• শুক্রবার , ১৭ মে ২০২৪

মানবতার শত্রু সাকা-মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ডের চূড়ান্ত রায় প্রকাশ


প্রকাশিত: ৮:১৪ পিএম, ৩০ সেপ্টেম্বর ১৫ , বুধবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৯৭ বার

saka mujahid-www.jatirkhantha.com.bdএস রহমান.ঢাকা:     যুদ্ধাপরাধ মামলায় জামায়াতে ইসলামীর নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর ফাঁসির রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করেছে আপিল বিভাগ, যার মধ্যে দিয়ে তাদের দণ্ড কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরুর পথ তৈরি হল।
সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম বুধবার রাতে জাতিরকন্ঠকে বলেন, রায়ের কপি নেমেছে। তা ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রারের কাছে পাঠানো হয়েছে।সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটেও রায় প্রকাশ করা হবে বলে তিনি জানান।

প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ গত ১৬ জুন একাত্তরের বদর প্রধান আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের আপিলের রায় ঘোষণা করে।একই বেঞ্চ মুক্তিযুদ্ধকালীন চট্টগ্রামের ত্রাস সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর আপিলের রায় ঘোষণা করে গত ২৯ জুলাই।দুই রায়েই ট্রাইব্যুনালের দেওয়া সর্বোচ্চ সাজার দণ্ড বহাল থকে। বিচারকদের স্বাক্ষরের পর সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখা বুধবার তা প্রকাশ করে। এর মধ্যে মুজাহিদের রায় ১৯১ এবং সাকা চৌধুরীর রায় ২১৭ পৃষ্ঠার।

এই বেঞ্চের অপর তিন সদস্য হলেন- বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।নিয়ম অনুযায়ী এই রায়ের অনুলিপি হাতে পেলে এবং মৃত্যু পরোয়ানা জারির আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলেই সরকার সাজা কার্যকরের চূড়ান্ত প্রক্রিয়া শুরু করতে পারবে। আসামিপক্ষ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) জন্য আবেদন করার সুযোগ পাবে।

আপিল বিভাগের সর্বোচ্চ সাজার আদেশ হাতে পাওয়ার পর বিচারিক আদালত (ট্রাইব্যুনাল) কারাগারে মৃত্যু পরোয়ানা পাঠাবে। এরপর আসামি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করতে পারবেন। তিনি স্বজনদের সঙ্গে দেখাও করতে পারবেন।

ওই মৃত্যু পরোয়ানার ভিত্তিতেই সরকারের তত্ত্বাবধানে কারা কর্তৃপক্ষ সাজা কার্যকরের প্রস্তুতি নেবে। তবে রিভিউ আবেদন হলে তার নিষ্পত্তি হওয়ার আগে দণ্ড কার্যকর করা যাবে না।যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে দণ্ডিতদের মধ্যে এ নিয়ে মোট পাঁচজনের আপিলের নিষ্পত্তি শেষে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হল।
এর মধ্যে ২০১৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ হলে ওই বছর ১২ ডিসেম্বর দণ্ড কার্যকর করা হয়।
ঠিক এক বছর পর আপিলের দ্বিতীয় রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় আপিল বিভাগ। তবে সেই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত না হওয়ায় রিভিউ নিষ্পত্তি হয়নি।
২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর আপিল বিভাগ তৃতীয় রায়ে জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে সর্বোচ্চ সাজা দিলে ২০১৪ সালের ১১ এপ্রিল তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
৬৭ বছর বয়সী মুজাহিদ বর্তমানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন, আর ছেষট্টি বছর বয়সী সালাউদ্দিন আছেন কাশিমপুর কারাগারে।

