• রোববার , ১২ মে ২০২৪

মেজর আরিফের খুনের দায় স্বীকার-খুনীদের ব্যাংকে শত কোটি টাকা


প্রকাশিত: ৭:০৬ পিএম, ৪ জুন ১৪ , বুধবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৬১ বার

শফিক আজিজি: ঢাকা ৪ জুন ২০১৪:

অবশেষে খুনের দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দী দিয়েছে মেজর আরিফ। হত্যাকান্ডে জড়িত র‌্যাব সদস্যদের নামও বলেছে সে। তদন্তে বেরিয়ে এসেছে খুনীচক্রের সহযোগীদের নামও। গুম হত্যা অপহরণসহ নানা ধরনের আন্ডারওয়ার্ল্ড কানেকশন ছিল মেজর আরিফের। মেজর আরিফ ও খুনীদের অবৈধ সাম্রাজ্যে থেকে আয় করা প্রায় শত কোটি টাকার ব্যাংক হিসাবও মিলেছে।খুব শিগগির মেজর আরিফ ও তার সহযোগীদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হচ্ছে।

আমাদের নারায়নগঞ্জ প্রতিনিধি জানায়, নারায়ণগঞ্জে সাতজনকে অপহরণ ও খুনের ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন র‌্যাব-১১-এর সাবেক কর্মকর্তা মেজর আরিফ হোসেন।

আজ বুধবার দুপুরে মেজর আরিফকে কঠোর গোপনীয়তা ও নিরাপত্তার মধ্যে জেলার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে হাজির করা হয়। সেখানে তিনি এ জবানবন্দি দেন।

ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, নারায়ণগঞ্জের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম এ এম মহিউদ্দিনের কাছে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন মেজর আরিফ। বিচারকের খাসকামরায় এ জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়।

আদালত সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে আইনজীবী সাখাওয়াত হোসেন খান আরও বলেন, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে মেজর আরিফ ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা, হত্যাকাণ্ডে কারা কারা জড়িত এবং নিজে জড়িত থাকার ‘দায় স্বীকার’ করেছেন।

নারায়ণগঞ্জে পাঁচ অপহরণ ও খুনের ঘটনায় নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলামের দায়ের করা মামলায় পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে আজ মেজর আরিফকে আদালতে হাজির করা হলে তিনি এ জবানবন্দি দেন। জবানবন্দি শেষে তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত। তাঁকে মোট তিন দফা রিমান্ডে নেওয়া হয়।

২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে অপহূত হন নারায়ণগঞ্জের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজন। এর তিনদিন পর ছয়জনের এবং পরদিন আরেকজনের লাশ শীতলক্ষ্যায় ভেসে ওঠে।

চক্রটির শত কোটি কালো টাকার হদিস

আমাদের নারায়নগঞ্জ প্রতিনিধি জানায়, খুনী র‌্যাব সদস্যদের অপরাধ সাম্রাজ্যে উদঘাটন করতে গিয়ে মিলেছে চক্রটির শত কোটি কালো টাকার হদিস।এসব কালো এসেছে খুন ,গুম, অপহরনসহ নানা ধরনের অপরাধ কর্ম থেকে।

