• মঙ্গলবার , ৭ মে ২০২৪

বাংলাদেশের দুর্নীতির টাকা যেভাবে জমছে সুইস ব্যাংকে


প্রকাশিত: ৪:৩৩ এএম, ১ জুলাই ১৬ , শুক্রবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৫৬ বার

দিনা করিম   :   ব্যাপক সমালোচনার মুখে ২০০২ সাল থেকে দেশভিত্তিক আমানতকারীদের তথ্য 1প্রচার শুরু করেছে সুইস ব্যাংক। যেসব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি রয়েছে, সেসব দেশের ব্যক্তিগত পর্যায়ে তথ্য দেয়া হয়। যে কারণে সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশীদের আমানত কমেছে। তবে সুযোগ থাকলেও সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে এখন পর্যন্ত কোনো সমঝোতা চুক্তি করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে বাংলাদেশীরা এখনও সুইজারল্যান্ডকেই পাচার করা টাকা রাখার নিরাপদ স্থান মনে করে।

সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে (সুইস ব্যাংক) এক বছরে বাংলাদেশী সঞ্চয় ১০ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৫ সালে বাংলাদেশীদের সঞ্চয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৫ কোটি ৮ লাখ সুইস ফ্রাঁ। প্রতি সুইস ফ্রাঁ ৮৮ টাকা হিসেবে স্থানীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ৪ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা। ২০১৪ সালে তা ছিল ৫০ কোটি ৬০ লাখ ফ্রাঁ বা ৪ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা।

এ হিসেবে এক বছরে বেড়েছে ৩৯৫ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তান এবং ভারতের পরেই রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান। বৃহস্পতিবার সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। তবে কোনো বাংলাদেশী তার নাগরিকত্ব গোপন রেখে টাকা জমা করে থাকলে তার হিসাব বা তথ্য এই প্রতিবেদনে নেই। এছাড়া স্বর্ণালংকার, শিল্পকর্ম এবং অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র জমা রাখলে তার আর্থিক মূল্যমান হিসাব করে আমানতে যোগ হয় না।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিনিয়োগ না হওয়ায় পুঁজি পাচার হচ্ছে। আলোচ্য সময়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের আমানত কমেছে। ২০১৫ সালে মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৩ হাজার কোটি ফ্রাঁ। আগের বছর যা ছিল ১ লাখ ৩৮ হাজার কোটি ফ্রাঁ। আমানত রাখার ক্ষেত্রে এ বছরও প্রথম অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাজ্য।

এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বৃহস্পতিবার বলেন, বিষয়টি গভীর উদ্বেগজনক। কারণ সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের যে টাকা রাখা হয়েছে, সেটা মূলত দুর্নীতির। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের মূল কারণ তিনটি। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে দুর্নীতি। দুর্নীতি বেড়েছে বলে পাচারও বেড়েছে। এছাড়া দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার কারণেও অর্থ পাচার বাড়ছে। তার মতে, অর্থ পাচার রোধ করতে হলে দুর্নীতি কমিয়ে আনার বিকল্প নেই। পাশাপাশি বিনিয়োগের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। নাগরিক জীবনেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি।

গত ১২ বছরের মধ্যে ২০১৫ সালেই সবচেয়ে বেশি আমানত হয়েছে সুইস ব্যাংকে। ইতিপূর্বে ২০১৩ সালে আমানত ছিল ৩৭ কোটি ২০ লাখ ফ্রাঁ। স্থানীয় মুদ্রায় ৩ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা। ২০১২ সালে ছিল ২২ কোটি ৯০ লাখ ফ্রাঁ। ২০১১ সালে ছিল ১৫ কোটি ২০ লাখ ফ্রাঁ। ধারাবাহিক হিসেবে ২০০২ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের আমানত ছিল ৩ কোটি ১০ লাখ ফ্রাঁ, ২০০৩ সালে ২ কোটি ৫৫ লাখ, ২০০৪ সালে ৪ কোটি ১০ লাখ, ২০০৫ সালে ৯ কোটি ৭০ লাখ, ২০০৬ সালে ১২ কোটি ৪০ লাখ, ২০০৭ সালে ২৪ কোটি ৩০ লাখ, ২০০৮ সালে ১০ কোটি ৭০ লাখ, ২০০৯ সালে ১৪ কোটি ৯০ লাখ এবং ২০১০ সালে ২৩ কোটি ৬০ লাখ ফ্রাঁ রয়েছে।

