি কক্ষ নেই। এই যাত্রীদের টিকিট ফেরত নিয়ে শোভন চেয়ারের টিকিট দেওয়া হয়। রংপুর এক্সপ্রেস বিকেল চারটায় ঢাকায় আসে। পরে এটিকেই যমুনা হিসেবে জামালপুরে পাঠানো হয়।
মহানগর গোধূলী ট্রেন বিকেল চারটা ২০ মিনিটে কমলাপুর স্টেশন থেকে ছেড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু রাত ১০টার আগে ট্রেনটি চট্টগ্রাম থেকে কমলাপুরে আসতেই পারবে না বলে রেলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
ঈদযাত্রার শেষ দিকে রেলের সময়সূচিতে বিপর্যয় নেমে এসেছে। গতকাল শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সুবর্ণ এক্সপ্রেস ছাড়া প্রায় সব ট্রেনই দুই থেকে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা দেরিতে ছেড়ে যায়। সুবর্ণ এক্সপ্রেস কমলাপুর থেকে ছাড়া হয় রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের উপস্থিতিতে। রেলের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, মন্ত্রীর মুখ রক্ষার জন্য অন্য ট্রেনের চলাচলে কিছুটা ছাড় দিয়ে সুবর্ণ এক্সপ্রেসকে সময়মতো ছেড়ে দেওয়া হয়। রেলমন্ত্রী সুবর্ণের যাত্রীদের হাত নেড়ে শুভেচ্ছাও জানান।
সময় মেনে ট্রেন না চললেও যাত্রীদের তো আর সময় না মানার সুযোগ নেই। তাই নিজ নিজ গন্তব্যের ট্রেন ছাড়া নির্ধারিত সময়ের আগেই তাঁরা কমলাপুর স্টেশনে এসে পৌঁছে যান। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্লান্তিকর অপেক্ষার ফলে অনেককে স্টেশনে বসে ঝিমুতে দেখা যায়। ঝিমানো একসময় নিদ্রার পর্যায়ে চলে যাওয়ায় অনেককে প্ল্যাটফর্মে কাগজ বিছিয়ে শুয়ে পড়তেও দেখা যায়।
কমলাপুরসহ বড় বড় স্টেশনে ট্রেনের সময়সূচিসহ নানা তথ্য প্রদর্শনের জন্য মনিটর বসানো হয়েছে। অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকা যাত্রীদের অনেককে চাতক পাখির মতো পর্দাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখা যায়। আনন্দযাত্রায় ছেদ পড়ায় অনেককে ক্ষোভ প্রকাশ করতেও দেখা গেছে।
সময়সূচি বিপর্যয় ও যাত্রীদের ভোগান্তির একই চিত্র ছিল চট্টগ্রাম রেলস্টেশনেও। গুরুত্বপূর্ণ এই দুটি স্টেশনে এবং সেখান থেকে ছাড়া সব কটি ট্রেনেই যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড় ছিল।
রেল কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে রেলের এই সময়সূচি বিপর্যয়ের পেছনে চারটি কারণ পাওয়া গেছে। এগুলো হচ্ছে—বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের মিরসরাইতে ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়া, অতিরিক্ত যাত্রী নামাতে গিয়ে স্টেশনগুলোতে বাড়তি সময়ক্ষেপণ, নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে ট্রেনের গতি কমানো এবং ইঞ্জিন-কোচের সংকট। রেলের নিয়ন্ত্রণকক্ষ সূত্রে জানা গেছে, স্বাভাবিক সময়ে মাঝপথের স্টেশনগুলোতে যাত্রী ওঠানামার জন্য তিন-চার মিনিট করে সময় বরাদ্দ রাখা হয়। ঈদে তা ১০ থেকে ১৫ মিনিট পর্যন্ত লেগে যায়।
অবশ্য রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক কমলাপুর স্টেশনে সাংবাদিকদের কাছে এই

 

বিপর্যয়ের জন্য সাবেক বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ঘাড়ে দোষ চাপান। তিনি বলেন, ওই আমলে রেল অবহেলিত ছিল। এখন নতুন করে অনেক কিছু করতে হচ্ছে। তিনি দাবি করেন, ট্রেনের সময়সূচির বিপর্যয় যা হয়েছে, তা অনিচ্ছাকৃত। সব ট্রেন দেরিতে চলছে, এটাও ঠিক নয়।
কমলাপুর স্টেশনের অনুসন্ধান কেন্দ্রে একটি কাগজে লিখে রাখা হয়েছে, চট্টগ্রামগামী মহানগর গোধূলী ট্রেনটি বিকেল চারটা ২০ মিনিটে ছাড়ার কথা। কিন্তু এটি কমলাপুর পৌঁছাবে রাত ১০টায়। এই বিষয়ে একজন যাত্রী রেলমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেন। জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘কে আপনাকে এ কথা বলেছে? যে বলেছে তাঁর নাম, পদবি কী? সে আপনাকে কোনো লিখিত দিয়েছে? আমি আপনার মুখের কথা বিশ্বাস করব না।’ এরপর যাত্রী অনেকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সরে যান।