র‌্যাবের সাবেক কর্মকর্তা মেজর আরিফ ও তার দুই আত্মীয়ের ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। তিনটি বেসরকারি ব্যাংকের হিসাবে আরিফের অর্ধশত কোটির বেশি টাকা জমা রয়েছে। রাজধানীর মিরপুর ডিওএইচএস এবং মোহাম্মদপুরে দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের সন্ধানও পেয়েছে তদন্ত কর্মকর্তারা। সেনা কর্মকর্তার হিসাবে এত টাকার উৎস সম্পর্কে সন্তোষজনক জবাব দিতে পারছেন না মেজর আরিফ। বিলাসবহুল ফ্ল্যাট সম্পর্কেও কিছু বলছেন না। এ সংক্রান্ত প্রশ্ন বারবার এড়িয়ে যাচ্ছেন তিনি। নারায়ণগঞ্জে সাত অপহরণ ও খুনের মামলায় রিমান্ডে আছেন সাবেক এ সেনা কর্মকর্তা।
টাকার উৎস সম্পর্কে আরিফ নানা ধরনের কথা বলছেন। একবার বলেন, কয়েক মাস আগে কিছু জমি বিক্রি করেছি। সেখান থেকে পাওয়া মোটা অংকের টাকা ব্যাংকে রয়েছে। তবে কোন এলাকায় জমি বিক্রি করেছেন সে সম্পর্কে নিশ্চিত করে তিনি কিছু জানাতে পারেননি। গত বছরের আগস্ট এবং চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও মিরপুর ডিওএইচএস এলাকায় কেনা ফ্ল্যাটের ব্যাপারেও সন্তোষজনক কোনো জবাব দেননি সাবেক এই মেজর।
তদন্ত কর্মকর্তারা মনে করছেন, সাত খুনের ঘটনায় মোটা অংকের টাকা লেনদেনের যে অভিযোগ করা হচ্ছে তার বড় একটি অংশ মেজর আরিফের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে। ঘটনা প্রমাণে এটি বড় সহায়ক হিসেবেও কাজ করবে। এছাড়া মেজর আরিফের নামে কেনা দুটি ফ্ল্যাটের ব্যাপারেও তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গ্রামের বাড়িতে নামে-বেনামে কেনা সম্পত্তি সম্পর্কেও তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
তদন্ত কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে, ময়মনসিংহের গফরগাঁওয় পৌর শহরের ৯নং ওয়ার্ডের শিলাসীতে মেজর আরিফের গ্রামের বাড়ি। সেখানেও তার নামে-বেনামে রয়েছে বিশাল সম্পত্তি। শিলাসী গ্রামের রেল লাইনের পূর্ব পাশে রয়েছে তার বিলাসবহুল একটি বাড়ি। বাড়িটি দ্বিতীয় তলার নির্মাণ কাজ চলছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নির্মাণ শ্রমিক জানান, র‌্যাবের সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা আরিফ হোসেনের পূর্বের বাড়ি ছিল গাজীপুর জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলায়।
গফরগাঁও উপজেলার পৌর শহরের ৯নং ওয়ার্ডের শিলাসী গ্রাম তার নানার বাড়ি। ১/১১-এর সময় মেজর আরিফ যৌথবাহিনীর ইনচার্জ হিসেবে গাজীপুর জেলার দায়িত্বে ছিলেন। ১/১১-তে গাজীপুর জেলায় যৌথবাহিনীর ইনচার্জের দায়িত্ব পালনকালে বিশাল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন এই সেনা কর্মকর্তা। সম্প্রতি পৌর শহরের প্রাণকেন্দ্র কলেজ রোডের খায়রুল্লাহ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের বিপরীতে (ক্ষণিকা) সোহরাব হোসেনের কাছ থেকে ১ কোটি ৩৬ লাখ টাকায় ১৩ শতাংশ জমি কিনে আলোচনায় আসেন এই মেজর। চরশিলাসী মৌজায় মেজর আরিফ তার মা এবং ছোট ভাইয়ের নামেও কিনেছেন প্রায় কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি। এ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করেছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। পর্যায়ক্রমে আরিফকে তার সম্পত্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
এদিকে দুই দফা রিমান্ড শেষে ফের ৫ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে র‌্যাব-১১ এর আদমজী ক্যাম্পের সাবেক ইনচার্জ লে. কমান্ডার এমএম রানাকে। রিমান্ড শেষে সোমবার বিকালে তাকে নারায়ণগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কেএম মহিউদ্দিনের আদালতে হাজির করে ফের সাত দিনের রিমান্ড আবেদন জানায় মামলার তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ। শুনানি শেষে আদালত তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। আদালতে শুনানির সময় বরাবরের মতো র‌্যাব কর্মকর্তার পক্ষে কোনো আইনজীবী দাঁড়াননি। এ সময় আদালতে এমএম রানাকে কিছু বলার আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, নূর হোসেনকে তিনি কোনোদিনই চিনতেন না। অপহরণের স্থান তার দায়িত্বে থাকা এলাকার মধ্যে ছিল না দাবি করে এমএম রানা বলেন, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার।
চাঞ্চল্যকর এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ইন্সপেক্টর মামুন উর রশিদ যুগান্তরকে বলেছেন, সাবেক তিন র‌্যাব কর্মকর্তাকে রিমান্ডে এনে অব্যাহত জিজ্ঞাসাবাদে অনেক তথ্যই পাওয়া গেছে। তবে এদের কাছ থেকে মামলায় সহায়ক তথ্য আদায় করা কঠিন কাজ। তাদের কাছ থেকে পাওয়া গত কয়েক দিনের তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
এদিকে রিমান্ডে থাকা র‌্যাব-১১ এর সাবেক অপর দুই কর্মকর্তা লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ ও লে. কমান্ডার এমএম রানা ঘটনার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করলেও হত্যাকাণ্ডের সব দায় চাপাচ্ছেন মেজর আরিফের ওপর। তারা তদন্ত কর্মকর্তাদের বারবার বলেছেন, এ ব্যাপারে মেজর আরিফ সব কিছু জানেন। আর মেজর আরিফ বলছেন, ‘আমি অর্ডার ফলো করেছি মাত্র।’ তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রটি আরও বলেছে, মেজর আরিফের সঙ্গে নূর হোসেনের ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ তাদের হাতে রয়েছে। আরিফ নিজে একজন মাদকাসক্ত ছিলেন, তিনি নিয়মিত ইয়াবা সেবন করতেন। নূর হোসেন প্রতিদিনই লোক মারফত তার কাছে ইয়াবা পৌঁছে দিতেন। ওই সূত্র জানিয়েছে, মেজর আরিফ জিজ্ঞাসাবাদেও একটি পর্যায়ে মাদক সেবনের বিষয়টি তদন্ত দলের কাছে স্বীকার করেছেন। এছাড়া কাঁচপুর ব্রিজের নিচে বিআইডব্লিউটিএ’র ডাম্পিং স্টেশনে নূর হোসেনের রংমহলে প্রায় প্রতি রাতেই যেতেন মেজর আরিফ। গভীর রাত পর্যন্ত তিনি ওই রংমহলেই কাটাতেন। নূর হোসেনের কাছ থেকে প্রতি মাসে মোটা অংকের মাসোহারা নেয়ার তথ্য-প্রমাণও এখন তদন্ত কর্মকর্তাদের হাতে রয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট অপর একটি সূত্র বলেছে, গত কয়েক দিনে তারা চাঞ্চল্যকর বেশ কিছু তথ্য পেয়েছেন। এর মধ্যে হত্যার পর লাশগুলো নদীতে ফেলার জন্য কাঁচপুর ব্রিজের নিচে শান বাঁধানো ঘাট দিয়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় উঠানো হয় বলে তারা জানতে পেরেছেন। ওই রাতে ঘাটের আশপাশে থাকা প্রত্যক্ষদর্শী দু’জনের বক্তব্যে এমন তথ্য পেয়েছে তদন্ত কর্তৃপক্ষ। প্রত্যক্ষদর্শী ওই দুই ব্যক্তি পুলিশকে বলেছেন, ২৭ এপ্রিল রাত দেড়টার দিকে তারা কয়েকজন লোককে ইঞ্জিনচালিত একটি নৌকায় কিছু বস্তা উঠাতে দেখেছেন। ছোট্ট একটি পিকআপ ভ্যানে করে ওই বস্তাগুলো ঘাটে আনা হয়েছিল। তবে ওই বস্তায় কি ছিল তা তারা জানেন না।
২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে র‌্যাব সদস্য পরিচয়ে তুলে নেয়া হয় নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে। ৩০ এপ্রিল ও ১ মে ইটের বস্তা দিয়ে বাঁধা তাদের লাশ ভেসে ওঠে শীতলক্ষ্যা নদীতে। লোমহর্ষক এ ঘটনার পর র‌্যাব-১১ এর কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, একই ব্যাটালিয়নের দ্বিতীয় অধিনায়ক মেজর আরিফ হোসেন এবং সিদ্ধিরগঞ্জ ক্যাম্প কমান্ডার নৌবাহিনীর লে. কমান্ডার এমএম রানার দিকে অভিযোগের আঙুল তোলেন নিহত নজরুল ইসলামের শ্বশুর।
৬ কোটি টাকার বিনিময়ে র‌্যাবের ওই কর্মকর্তারা নজরুলসহ সাতজনকে অপহরণের পর হত্যা করেছে বলে অভিযোগ করা হয়। এরপর ওই তিন কর্মকর্তাকে প্রথম নিজ-নিজ বাহিনীতে ফেরত নেয়া হয়। পরে দুই সেনা কর্মকর্তাকে অকালীন অবসর এবং নৌ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। হাইকোর্টে একটি রিট পিটশনের পর আদালত আলোচিত এ মামলায় তিনজনকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। – See more at: http://www.jugantor.com/first-page/2014/06/03/106997#sthash.ry7jM76g.dpuf

নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া র‌্যাবের তিন কর্মকর্তাসহ ওই বাহিনীর আরও কয়েকজন সদস্য, ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর হোসেন ও তাঁর সহযোগীরা জড়িত বলে তথ্য-প্রমাণ পেয়েছেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির তদন্তকারী কর্মকর্তারা।
গতকাল মঙ্গলবার হাইকোর্টে দেওয়া অগ্রগতি প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে সিআইডি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এঁরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অপহরণ এবং অপহরণ-পরবর্তী নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও লাশ গুমের ঘটনায় জড়িত। তবে টাকার বিনিময়ে এ হত্যাকাণ্ড হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
অ্যাটর্নি জেনারেলের সূত্র  প্রতিবেদন পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
সিআইডির প্রধান ও অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোখলেসুর রহমান  বলেন, আদালতের নির্দেশ মেনে সিআইডির পক্ষ থেকে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। তবে প্রতিবেদনে কী আছে, তা তিনি জানাতে চাননি।
নারায়ণগঞ্জে সাতজনকে অপহরণ ও খুনের ঘটনা নিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন বিবেচনায় নিয়ে ৫ মে হাইকোর্টের ওই বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত রুল জারি করেন। এতে সাতজনকে অপহরণ ও হত্যার ঘটনায় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সদস্যের গাফিলতি আছে কি না, এটিসহ পুরো ঘটনা তদন্তে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে সাত সদস্যের কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়৷ এ ছাড়া আদালতে এ ঘটনা নিয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক, র‌্যাবের মহাপরিচালক ও সিআইডির প্রধানকে পৃথক তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার আদেশ দেন৷ আদালতের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে গত সোমবার পুলিশ এবং র‌্যাবও পৃথক অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করে৷ সর্বশেষ প্রতিবেদনটি দাখিল করে সিআইডি৷ পুলিশ ও র‌্যাবের প্রতিবেদন সম্পর্কে বিস্তারিত জানা সম্ভব হয়নি৷
সিআইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাত খুনের ঘটনায় র‌্যাব-১১-এর তিন কর্মকর্তাসহ এ পর্যন্ত মোট ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ এর মধ্যে ফতুল্লা থানায় দায়ের করা দুটি মামলায় র‌্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক তারেক সাঈদ মোহাম্মাদ, মেজর আরিফ হোসেন ও লে. কমান্ডার এম এম রানাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ এর বাইরে আরও ১৪ জনকে অন্য মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিদের দফায় দফায় রিমান্ডে এনে মামলার মূল তদন্তকারী কর্মকর্তা, জেলা গোয়েন্দা শাখা ও সিআইডি পুলিশ পৃথকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে৷ জিজ্ঞাসাবাদের সময় র‌্যাবের তিন কর্মকর্তা এ ঘটনা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন৷ তদন্তে এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে৷
সিআইিডর প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এ ঘটনায় আসামিদের ব্যবহার করা মোবাইল ফোনের কথাবার্তার রেকর্ড এবং অপহরণ ও হত্যার স্থান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য মিলেছে৷ অপহরণ, খুন ও গুম করার সঙ্গে আরও কারা জড়িত, কে কীভাবে কাজ করেছে এবং কে কীভাবে সহায়তা করেছে, সে ব্যাপারে পাওয়া তথ্য যাচাই করা হচ্ছে৷
তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, র‌্যাবের তিন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদের পর তদন্তকারীরা নিশ্চিত হয়েছেন যে এ ঘটনায় র‌্যাবের গ্রেপ্তার হওয়া তিন কর্মকর্তা ছাড়া আরও কয়েকজন কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন৷ র‌্যাব সদস্যদের জড়িত থাকার ব্যাপারে দুজন প্রত্যক্ষ সাক্ষীও ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত পুলিশ সাতজন প্রত্যক্ষদর্শীর খোঁজ পেয়েছে। তাঁদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা শহিদুল ইসলাম ও তাঁর কলেজপড়ুয়া মেয়ে রাবেয়া আক্তার ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন৷ তাঁরা আদালতে বলেন, তাঁদের চোখের সামনেই র‌্যাব কয়েকজনকে জোর করে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়৷ তবে যাদের তুলে নেওয়া হয়েছে, তাদের কাউকেই তারা চেনেন না। তুলে নেওয়ার সময় একজনের ঘাড়ে পিস্তল নিয়ে আঘাত করতে দেখেন। যাকে আঘাত করা হচ্ছিল তার মুখে দাড়ি ছিল। আর যিনি আঘাত করছিলেন, তিনি সাদা গেঞ্জি ও সাদা রঙের প্যান্ট পরা ছিলেন৷ ঘটনার সময় একটি হাইয়েস মাইক্রোবাস, দুটি র‌্যাবের পিকআপ ও দুই কার ওই স্থানে ছিল বলে তাঁরা সাক্ষ্যতে উল্লেখ করেন৷
সিআইডির প্রতিবেদনে পলাতক নূর হোসেনের ব্যাপারে বলা হয়, মামলার এজাহারভুক্ত প্রধান আসামি নূর হোসেনের বিরুদ্ধে ইন্টারপোল পরোয়ানা জারি করেছে৷ নূর হোসেনের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি জব্দ করা হয়েছে৷ তাঁর নিয়ন্ত্রণে থাকা মাদক ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়৷ নূর হোসেনসহ সব আসামির ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেন হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে৷

