• বৃহস্পতিবার , ২ মে ২০২৪

বিমানের ব্রিটিশ এমডি কাইল হেউডের বিরুদ্ধে অবৈধ বানিজ্যে নিয়ে তোলপাড়


প্রকাশিত: ২:০৪ পিএম, ২৩ আগস্ট ১৫ , রোববার

নিউজটি পড়া হয়েছে ১১১ বার

biman md-www.jatirkhantha.com.bdএস রহমান.ঢাকা:   বিমানের ব্রিটিশ এমডি কাইল হেউডের বিরুদ্ধে অবৈধ বানিজ্যে নিয়ে তোলপাড় চলছে।বিমানকে লাভের মুখ দেখানোর প্রত্যয় নিয়ে যোগদান করা এই কর্মকর্তা এখন নিজেই দুর্নীতিতে নিমজ্জিত।নানা অভিযোগ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত এই বিদেশী এমডি।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ বিমানের ব্রিটিশ এমডি কাইল হেউডের বিরুদ্ধে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে টাকা নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। একই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে ছুটি ছাড়া বিদেশ ভ্রমণ ও গত সাত মাসে ৫০ দিনের বেশি বিদেশে থাকার অভিযোগ উঠেছে। খোদ বিমানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অভিযোগ, বিমানকে লাভজনক, দুর্নীতিমুক্ত, ফ্লাইট অনটাইম, রুট সম্প্রসারণ করাসহ কোনো কিছুর প্রতিই কাইলের কোনো আগ্রহ নেই।
আসন ফাঁকা অবস্থায় ফ্লাইট ছাড়ার বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনাও গত ৭ মাসে বাস্তবায়ন করতে পারেননি কাইল। উল্টো যোগদান করেই বিমানের বহুল পরিচিত ঢাকা-রোম-ফ্রাঙ্কফুর্ট রুট বন্ধ করে দেন। লন্ডন রুটে প্রতি ফ্লাইটে গড়ে ৫০ থেকে ১০০ আসন খালি যাচ্ছে। বিজনেস ক্লাসের অধিকাংশ টিকিট বিক্রি না করে সেগুলো বিভিন্ন মানুষের কাছে আপডেট করে দিচ্ছেন। যার কারণে ২৫০ কোটি টাকা লাভ নিয়ে কাইল বিমানে যোগদান করলেও গত সাত মাসে সেই লাভের অংক  পৌঁছেছে ১৫৫ কোটির ঘরে । প্রতিটি শাখায় বাসা বেঁধেছে দুর্নীতি, অনিয়ম আর লুটপাট। মন্ত্রণালয় কাইলের বিরুদ্ধে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানোর অভিযোগ তদন্ত করবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও সিইও হিসেবে ব্রিটিশ নাগরিক কাইল হেউড গত জানুয়ারি মাসে যোগদান করেন। অভিযোগ রয়েছে, যোগদানের পর থেকে এ পর্যন্ত তিনি ৯২ লাখ ৩৭ হাজার টাকা বেতন হিসেবে উত্তোলন করেছেন বিমান থেকে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছাড়াই পুরো টাকা তিনি নিয়েছেন নগদে। আর এর বড় অংশই তিনি গোপনে লন্ডনে পাঠিয়েছেন অবৈধ পথে। বিমানের ফিন্যান্স শাখার একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, কাইলের মা দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি থাকায় তিনি টাকা পাঠানোর এ অবৈধ পন্থা বেছে নেন। কঠোর নিয়ম-কানুন থাকায় কোনো টাকাই তিনি ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠাননি। এমনকি নিয়োগ পাওয়ার ৭ মাস পর চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। বিনিয়োগ বোর্ড বলছে, যে কোনো বিদেশী নাগরিকের অবশ্যই ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে হবে। এর বাইরে টাকা পাঠালে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। একই কথা বলছে বাংলাদেশ ব্যাংকও। প্রতিষ্ঠানটির মতে, ব্যাংকের বাইরে কেউ টাকা পাঠালে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রশাসন শাখার একজন কর্মকর্তা জানান, বিমানে যোগদানের পর থেকেই কাইল দেশের কোনো নিয়মনীতি মানছেন না। বিমানের নীতিমালারও তোয়াক্কা করছেন না। নিয়ম অনুযায়ী তাকে দেশের বাইরে যেতে হলে বাধ্যতামূলকভাবে বিমান পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন নিতে হবে। কিন্তু বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই, এমনকি কাউকে দায়িত্ব বুঝিয়ে না দিয়েই তিনি দিনের পর দিন বিদেশে অবস্থান করছেন। সূত্র জানিয়েছে, গত ৬ আগস্ট অনুমোদন ছাড়াই কাইল বিদেশে যান এবং ৯ আগস্ট পর্যন্ত অবৈধভাবে বিদেশে অবস্থান করেন। এ সময় তিনি কোনো কারণ ছাড়াই দুবাই, দাম্মাম ও বাহরাইনে অবস্থান করেন। যদিও যাওয়ার সময় তিনি তার ব্যক্তিগত স্টাফকে লন্ডনে যাচ্ছেন বলে জানিয়ে যান। গত ১৬ আগস্ট থেকে হজ ফ্লাইট চলাকালীন এমডিসহ বিমানের সব কর্মকর্তাকে দেশে অবস্থানের জন্য মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশ দিলেও কাইল সেটা মানেননি। হজ ফ্লাইট উদ্বোধনের আগেই তিনি লন্ডন পাড়ি জমান। ৩ দিনের ছুটি নিয়ে গেলেও শুক্রবার পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশে ফেরেননি বলে জানা গেছে। এতে হজ ফ্লাইট নিয়ে নানা ভোগান্তির মুখে পড়তে হয়েছে বিমানকে।
জানা গেছে, চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি বিমানের এমডি হিসেবে কাইল হেউডের ওয়ার্ক পারমিট অনুমোদন করে বিনিয়োগ বোর্ড। এক বছরে তার বেতন অনুমোদন করা হয়েছে ২ লাখ ৬ হাজার ২১৭ ডলার। প্রতি ডলার ৭৮ টাকা হিসাবে স্থানীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ ১ কোটি ৬০ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। এ হিসাবে প্রতি মাসে তার বেতন দাঁড়ায় ১৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা। আর এই বেতনের ৭৫ শতাংশ অর্থাৎ প্রতি মাসে ১০ লাখ ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত তিনি দেশে পাঠাতে পারেন। নিয়োগের সময় দেশের প্রচলিত বিধান অনুসারে আয়কর প্রদান এবং ফরেন এক্সচেঞ্জ আইনসহ দেশের বিদ্যমান সব ধরনের আইন মেনে চলার শর্ত দেয়া হয়।
বিমান সূত্র জানায়, নিয়োগ পাওয়ার পর প্রত্যেক মাসে দুই কিস্তিতে তিনি টাকা নিয়েছেন বিমান থেকে। জানুয়ারির ২৬ তারিখ তিনি প্রথম বেতন নিয়েছেন। এ দিন প্রথম কিস্তিতে নগদে ৮ লাখ টাকা এবং দ্বিতীয় কিস্তিতে ৩ লাখ ৭৬ হাজার টাকা নেন। পরবর্তী ৬ মাসেও প্রথম কিস্তিতে ৮ লাখ টাকা এবং দ্বিতীয় কিস্তিতে ৩ লাখ ৭৬ হাজার থেকে সাড়ে ৫ লাখ টাকা করে উত্তোলন করেন। সব মিলিয়ে ৭ মাসে ৯২ লাখ ৩৭ হাজার ৫৪৭ টাকা নিয়েছেন। আর সব টাকাই নিয়েছেন নগদে। এর বড় অংশই বিমানের একজন প্রভাবশালী জেনারেল ম্যানেজার এবং জেদ্দা অফিসের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার সহযোগিতায় হুন্ডির মাধ্যমে লন্ডনে পাঠিয়েছেন। এ ছাড়া ৭ মাস চাকরির পর আগস্টের প্রথম সপ্তাহে তিনি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। বিষয়টি নিয়ে বিমানের কর্মকর্তাদের মধ্যে সমালোচনা রয়েছে। ফলে ধারণা করা হচ্ছে, কাইল নিজেকে বাঁচাতে শেষ পর্যন্ত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। কিন্তু ফরেন এক্সচেঞ্জ আইন ১৯৪৭ সালের ১৮-এ ধারা অনুসারে কোনো বিদেশী নাগরিকের নিয়োগ, টাকা স্থানান্তর সবকিছু হতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংক অথবা সরকারের প্রণীত নীতিমালার মাধ্যমে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ম. মাহফুজুর রহমান বলেন, বিদেশীদের টাকা পাঠাতে হলে বিনিয়োগ বোর্ড যেভাবে অনুমোদন দেয়, সেভাবে পাঠাতে হবে। তবে অবশ্যই তা ব্যাংকিং চ্যানেলে হতে হবে। এর বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তিনি আরও বলেন, হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানো অবশ্যই অপরাধ। কেউ যদি বেতনের সব টাকা খরচ করে তাতে কোনো আপত্তি নেই।
জানতে চাইলে বিনিয়োগ বোর্ডের সদস্য নাভাস চন্দ্র মণ্ডল বলেন, বিদেশী নাগরিকের বেতন এবং অন্যান্য সুবিধা নির্ধারণের দায়িত্ব বিনিয়োগ বোর্ডের। নিয়ম অনুসারে বিদেশী নাগরিক তার বেতনের সর্বোচ্চ ৭৫ শতাংশ বিদেশে নিতে পারেন। এ ছাড়া মেয়াদ শেষে তার সঞ্চয়, অবসর ভাতা, গ্র্যাচুইটির টাকা নিতে পারেন। তবে যে কোনো লেনদেন হতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে। তার মতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের বাইরে কোনোভাবেই বিদেশে টাকা নেয়ার সুযোগ নেই। এ ছাড়া কোম্পানির পক্ষ থেকে প্রতি তিন মাস পরপর আয়করের হালনাগাদ রিপোর্ট বিনিয়োগ বোর্ডে দাখিল করতে হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানো অবৈধ। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে তা অপরাধ। এটি গ্রহণযোগ্য নয়। কেউ এ ধরনের কাজ করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
এদিকে এ প্রসঙ্গে বিমানের কোনো পর্যায়ের কর্মকর্তাই মুখ খুলতে রাজি হননি। তবে মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, বিষয়টি তাদের গোচরে এসেছে। শিগগিরই এ বিষয়ে তদন্ত করা হবে। তদন্তে কাইলের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। একই সঙ্গে এ ঘটনায় বিমানের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী সংশ্লিষ্ট থাকলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।