ডেটলাইন ১৭ জুলাই ২০১৩

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাংবাদিক, শিক্ষকসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং সাম্প্রদায়িক হত্যা-নির্যাতনের দায়ে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
প্রসিকিউশনের আনা সাতটি অভিযোগের মধ্যে প্রথম অভিযোগে সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে অপহরণের পর হত্যা এবং ষষ্ঠ অভিযোগে বুদ্ধিজীবীসহ গণহত্যার ষড়যন্ত্র ও ইন্ধনের অভিযোগে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ওই দণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেওয়া হয়েছিল।
একই রায় এসেছিল সপ্তম অভিযোগে, ফরিদপুরের বকচর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর বর্বর হামলা চালিয়ে হত্যা-নির্যাতনের ঘটনায়।চূড়ান্ত রায়ে আপিল আংশিক মঞ্জুর করে প্রথম অভিযোগে আসামিকে খালাস দেওয়া হয়। সপ্তম অভিযোগে তার সাজা কমিয়ে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আর ষষ্ঠ অভিযোগে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল রেখে মুজাহিদের ফাঁসির আদেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত।

যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাকা চৌধুরীর রায় এসেছিল ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর।প্রসিকিউশনের আনা ২৩টি অভিযোগের মধ্যে নয়টিতে তিনি ট্রাইব্যুনালে দোষী সাব্যস্ত হন। এর মধ্যে চার অভিযোগে তার মৃত্যুদণ্ড এবং পাঁচ অভিযোগে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়।আদালত তার আপিল আংশিক মঞ্জুর করে আটটিতে দণ্ডাদেশ বহাল রাখে, একটিতে সাকা চৌধুরীকে খালাস দেওয়া হয়।
৩, ৫, ৬ ও ৮ নম্বর অভিযোগে চট্টগ্রামের রাউজানে কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের মালিক নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যা, সুলতানপুর ও ঊনসত্তরপাড়ায় হিন্দু বসতিতে গণহত্যা এবং হাটহাজারীর এক আওয়ামী লীগ নেতা ও তার ছেলেকে অপহরণ করে খুনের ঘটনায় তার সর্বোচ্চ সাজা বহাল রাখা হয়।২ ও ৪ নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ২০ বছরের কারাদণ্ড বহাল থাকলেও ৭ নম্বর অভিযোগে ২০ বছরের সাজার ক্ষেত্রে আপিল মঞ্জুর করে তাকে খালাস দেয় আপিল বিভাগ।১৭ ও ১৮ নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া পাঁচ বছর কারাদণ্ডের রায় বহাল রাখা হয় চূড়ান্ত রায়ে।

মন্ত্রী মুজাহিদ-বদর নেতা

জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদের জন্ম ১৯৪৮ সালের ২ জানুয়ারি, ফরিদপুর জেলার পশ্চিম খাবাসপুরে। ১৯৬৪ সালে মাধ্যমিক পাসের পর তিনি ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে ভর্তি হন এবং উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র থাকাকালেই জামায়াতের তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘে যোগ দেন। ১৯৬৮ সালে তাকে সংগঠনের জেলা শাখার সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়।১৯৭১ সালে বাংলার মানুষের স্বাধীনতার সংগ্রাম যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, সেই বছর জানুয়ারিতে ইসলামী ছাত্রসংঘের ঢাকা জেলা শাখার সভাপতি হন মুজাহিদ। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর জুলাই মাসে সংগঠনের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সেক্রেটারির এবং এরপর প্রাদেশিক সভাপতির দায়িত্ব পান।

মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গঠিত হলে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তার নেতৃত্ব দেন ইসলামী ছাত্রসংঘের তখনকার সভাপতি ও জামায়াতের বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী। অক্টোবরে ওই বাহিনীর প্রধান হন মুজাহিদ।তার নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী যুদ্ধের মধ্যে ফরিদপুর, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হত্যা, অপহরণ, লুটপাটের মতো ব্যাপক মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড চালায় বলে আদালতের রায়ে উঠে এসেছে। এমনকি ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের প্রস্তুতির সময়ও বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণ না করার সিদ্ধান্ত নেন মুজাহিদ।

