• শুক্রবার , ৩ মে ২০২৪

সিএএবির বাদরামির খেসারত-১৯০ কোটি টাকা ফেরত গেল


প্রকাশিত: ৫:২১ এএম, ১০ অক্টোবর ১৫ , শনিবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৬১ বার

civilমোস্তফা কামাল প্রধান:    গত ৬ মাসে দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দরের ১০টি উন্নয়ন প্রকল্পের ১৯০ কোটি টাকা ফেরত গেছে। অভিযোগ উঠেছে, কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালিপনা ও অদক্ষতা এবং মামলা-মোকদ্দমার ভয় ও কমিশন বাণিজ্য করতে না পারায় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সদস্য পদে যোগদান করা নতুন এক শীর্ষ কর্মকর্তার একরোখা সিদ্ধান্তের কারণেই প্রকল্পগুলোর অর্থ ফেরত গেছে।
প্রকল্পগুলো হচ্ছে- ১২ কোটি টাকার এক্সরে ইমেজ অ্যানালাইজার, ৩০ কোটি টাকার আইসিটি ই-গভর্নেন্স, আড়াই কোটি টাকার ভিএইচএফ ফাইন্ডার, ২৫ কোটি টাকার এআইএস টু আইএম প্রকল্প, ২৫ কোটি টাকার ভিসিসিএস প্রকল্প, ২০ কোটি টাকার রানওয়ে ক্যালিব্রেশন, ৭ কোটি টাকার এডভান্স প্যাসেঞ্জার ইনফরমেশন সিস্টেম, ১০ কোটি টাকার সিলেটের আইএলএস প্রকল্প, ২০ কোটি টাকার ফ্লাইট ইনফরমেশন ডেভেলপমেন্ট সিস্টেম ও ২২ কোটি টাকার ফায়ার কন্ট্রোল ইকুইপমেন্ট প্রকল্প।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের একাধিক প্রকৌশলী ও শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, সিভিল এভিয়েশনের ইতিহাসে বরাদ্দের টাকা ফেরত যাওয়ার কোনো রেকর্ড নেই। তারা জানান, প্রতি বছর শাহজালালসহ বিভিন্ন বিমানবন্দরে ১৫শ’ কোটি টাকার বেশি অর্থের কাজ থাকে। গড়ে প্রতি বছর ৭শ’ থেকে ৯শ’ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া যায়। প্রতি বছর বরাদ্দের অর্ধেক ঘাটতি থেকে যায়। সেখানে ১৯০ কোটি টাকা ফেরত গেলে বিমানবন্দরগুলোর কার্যক্রমে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।
জানা গেছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্য ১৯০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। কিন্তু টাকা ফেরত যাওয়ায় প্রকল্পগুলোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, ৪ বছর ধরে দেশের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর শাহজালালের ফ্লাইট ইনফরমেশন সিস্টেমটি খারাপ। বর্তমানে জোড়াতালি দিয়ে এটি চালানো হচ্ছে। তাও আবার ম্যানুয়ালি তৈরি করা। যার কারণে যাত্রী ও দর্শনার্র্থীরা এই সিস্টেম থেকে ফ্লাইট সম্পর্কে তাৎক্ষণিক কোনো আপডেট তথ্য পায় না। এছাড়া এই বিমানবন্দরে কোনো ফায়ার এক্সিট নেই। এ অবস্থায় কোনো দুর্ঘটনা কিংবা আগুন লাগলে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসবে। আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশন (আইকাও) ইতিপূর্বে একাধিকবার শাহজালালসহ দেশের সব বিমানবন্দরে ফায়ার এক্সিট তৈরির নির্দেশনা দিলেও এখন পর্যন্ত এই প্রকল্পের কোনো উদ্যোগ নেই। এ বছর বাজেটে এই ফায়ার এক্সিট তৈরির জন্য টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও কর্তৃপক্ষের একগুঁয়েমি ও অজ্ঞতায় এই টাকাও ফেরত গেছে।
একই অবস্থা সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দরেরও। তৈরির পর থেকে এই বিমানবন্দরের রানওয়েতে কোনো ধরনের ইন্সট্র–মেন্টাল ল্যান্ডিং সিস্টেম (আইএলএস) নেই। এ কারণে কুয়াশার সময় বিমান ল্যান্ডিং করতে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় পাইলটদের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণভাবে ২৪০০ মিটার ওপর থেকে পাইলট রানওয়ে পরিষ্কার দেখতে পেলে তবেই বিমান নামাতে পারেন। আইএলএস বসানো থাকলে সেই দূরত্ব কমে দাঁড়ায় ৮০০ মিটারে। ফলে কুয়াশার সময় বিমান ওঠানামায় সুবিধা হয়। এছাড়া দীর্ঘ সময় আকাশে ঘুরতে না হওয়ায় বিমানের জ্বালানি খরচও কমে। এসব চিন্তা করেই চলতি বাজেটে সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দরের