র‌্যাবের সাবেক কর্মকর্তা মেজর আরিফ ও তার দুই আত্মীয়ের ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। তিনটি বেসরকারি ব্যাংকের হিসাবে আরিফের অর্ধশত কোটির বেশি টাকা জমা রয়েছে। রাজধানীর মিরপুর ডিওএইচএস এবং মোহাম্মদপুরে দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের সন্ধানও পেয়েছে তদন্ত কর্মকর্তারা। সেনা কর্মকর্তার হিসাবে এত টাকার উৎস সম্পর্কে সন্তোষজনক জবাব দিতে পারছেন না মেজর আরিফ। বিলাসবহুল ফ্ল্যাট সম্পর্কেও কিছু বলছেন না। এ সংক্রান্ত প্রশ্ন বারবার এড়িয়ে যাচ্ছেন তিনি। নারায়ণগঞ্জে সাত অপহরণ ও খুনের মামলায় রিমান্ডে আছেন সাবেক এ সেনা কর্মকর্তা।
টাকার উৎস সম্পর্কে আরিফ নানা ধরনের কথা বলছেন। একবার বলেন, কয়েক মাস আগে কিছু জমি বিক্রি করেছি। সেখান থেকে পাওয়া মোটা অংকের টাকা ব্যাংকে রয়েছে। তবে কোন এলাকায় জমি বিক্রি করেছেন সে সম্পর্কে নিশ্চিত করে তিনি কিছু জানাতে পারেননি। গত বছরের আগস্ট এবং চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও মিরপুর ডিওএইচএস এলাকায় কেনা ফ্ল্যাটের ব্যাপারেও সন্তোষজনক কোনো জবাব দেননি সাবেক এই মেজর।
তদন্ত কর্মকর্তারা মনে করছেন, সাত খুনের ঘটনায় মোটা অংকের টাকা লেনদেনের যে অভিযোগ করা হচ্ছে তার বড় একটি অংশ মেজর আরিফের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে। ঘটনা প্রমাণে এটি বড় সহায়ক হিসেবেও কাজ করবে। এছাড়া মেজর আরিফের নামে কেনা দুটি ফ্ল্যাটের ব্যাপারেও তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গ্রামের বাড়িতে নামে-বেনামে কেনা সম্পত্তি সম্পর্কেও তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
তদন্ত কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে, ময়মনসিংহের গফরগাঁওয় পৌর শহরের ৯নং ওয়ার্ডের শিলাসীতে মেজর আরিফের গ্রামের বাড়ি। সেখানেও তার নামে-বেনামে রয়েছে বিশাল সম্পত্তি। শিলাসী গ্রামের রেল লাইনের পূর্ব পাশে রয়েছে তার বিলাসবহুল একটি বাড়ি। বাড়িটি দ্বিতীয় তলার নির্মাণ কাজ চলছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নির্মাণ শ্রমিক জানান, র‌্যাবের সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা আরিফ হোসেনের পূর্বের বাড়ি ছিল গাজীপুর জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলায়।
গফরগাঁও উপজেলার পৌর শহরের ৯নং ওয়ার্ডের শিলাসী গ্রাম তার নানার বাড়ি। ১/১১-এর সময় মেজর আরিফ যৌথবাহিনীর ইনচার্জ হিসেবে গাজীপুর জেলার দায়িত্বে ছিলেন। ১/১১-তে গাজীপুর জেলায় যৌথবাহিনীর ইনচার্জের দায়িত্ব পালনকালে বিশাল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন এই সেনা কর্মকর্তা। সম্প্রতি পৌর শহরের প্রাণকেন্দ্র কলেজ রোডের খায়রুল্লাহ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের বিপরীতে (ক্ষণিকা) সোহরাব হোসেনের কাছ থেকে ১ কোটি ৩৬ লাখ টাকায় ১৩ শতাংশ জমি কিনে আলোচনায় আসেন এই মেজর। চরশিলাসী মৌজায় মেজর আরিফ তার মা এবং ছোট ভাইয়ের নামেও কিনেছেন প্রায় কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি। এ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করেছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। পর্যায়ক্রমে আরিফকে তার সম্পত্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
এদিকে দুই দফা রিমান্ড শেষে ফের ৫ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে র‌্যাব-১১ এর আদমজী ক্যাম্পের সাবেক ইনচার্জ লে. কমান্ডার এমএম রানাকে। রিমান্ড শেষে সোমবার বিকালে তাকে নারায়ণগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কেএম মহিউদ্দিনের আদালতে হাজির করে ফের সাত দিনের রিমান্ড আবেদন জানায় মামলার তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ। শুনানি শেষে আদালত তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। আদালতে শুনানির সময় বরাবরের মতো র‌্যাব কর্মকর্তার পক্ষে কোনো আইনজীবী দাঁড়াননি। এ সময় আদালতে এমএম রানাকে কিছু বলার আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, নূর হোসেনকে তিনি কোনোদিনই চিনতেন না। অপহরণের স্থান তার দায়িত্বে থাকা এলাকার মধ্যে ছিল না দাবি করে এমএম রানা বলেন, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার।
চাঞ্চল্যকর এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ইন্সপেক্টর মামুন উর রশিদ যুগান্তরকে বলেছেন, সাবেক তিন র‌্যাব কর্মকর্তাকে রিমান্ডে এনে অব্যাহত জিজ্ঞাসাবাদে অনেক তথ্যই পাওয়া গেছে। তবে এদের কাছ থেকে মামলায় সহায়ক তথ্য আদায় করা কঠিন কাজ। তাদের কাছ থেকে পাওয়া গত কয়েক দিনের তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
এদিকে রিমান্ডে থাকা র‌্যাব-১১ এর সাবেক অপর দুই কর্মকর্তা লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ ও লে. কমান্ডার এমএম রানা ঘটনার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করলেও হত্যাকাণ্ডের সব দায় চাপাচ্ছেন মেজর আরিফের ওপর। তারা তদন্ত কর্মকর্তাদের বারবার বলেছেন, এ ব্যাপারে মেজর আরিফ সব কিছু জানেন। আর মেজর আরিফ বলছেন, ‘আমি অর্ডার ফলো করেছি মাত্র।’ তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রটি আরও বলেছে, মেজর আরিফের সঙ্গে নূর হোসেনের ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ তাদের হাতে রয়েছে। আরিফ নিজে একজন মাদকাসক্ত ছিলেন, তিনি নিয়মিত ইয়াবা সেবন করতেন। নূর হোসেন প্রতিদিনই লোক মারফত তার কাছে ইয়াবা পৌঁছে দিতেন। ওই সূত্র জানিয়েছে, মেজর আরিফ জিজ্ঞাসাবাদেও একটি পর্যায়ে মাদক সেবনের বিষয়টি তদন্ত দলের কাছে স্বীকার করেছেন। এছাড়া কাঁচপুর ব্রিজের নিচে বিআইডব্লিউটিএ’র ডাম্পিং স্টেশনে নূর হোসেনের রংমহলে প্রায় প্রতি রাতেই যেতেন মেজর আরিফ। গভীর রাত পর্যন্ত তিনি ওই রংমহলেই কাটাতেন। নূর হোসেনের কাছ থেকে প্রতি মাসে মোটা অংকের মাসোহারা নেয়ার তথ্য-প্রমাণও এখন তদন্ত কর্মকর্তাদের হাতে রয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট অপর একটি সূত্র বলেছে, গত কয়েক দিনে তারা চাঞ্চল্যকর বেশ কিছু তথ্য পেয়েছেন। এর মধ্যে হত্যার পর লাশগুলো নদীতে ফেলার জন্য কাঁচপুর ব্রিজের নিচে শান বাঁধানো ঘাট দিয়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় উঠানো হয় বলে তারা জানতে পেরেছেন। ওই রাতে ঘাটের আশপাশে থাকা প্রত্যক্ষদর্শী দু’জনের বক্তব্যে এমন তথ্য পেয়েছে তদন্ত কর্তৃপক্ষ। প্রত্যক্ষদর্শী ওই দুই ব্যক্তি পুলিশকে বলেছেন, ২৭ এপ্রিল রাত দেড়টার দিকে তারা কয়েকজন লোককে ইঞ্জিনচালিত একটি নৌকায় কিছু বস্তা উঠাতে দেখেছেন। ছোট্ট একটি পিকআপ ভ্যানে করে ওই বস্তাগুলো ঘাটে আনা হয়েছিল। তবে ওই বস্তায় কি ছিল তা তারা জানেন না।
২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে র‌্যাব সদস্য পরিচয়ে তুলে নেয়া হয় নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে। ৩০ এপ্রিল ও ১ মে ইটের বস্তা দিয়ে বাঁধা তাদের লাশ ভেসে ওঠে শীতলক্ষ্যা নদীতে। লোমহর্ষক এ ঘটনার পর র‌্যাব-১১ এর কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, একই ব্যাটালিয়নের দ্বিতীয় অধিনায়ক মেজর আরিফ হোসেন এবং সিদ্ধিরগঞ্জ ক্যাম্প কমান্ডার নৌবাহিনীর লে. কমান্ডার এমএম রানার দিকে অভিযোগের আঙুল তোলেন নিহত নজরুল ইসলামের শ্বশুর।
৬ কোটি টাকার বিনিময়ে র‌্যাবের ওই কর্মকর্তারা নজরুলসহ সাতজনকে অপহরণের পর হত্যা করেছে বলে অভিযোগ করা হয়। এরপর ওই তিন কর্মকর্তাকে প্রথম নিজ-নিজ বাহিনীতে ফেরত নেয়া হয়। পরে দুই সেনা কর্মকর্তাকে অকালীন অবসর এবং নৌ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। হাইকোর্টে একটি রিট পিটশনের পর আদালত আলোচিত এ মামলায় তিনজনকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। – See more at: http://www.jugantor.com/first-page/2014/06/03/106997#sthash.jiaiM2RG.dpuf