একাত্তরে তার কর্মকাণ্ডের ঘনিষ্ঠ সহযোগী পলাতক আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারকেও যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।স্বাধীনতার পর মুজাহিদ জামায়াতের রাজনীতিতে যুক্ত হন এবং ১৯৮২ সালে কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্য হন। ১৯৮৯ থেকে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালনের পর ২০০০ সালে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল হন তিনি।

কোনো নির্বাচনে জয়ী হতে না পারলেও বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর দায়িত্ব পান মুজাহিদ। জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামের পরিচালনা পর্ষদেরও প্রধান ছিলেন তিনি।যুদ্ধাপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ২০১০ সালের মার্চে জামায়াতে ইসলামীর এক সংবাদ সম্মেলনে মুজাহিদ বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হিসেবে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছে। কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধের মতো কোনো ধরনের অপরাধে জামায়াত নেতারা জড়িত ছিলেন না।

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগের একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে গ্রেপ্তার করার পর ২ অগাস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।মামলার শুনানি শেষে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ২০১২ সালের ২১ জুন ট্রাইব্যুনালে মুজাহিদের বিচার শুরু হয়।

কে এই সাকা চৌ

গত দুই দশকে চটকদার,‘ঔদ্ধত্যপূর্ণ’ এবং কখনো কখনো ‘অশালীন’ মন্তব্যের কারণে বার বার সংবাদপত্রের শিরোনামে এসেছেন সালাউদ্দিন কাদের, যাকে সংক্ষেপে সাকা চৌধুরী নামে চেনে বাংলাদেশের মানুষ।তার জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৩ মার্চ চট্টগ্রামের রাউজান থানার গহিরা গ্রামে। বাবা মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরী এক সময় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকারও হয়েছিলেন।সালাউদ্দিন কাদেরের রাজনীতির শুরুও মুসলিম লীগ থেকেই। পরে জাতীয় পার্টি ও এনডিপি হয়ে তিনি বিএনপিতে আসেন।একাত্তরের অপরাধের জন্য বিতর্কিত এই রাজনীতিবিদ ১৯৭৯ সালে মুসলিম লীগ থেকে রাউজানের সাংসদ নির্বাচিত হন। সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সময়ে তিনি জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন এবং কার্যত এর মধ্যে দিয়েই মূল ধারার রাজনীতিতে তার পুনর্বাসন ঘটে।

১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টির টিকেটে নির্বাচন করে নিজের এলাকা রাউজান থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন সাকা। কিন্তু পরে দল থেকে বহিষ্কৃত হন। এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালে তিনি নির্বাচন করেন নিজের গঠন করা দল এনডিপি থেকে। আবারও তিনি রাউজানের এমপি হন।এর কিছুদিন পর এনডিপি বিএনপির সঙ্গে একীভূত হয় এবং ১৯৯৬ সালে বিএনপির টিকেটে সাংসদ নির্বাচিত হন সালাউদ্দিন। পরের নির্বাচনে ২০০১ সালে তিনি সাংসদ নির্বাচিত হন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থেকে।

বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্বও তিনি পালন করেন।এর আগে সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের শাসনামলে ত্রাণ ও পুনর্বাসন, গৃহায়ণ ওগণপূর্ত এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন সা কা চৌধুরী।সর্বশেষ ২০০৮ সালের র্নিবাচনে রাঙ্গুনিয়া ও ফটিকছড়ি থেকে অংশ নেন সাকা। রাঙ্গুনিয়াতে হেরে গেলেও ফটিকছড়ি, অর্থাৎ চট্টগ্রাম-২ আসন থেকে বিএনপির সাংসদ নির্বাচিত হন তিনি। তিনি সাংসদ থাকা অবস্থায় ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির রায় আসে।

ফজলুল কাদের (ফকা) চৌধুরীর চার ছেলের মধ্যে সাকা চৌধুরীই সবার বড়। তার সেজ ভাই গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক। তিনিও একসময় সাংসদ ছিলেন।বাকি দুই ভাইয়ের মধ্যে সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরী মারা গেছেন। আর জামাল উদ্দিন কাদের চৌধুরী একজন ব্যবসায়ী।