রানওয়েতে আইএলএস বসানোর জন্য ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। কিন্তু যথাযথ ব্যবস্থা না নেয়ায় এই টাকাও ফেরত গেছে। এ অবস্থায় ওসমানী বিমানবন্দরে আইএলএস বসানো অনিশ্চিত হয়ে গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বেবিচকের ওই শীর্ষ কর্মকর্তা প্রকল্পগুলো সরাসরি বাতিল না করে নানা অভিনব পন্থায় সেগুলো বাতিল করেন। অভিযোগ রয়েছে, সিদ্ধান্তের জন্য যখনই কোনো কাজের প্রাক্কলন ওই কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয় তখনই তিনি পুনঃযাচাই-বাছাই ও প্রেজেন্টেশনের নামে কালক্ষেপণ করে থাকেন। নোটে সভা প্রয়োজন, কথা বলুন, আলাপ করুন বলে ফাইল ফেলে রাখেন। মাসের পর মাস গেলেও নানা মৌখিক অজুহাতে আলাপ করেন না ও সভার জন্য কোনো তারিখ দেন না। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এটি সরকারি নীতিমালা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ওই কর্মকর্তা কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি বা সাব-কমিটির সদস্যদের ভয় প্রদর্শন ও ক্ষমতার জোরে তার অপছন্দের টেন্ডার বা টেন্ডারদাতার বিরুদ্ধে এবং তার ইচ্ছানুযায়ী রিপোর্ট তৈরি করে জমা দেয়ার জন্য চাপ দিয়ে থাকেন। জানা যায়, কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি বা সাব-কমিটি তৈরিই করা হয় সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করার স্বার্থে। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, এই সাব-কমিটি টেন্ডারের দর ও কারিগরি মান যাচাই করে মূল্যায়ন সভায় বহিঃসদস্যদের উপস্থিতিতে রিপোর্ট প্রদান করবে এবং সেই সভাতেই সিদ্ধান্ত হবে টেন্ডারটি গ্রহণ করা হবে কিনা। কিন্তু বর্তমানে ওই কর্মকর্তা বহিঃসদস্যদের উপস্থিতি ছাড়াই নিজ ইচ্ছানুযায়ী রিপোর্ট তৈরি করে চূড়ান্ত মূল্যায়ন সভা আহ্বান করেন যাতে তার ইচ্ছানুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে সবাই বাধ্য থাকে।
অভিযোগ রয়েছে, ওই কর্মকর্তা যোগদানের কিছুদিন পরই সিভিল এভিয়েশনে অলিখিত নিয়ম জারি করেছেন, ঠিকাদারদের কাজের বিল নিতে হলে মোট বিলের ২ শতাংশ কমিশন দিতে হবে তাকে। কমিশনের টাকা না দিলে তিনি কোনো কাজ শেষ হওয়ার পর এবং একসেপ্টেন্স কমিটির রিপোর্ট হওয়ার পরও ক্রয়সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ঠিকাদারের বিল প্রদান না করার জন্য টেলিফোনে নির্দেশ দেন। অপরদিকে টাকা দিলে সেই একই ব্যক্তি কিছুদিন পর আবার টেলিফোন করে একই কাজের বিল প্রদান করতে বলেন। সিভিল এভিয়েশনের হিসাব শাখায় এ নিয়ে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি বেবিচকের সবাই জানলেও কেউ টুঁ শব্দটিও করেন না।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জন্য একটি রানওয়ে সুইপার গাড়ি কেনা হয় এবং সেটি সফলভাবে সংস্থাপন করা হয়েছে মর্মে শাহজালাল কর্তৃপক্ষ থেকে প্রত্যয়নও দেয়া হয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সিভিল এভিয়েশন অথরিটি বাংলাদেশের (সিএএবি) ওই সদস্য বিল না ছাড়ার জন্য মৌখিক নির্দেশনা দেন। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ইতিমধ্যে আর্থিক সাল সমাপ্ত হয়ে যাওয়ায় ওই বিল ছাড় নিয়ে এখন জটিলতা দেখা দিয়েছে। অথচ কোনো কাজ সফলভাবে সমাপ্ত হলে এবং এই মর্মে প্রত্যয়ন পাওয়া গেলে কার্য সম্পাদনকালীন অর্থবছরেই বিল ছাড়ে সরকারি নিয়ম রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের সচিব খোরশেদ আলম চৌধুরী বলেন, বর্তমান সরকার দেশের বিমানবন্দরগুলোর উন্নয়ন, আধুনিকায়ন ও নিরাপত্তায় ব্যাপক কাজ করে যাচ্ছেন। পর্যটক আকর্ষণ করার জন্য এর বিকল্প নেই। কাজেই বিমানবন্দরগুলোর উন্নয়নে কারও বাধা ও অনিয়ম সহ্য করা হবে না। সচিব বলেন, সিভিল এভিয়েশনের ১৯০ কোটি টাকা ফেরত যাওয়ার বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে।