• শনিবার , ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪

মহা-শক্তিশালী হচ্ছে ইউনূস সরকার


প্রকাশিত: ৮:৫৭ পিএম, ৮ নভেম্বর ২৪ , শুক্রবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৩৯ বার

 

০ অন্তর্বর্তী সরকার অধ্যাদেশ ২০২৪
০ সরকারের ‘সব কাজ বৈধ’
০ মেয়াদ অনির্দিষ্ট
০ নো-মামলা

 

শফিক রহমান : অবশেষে মহাশক্তিশালী হচ্ছে ইউনূস সরকার। এজন্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে একটি অধ্যাদেশের খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যাতে সরকারের মেয়াদ নির্দিষ্ট না করে বলা হয়েছে, ত্রয়োদশ সংসদ প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ না করার পর্যন্ত তারা ক্ষমতায় থাকবে।এই সরকারের কোনো কার্যক্রমের বৈধতা সম্পর্কে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টসহ অন্য কোনো আদালত বা কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই কোনো প্রশ্ন উত্থাপন বা তা অবৈধ বা বাতিল করতে পারবে না, এমন কথাও বলা হয়েছে এতে।

অধ্যাদেশে আরো বলা হয়েছে, এ সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন বা মামলাও করা যাবে না।নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ, জরুরি অবস্থা ঘোষণায় প্রধান উপদেষ্টার পরামর্শ নেওয়াসহ সার্বিক বিষয়কে আইনি ভিত্তি নিয়ে এই অধ্যাদেশের খসড়া করা হয়েছে।খসড়ার শিরোনাম করা হয়েছে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অধ্যাদেশ, ২০২৪’।গত ১৯ সেপ্টেম্বর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার এই খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। সেটি এখন গেজেট প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।

শুক্রবার মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আব্দুর রশীদ দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেন,“স্বাভাবিকভাবেই পরবর্তী নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণের আগ পর্যন্ত বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ কার্যকর থাকবে। অধ্যাদেশটি যখন জারি হবে তখনই আপনারা জানতে পারবেন।তিনি বলেন, “নানা ধরনের দিক, যা যা রয়েছে তা চিন্তাভাবনা করে তো অধ্যাদেশের খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। আইন উপদেষ্টা মহোদয় এখন দেশের বাইরে রয়েছেন। উপদেষ্টা দেশে এলে কথা বলে নেবেন।”

সরকারি চাকরিতে কোটার বিরোধিতা করে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সরকার পতনের ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনে রূপ নিলে গত ৫ অগাস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর তিন দিন পর ৮ অগাস্ট মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে শপথ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। তার আগেই ভেঙে দেওয়া হয় সংসদ।

এই সরকারের মেয়াদ কতদিন হবে, সে বিষয়ে এখনও কোনো ধারণা দেওয়া হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, এর মধ্যে আছে সাংবিধানিক সংস্কারও।সংবিধানে বলা আছে, সংসদ ভেঙে দিলে ৯০ দিনের মধ্যে ভোট হতে হবে, আর কোনো দৈব দুর্বিপাকে সেটা করা না গেলে পরের ৯০ দিনেই হতে হবে নির্বাচন। শুরুতে বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারকে সময় দেওয়ার কথা বললেও এখন দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার দাবি করছে।

তবে সরকার শুরু থেকেই তার মেয়াদ এবং নির্বাচনের সময়সীমা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো বক্তব্য দিচ্ছে না। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচনের আভাস দিয়ে একটি বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে বক্তব্য দিলেও সরকারের তরফে সেটি ‘ব্যক্তিগত বক্তব্য’ বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ২০২৫ সালের শেষে ভোট হতে পারে বলে একটি বক্তব্য দেওয়ার পরে সেটি ‘সরকারের বক্তব্য নয়’ বলে প্রতিক্রিয়া জানান ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন।

দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি অবশ্য এরই মধ্যে দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার দাবি তুলছে, তারা বলছে, সংবিধান সংশোধন বা সংস্কারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে নির্বাচিত সংসদ, সেটিই হবে টেকসই। জামায়াতে ইসলামী শুরুতে ‘আগে সংস্কার, পরে নির্বাচন’ এমন একটি অবস্থান নিলেও এখন ‘দ্রুত সংস্কার করে নির্বাচন’ দেওয়ার কথা বলছে।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও তার শরিকদের জনসমর্থন যাই থাকুক না কেন, তাদেরকে ‘ফ্যাসিবাদী’ আখ্যা দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার তাদের কথা মাথায় না রেখেই সব কিছু করছে। এমনকি নির্বাচনি ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, আওয়ামী লীগকে ছাড়া নির্বাচন করলে সেটি অগ্রহণযোগ্য হবে না।

সব কাজ ‘বৈধ’-নো মামলা-

‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক প্রণীত অধ্যাদেশ ও কার্যক্রমের বৈধতা’ বিষয়ে প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, সংবিধান এবং আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, নতুন সংসদ গঠিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী যে তারিখে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন, সেই তারিখের মধ্যবর্তী সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রয়োগ করা ক্ষমতা, অধ্যাদেশ, বিধিমালা, প্রবিধানমালা, প্রজ্ঞাপন, আদেশ, কর্মকাণ্ড ও গৃহীত ব্যবস্থা আইনানুযায়ী যথাযথভাবে করা এবং গ্রহণ হয়েছে বলে গণ্য হবে। সুপ্রিম কোর্ট বা অন্য কোনো আদালত বা কর্তৃপক্ষের কাছে এর বৈধতা সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না বা একে অবৈধ বা বাতিল করতে পারবে না।

অন্তর্বর্তী সরকার একটি অধ্যাদেশের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে, যাতে বলা হয়েছে সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না।
‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন ও কার্যধারা রক্ষণ’ সংক্রান্ত ধারায় বলা হয়েছে- অন্তর্বর্তী সরকার গঠন বা এর প্রধান উপদেষ্টা বা কোনো উপদেষ্টাদের নিয়োগ সম্পর্কে কোনো ত্রুটি রয়েছে, কেবল এ কারণে কোনো কাজ অবৈধ হবে না বা এ সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন বা মামলা করা যাবে না।

প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ, প্রধান উপদেষ্টা পরামর্শ গ্রহণ, সরকারের মেয়াদ ও পদমর্যাদার বিষয়ে অধ্যাদেশে বলা হয়েছে।
০০ একজন প্রধান উপদেষ্টা এবং তিনি যতজন উপদেষ্টা নির্ধারণ করবেন সে সংখ্যায় উপদেষ্টা নিয়োগ করবেন।
০০ প্রধান উপদেষ্টা ও অন্যান্য উপদেষ্টাকে শপথ করাবেন রাষ্ট্রপতি।
০০ অন্তর্বর্তী সরকার সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনকে সাহায্য ও সহায়তা দেবে।
০০ প্রধান উপদেষ্টা প্রধানমন্ত্রীর এবং উপদেষ্টারা মন্ত্রীর পদমর্যাদা, পারিশ্রমিক ও সুযোগ-সুবিধা পাবেন।
০০ রাষ্ট্রপতির কাছে নিজে লেখা ও স্বাক্ষরযুক্ত পত্রের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টারা পদত্যাগ করতে পারবেন।
০০ পদত্যাগ, মৃত্যু বা অন্য কোনো কারণে প্রধান উপদেষ্টার পদ শূন্য হলে উপদেষ্টাদের মধ্য থেকে রাষ্ট্রপতি একজনকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিতে পারবেন।
০০ প্রধান উপদেষ্টার পরামর্শ গ্রহণের বিষয়ে হয়েছে, বিদ্যমান অন্যান্য আইনে যা কিছুই বলা থাকুক না কেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সময় প্রধান উপদেষ্টার পরামর্শ নিয়ে রাষ্ট্রপতি কাজ করবেন। জরুরি অবস্থা ঘোষণার বৈধতার জন্য ঘোষণার আগে তাকে প্রধান উপদেষ্টার প্রতিস্বাক্ষর নিতে হবে।

মেয়াদ অর্নির্দিষ্ট-

এই বিষয়টি সুনির্দিষ্ট না করে সরকারের মেয়াদ বিষয়ে অধ্যাদেশের খসড়ায় বলা হয়েছে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ গঠিত হওয়ার পর নতুন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণ করার তারিখ পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকার বহাল থাকবে।এই সরকার একটি ‘অস্থায়ী বা সাময়িক’ সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে বলেও এতে উল্লেখ আছে। বলা হয়েছে, “সরকারি কর্মচারীদের সহায়তায় সরকার কাজ করবে।তুমুল গণআন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের তিনদিন পর ৮ অগাস্ট মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে শপথ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার।নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ বিষয়ে খসড়ায় বলা হয়েছে, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক সংসদ সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠানে এবং সংবিধান বা অন্য কোনো আইন দিয়ে নির্ধারিত দায়িত্ব পালনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে সাহায্য ও সহায়তা দেবে।

প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টা নিয়োগে অযোগ্যতা

০০ দেশের নাগরিক না হন এবং তার বয়স ২৫ বছর পূর্ণ না হয়; কোনো আদালত অপ্রকৃতিস্থ বলে ঘোষণা হন; দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার পর দায় থেকে অব্যাহতি না পেয়ে থাকেন; কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেন কিংবা কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করেন।
০০ নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে এবং মুক্তি পাওয়ার পর পাঁচ বছর পার না হলেও এসব পদে নিয়োগ পাওয়া যাবে না।
০০ বাংলাদেশ কোলাবোরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল) অর্ডার, ১৯৭২ এর অধীন কোনো অপরাধের জন্য দণ্ডিত হলে এবং
০০ ‘ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে প্রার্থী হবেন না’—এ বিষয়ে সম্মত না হন।

আগের অন্তর্বর্তীকালীন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার
তিন দশকেরও বেশি সময় আগে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থা এসেছিল দেশে।১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে সেনাশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের পতনের পর পঞ্চম জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠন করা হয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার।পরে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন হলে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন, ২০০১ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচন হয় তত্ত্ববধায়ক সরকারের অধীনে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মেয়াদ ছিল ৯০ দিন।তবে সবশেষ ২০০৭ সালে ১১ জানুয়ারি ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার শপথ নেয়। তবে এই সরকার ক্ষমতায় থাকে প্রায় দুই বছর।২০১১ সালে এক রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অসাংবিধানিক বলে রায় দেয় সুপ্রিম কোর্ট। ওই বছরের ৩০ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে নবম সংসদ।

অধ্যাদেশ নিয়ে নানা প্রশ্ন

অধ্যাদেশ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেন, ‌‘এটা যেন নিজের চরিত্র নিয়ে নিজেই সার্টিফিকেট দেওয়ার মতো অবস্থা। আমি কতদিন ক্ষমতায় থাকব, সেটি নিয়ে অধ্যাদেশ জারি করা হলে প্রশ্ন তো উঠতেই পারে।’ এ সরকারের অবস্থা সামরিক জান্তার মতো হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার কী করতে চায়, আমরা বুঝি না। যে পর্যন্ত সংবিধান বলবৎ থাকবে, ততক্ষণ এর বাইরে কারও কিছু করার এখতিয়ার নেই। তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্টের অনুমোদনের পরেই এ সরকার গঠন হয়েছে। তাই জনগণের মতামত ছাড়া এ সরকার কিছুই করতে পারবে না। করলে সেটি হবে অবৈধ।