পরিদর্শন শেষে রেলমন্ত্রী স্টেশন ত্যাগ করেন বেলা সোয়া তিনটায়। বেলা সাড়ে তিনটায় স্টেশনের অনুসন্ধান কেন্দ্রে গিয়ে ওই যাত্রীর অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। দেখা যায়, সেখানে তথ্য দেওয়ার মতো কেউ নেই। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের স্বাক্ষরিত একটি কাগজে বিভিন্ন ট্রেনের কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছানোর এবং স্টেশন থেকে যাত্রা শুরুর সম্ভাব্য সময় লেখা রয়েছে। তাতে মহানগর গোধূলীর স্টেশনে পৌঁছানোর সম্ভাব্য সময় রাত ১০টা এবং চট্টগ্রামের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়ার সময় অনির্ধারিত লেখা রয়েছে।
এর আগে মুজিবুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘সবাই পরিবার নিয়ে ট্রেনে ওঠার কারণে প্রতিটি স্টেশনেই বেশি সময় থামতে হচ্ছে। ঈদ ও পূজা উপলক্ষে ট্রেনে উপচে পড়া ভিড়। রেলের সীমিত সম্পদ দিয়ে যাত্রীসেবা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি।’

ঢাকা-চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম-সিলেট পথের ট্রেনের সময়সূচি বিপর্যয় শুরু হয়েছে বৃহস্পতিবার থেকেই। গতকাল তা সব পথের ট্রেনেই দেখা যায়। দিনাজপুরগামী একতা এক্সপ্রেসের কমলাপুর স্টেশন থেকে ছাড়ার নির্ধারিত সময় ছিল সকাল ১০টায়। সেটি সাড়ে চার ঘণ্টা দেরিতে দুপুর আড়াইটায় ছেড়ে যায়। চট্টলা এক্সপ্রেস নির্ধারিত সময়ের আড়াই ঘণ্টা পর কমলাপুর ত্যাগ করে চট্টগ্রামের উদ্দেশে।
চট্টগ্রাম স্টেশনে গতকাল সকাল থেকেই যেন মানুষের স্রোত নামে। সিলেটে যাওয়ার জন্য গতকাল সকাল আটটার দিকে স্টেশনে পৌঁছান আবীর হাসান। কিন্তু পাহাড়িকা এক্সপ্রেস সাড়ে চার ঘণ্টা দেরিতে ছাড়ে। আবীর বলেন, সময়মতো ট্রেন ছাড়লে দুপুরেই গন্তব্যে পৌঁছানো যেত। এখন সিলেট পৌঁছাতে রাত হয়ে যাবে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাওয়ার জন্য চট্টগ্রাম স্টেশনে স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তান নিয়ে গতকাল সকাল পৌঁনে সাতটায় উপস্থিত হন সাহাব উদ্দিন। দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত মহানগর প্রভাতী স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পৌঁছায়নি। অথচ ওই সময়ে ট্রেনটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল। এটির যাত্রার সময় ছিল সকাল সাতটা। এ কারণে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে সাহাব উদ্দিনের দুই শিশু কান্নাকাটি করছিল।
সাহাব উদ্দিন বলেন, দেরিতে ট্রেন ছাড়বে—এটা যাত্রীদের জানারও সুযোগ নেই। তাই ভোর ছয়টায় বাসা থেকে বের হয়েছেন। ছোট বাচ্চাদের নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকা যেমন কঠিন, বাসায় ফিরে যাওয়াও ঝুঁকিপূর্ণ।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, ঢাকাগামী মহানগর প্রভাতী গতকাল সকাল সাতটার পরিবর্তে বেলা দুইটা ১০ মিনিটে যাত্রা করে। একই ভাবে সিলেটগামী পাহাড়িকা সকাল সোয়া আটটার পরিবর্তে দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে ছেড়ে যায়।

অন্যদিকে ঢাকা থেকে তূর্ণা নিশীথা ট্রেন সকাল সাড়ে সাতটার পরিবর্তে গতকাল দুপুর একটায় চট্টগ্রামে পৌঁছায়। সিলেট থেকে উদয়নও আসে পাঁচ ঘণ্টা দেরিতে।
রেলের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মোজাম্মেল হক ট্রেনের সূচি বিপর্যয়ের কথা স্বীকার করে বলেন, বৃহস্পতিবার মিরসরাইয়ে ট্রেন লাইনচ্যুত, অতিরিক্ত যাত্রী ওঠা-নামা এবং আন্তনগর ট্রেনের গতি ৬৫-৭০ থেকে ৪০-৪৫ কিলোমিটারে নামিয়ে আনার কারণেই সময়সূচিতে বিপর্যয়।