• শনিবার , ৪ মে ২০২৪

লোভে পড়ে রাজশাহীতে বহু মানুষ পথের ফকির-মামলার এক মাস পর ২ গ্রেফতার


প্রকাশিত: ৩:১৪ এএম, ২৭ আগস্ট ২৩ , রোববার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৩৭ বার

রাতারাতি কোটিপতি এমটিএফই’তে

বিশেষ প্রতিনিধি/রাজশাহী প্রতিনিধি : দুবাইভিত্তিক বহুস্তর বিপণন বা মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানি মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ (এমটিএফই) গ্রুপ ইনকরপোরেটেড রাজশাহী শহরে দপ্তর স্থাপন করে শত শত মানুষকে তাদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলেছিল। প্রতারণার শিকার শহরের বাসিন্দাদের বর্ণনা অনুযায়ী, এমটিএফই’র স্থানীয় কর্মীরা গত জুলাই পর্যন্ত অন্তত ৪ মাস প্রকাশ্যে কার্যক্রম চালিয়েছেন।

গত ২৩ জুলাই এমটিএফই’র বিরুদ্ধে ‘আইনানুগ কর্তৃত্ব বহির্ভূত ই-ট্রানজেকশনের মাধ্যমে প্রতারণার’ অভিযোগে আদালতে মামলা দায়ের করা হলে দুবাইভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানটির স্থানীয় কর্মীরা আত্মগোপন করেন।মামলা দায়েরের দিনই রাজশাহীর সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. জিয়াউর রহমান ঘটনাটি ‘গুরুত্বপূর্ণ’ উল্লেখ করে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ (আরএমপি), পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) যৌথ দল গঠন করে তদন্ত করতে নির্দেশ দেন।

তারপরও এমটিএফই’র কর্মীরা পাড়া-মহল্লায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে শত শত মানুষকে এমটিএফই স্মার্টফোন অ্যাপ্লিকেশন ও ওয়েবসাইটে ‘লাখ লাখ টাকা বিনিয়েগে উদ্বুদ্ধ করা’ অব্যাহত ছিল।
গত ১৭ আগস্ট এমটিএফই শত শত মানুষের বিনিয়োগ কেড়ে নিয়ে স্মার্টফোন অ্যাপলিকেশন ও ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেয়।

এমটিএফই বন্ধ হওয়ার সপ্তাহ পরে এবং আদালতের আদেশের প্রায় ১ মাস পরে গত বৃহস্পতিবার রাজশাহী থেকে দেবেন্দ্রনাথ সাহা (৪৩) ও নওগাঁর লতিফুল বারী (৪২) নামে ২ সন্দেহভাজন আসামিকে গ্রেপ্তার করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আরএমপি কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদার বৃহস্পতিবার বলেন, আদালতের নির্দেশে আমরা যৌথ তদন্ত দল গঠন করেছি এবং মামলাটি তদন্ত করছি এবং ২ জনকে গ্রেপ্তার করেছি।

এমটিএফই বৈদেশিক মুদ্রা, পণ্য, স্টক, স্টক সূচক এবং অন্যান্য পণ্যে অনলাইন বিনিয়োগের জন্য একটি ট্রেডিং পরিষেবা সরবরাহকারী হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেয়।নগরীর আহমেদপুর এলাকায় এমটিএফই প্রতারণার শিকার কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা এমটিএফইতে বিনিয়োগ শুরু করেছিলেন গত এপ্রিল মাসে থেকে।

আমরা আমাদের দুর্দশার জন্য লজ্জিত বলে একজন ভুক্তভোগী বলেন, স্মার্টফোন অ্যাপ্লিকেশনটি আগস্ট মাসে তাদের বিনিয়োগ কেড়ে বন্ধ হওয়ার আগ পযর্ন্ত তাদের মধ্যে কেউ কেউ কিছু মুনাফা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল।

তারা জানিয়েছে যে, এমটিএফই’র স্থানীয় কর্মীদের নগদ টাকা সরবরাহ করতেন তারা। এর বিনিময়ে তাদের এমটিএফই অ্যাপে হিসাব খুলে দেওয়া হতো।অ্যাপে ৫০০, ৯০০ ও ১ হাজার ৫০০ ইত্যাদি নানান অংকের মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করার সুযোগ ছিল। রাজশাহীর ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, তাদের বেশির ভাগই ৫০০ থেকে ৯০০ ডলার বিনিয়োগ করেছিলেন, কেউ কেউ আরও বেশি।

বিনিয়োগের পর সপ্তাহে ৩ থেকে ৫ দিন বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ উত্তোলনের সুযোগ দেওয়া হতো। এই দিনগুলোতে তাদের হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো একটি নির্দিষ্ট সময় থেকে ৩০ মিনিট ধরে তাদেরকে অ্যাপে বিনিয়োগ ও লভ্যাংশ উত্তোলনের সুযোগ দেওয়া হতো। তারা ৫০০ ডলার বিনিয়োগ করে নির্দিষ্ট দিনে ২২ ডলার উত্তোলন করতে পারতেন। অনেক সময় পারতেন না, জানিয়েছে তারা।

রাজশাহী জজ কোর্টের আইনজীবী জহুরুল ইসলাম গত ২৩ জুলাই জনস্বার্থে রাজশাহীর সাইবার ট্রাইব্যুনালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা দায়ের করেন।তিনি দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ায় একের পর এক বিদেশি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই সাধারণ মানুষকে বিনিয়োগের ফাঁদে ফেলছে।

মামলার বিবরণে বলা হয়, এমটিএফই নগরীর লক্ষ্মীপুর এলাকায় একটি দপ্তরও স্থাপন করেছিল। সবুজ নামে এক যুবক রাজপাড়া থানা এলাকায় এটি পরিচালনা করছিলেন।মামলায় দুর্গাপুরের রুবেল নামে আরও এক যুবকের নাম উল্লেখ আছে, যিনি শত শত মানুষকে এমটিএফইতে বিনিয়োগের প্রলোভন দেখিয়ে ছিলেন।

মামলায় রুবেলের উদ্ধৃতি অনুযায়ী, কেউ যদি ১০০টি বিনিয়োগ জোগাড় করতে সক্ষম হয়, তবে সে একটি অফিস খোলার যোগ্যতা অর্জন করে এবং সিইও পদ লাভ করে।এভাবে রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার স্বপ্নে টাকা বিনিয়োগ করে শত শত মানুষ এমটিএফইর ফাঁদে পড়ছেন, আইনজীবী বলেন।

এর আগেও এমটিএফই ছাড়া আরও কয়েকটি অ্যাপে বিনিয়োগ করে হাজার হাজার মানুষ প্রতারিত হয়েছেন, তিনি মামলায় উল্লেখ করেন।
জহুরুল ইসলাম বলেন, এ ধরনের অ্যাপগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার দিন পর্যন্ত মানুষকে বিনিয়োগের সুযোগ করে দেয়। পরে একদিন, তাদের বিনিয়োগকৃত টাকা নিজেরা উত্তোলন করে অ্যাপ বন্ধ করে দেয়।

মামলার বিবরণে আরও বলা হয়, নগরীর দাসমারী এলাকার সবুজ, লিটন ও একলাস আল্টিমা ওয়ালেট অ্যাপে প্রায় ২০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন। এ ঘটনায় গত ২৬ জুন সবুজ আলী বাদী হয়ে বোয়ালিয়া থানায় মামলা করলে পুলিশ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করে। তারও আগে মহানগর এলাকা ও গোদাগাড়ী এলাকার অনেক মানুষ অন্য আরেকটি অ্যাপের মাধ্যমে প্রতারিত হয়েছেন।

আদেশে রাজশাহীর সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক জিয়াউর রহমান ঘটনাটি তদন্তের গুরুত্বের কথা অন্তুত ২ বার উল্লেখ করেছেন। আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর ইসমত আরা এই প্রতিবেদককে আদেশের একটি অসাক্ষরিত কপি সরবরাহ করে বলেন, ‘আদালত রাজপাড়া থানার ওসিকে অবিলম্বে অভিযোগটি প্রাথমিক তথ্য বিবরণীর নথিভুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন।’

অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনা করে এবং সুষ্ঠু তদন্তের জন্য আদালত আরএমপির রাজপাড়া থানা, সিআইডি ও পিবিআইয়ের সমন্বয়ে একটি যৌথ তদন্ত দল গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন।

আদেশে বিচারক বলেন, আদালত এর আগেও একই ধরনের কয়েকটি মামলা নিষ্পত্তি করেছে এবং বর্তমানে একই পদ্ধতিতে আরও এক প্রতারক চক্র মাঠে নেমেছে।

আদেশ উল্লেখ করা হয়, একই দিনে থানায় মামলা নথিভুক্ত করা হয়েছিল, তবে ১ মাস পর এমটিএফই বন্ধ হওয়ার আগে পুলিশের এই যৌথ দলের কোনো ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়নি।