এশিয়ার অন্যান্য দেশের আমানত : এশিয়ার অন্যান্য দেশের মধ্যে চীনের আমানত ৮১০ কোটি ফ্রাঁ, মালয়েশিয়া ৩৩৬ কোটি, থাইল্যান্ড ৩০৫ কোটি, দক্ষিণ কোরিয়ার ২৭৬ কোটি, ভারতের ১৭৭ কোটি ফ্রাঁ, পাকিস্তান ১২৩ কোটি, শ্রীলংকা ৮ কোটি ২০ লাখ, নেপালের ১০ কোটি ২০ লাখ, মিয়ানমারের ৬ কোটি, মালদ্বীপের ১ কোটি ৭০ লাখ এবং আফগানিস্তানের ১ কোটি ৪০ লাখ ফ্রাঁ রয়েছে।
প্রতিবেদন অনুসারে আলোচ্য সময়ে বিশ্বের সবগুলো দেশের আমানত কমেছে। ২০১৫ সালে সুইস ব্যাংকে বিদেশীদের মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৩ হাজার কোটি ফ্রাঁ। ২০১৪ সালে এটি ছিল ১ লাখ ৩৮ হাজার কোটি ফ্রাঁ। অর্থাৎ মোট আমানত কমেছে ৫ হাজার কোটি ফ্রাঁ। ২০১৩ সালে ছিল ১ লাখ ২৩ হাজার কোটি, ২০১২ সালে ১ লাখ ২৯ হাজার কোটি ফ্রাঁ। এছাড়া ২০১১ সালে ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি, ২০১০ সালে ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি এবং ২০০৯ সালে ছিল ১ হাজার ৩৩ হাজার কোটি ফ্রাঁ।

সুইস ব্যাংকে আমানতের দিক থেকে ২০১৫ সালেও শীর্ষে ছিল যুক্তরাজ্য। দেশটির মোট আমানতের পরিমাণ ৩২ হাজার ১৫৫ কোটি ফ্রাঁ। দ্বিতীয় অবস্থানে যুক্তরাষ্ট্রের ১৯ হাজার ৫৭৫ কোটি, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৯ হাজার ২০৬ কোটি ফ্রাঁ। এরপর জার্মানি ৫ হাজার ১৪৩ কোটি, হংকং ৩ হাজার ৩৪৭ কোটি, পানামা ২ হাজার ৮৫৯ কোটি এবং সিঙ্গাপুরের সঞ্চয় ২ হাজার ৪১০ কোটি ফ্রাঁ।

মালয়েশিয়ান সরকারের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বিনিয়োগে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। চীন প্রথম অবস্থানে। এগুলো সবই হয়েছে টাকা পাচারের মাধ্যমে। নিয়ম অনুযায়ী কোনো নাগরিকের বিদেশে টাকা নিতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিতে হয়। তবে বিদেশে যারা আয় করেন তাদের সুইস ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে বাংলাদেশের আইনে কোনো সমস্যা নেই। আর তিনি আয়করের আওতায় এবং প্রবাসী কোটায় কোনো সুবিধা নিয়ে থাকলে বিদেশে সম্পদ থাকার তথ্যও তার আয়কর রিটার্নে উল্লেখ করতে হবে। এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোনো নাগরিক বিদেশে টাকা রাখলে তা দেশ থেকে পাচার বলে গণ্য হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত কাউকে বিদেশে টাকা জমা রাখার অনুমোদন দেয়া হয়নি। কোনো প্রবাসীও সরকারকে জানাননি যে তিনি সুইস ব্যাংকে টাকা জমা রেখেছেন। ফলে সুইস ব্যাংকে জমা পুরো টাকাটাই দেশ থেকে পাচার হয়েছে বলে গণ্য হবে। এর আগেও আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের ঘটনা উঠে এসেছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে কেউ কথা বলতে রাজি হননি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বৃহস্পতিবার বলেন, গত কয়েক বছর পর্যন্ত টাকা পাচার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এর কারণ হল দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ নেই। ফলে বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে। বিনিয়োগে স্থবিরতার পরও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি ব্যয় বেড়েছে। এটি অস্বাভাবিক। এর অর্থ হল ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা পাচার হয়েছে।

সুদীর্ঘ সময় ধরে ধনীদের অর্থ গোপনে জমা রাখার জন্য খ্যাত সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলো। ৮০ লাখ মানুষের এ দেশটিতে ব্যাংক আছে ২৬৬টি। বিশ্বের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা অর্থ পাচার করে ওইসব ব্যাংকে জমা রাখে। ব্যাংকগুলোও কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করে। আগে সুইস ব্যাংকে জমা টাকার কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করা হতো না। এমনকি আমানতকারীর নাম-ঠিকানাও গোপন রাখা হতো। একটি কোড নম্বরের ভিত্তিতে টাকা জমা রাখা হতো। কিন্তু ২০০২ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী টাকা পাচার রোধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ব্যাপকভাবে কার্যকর করা হয়। এরপর আন্তর্জাতিক চাপে সুইস ব্যাংক জমা টাকার তথ্য প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে তারা ওই সময় থেকে বিভিন্ন দেশের জমা টাকার তথ্য প্রকাশ করছে। ওই প্রতিবেদনে কোন দেশের নাগরিকদের মোট কত টাকা জমা আছে সে তথ্য তারা প্রকাশ করছে। তবে আমানতকারীদের নাম-ঠিকানা প্রকাশ করছে না। ফলে পাচারকারীদের ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না।

অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারে সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মধ্যে ভারসাম্যহীনতায় পুঁজি পাচার হয়। এ হিসেবে দেখা গেছে, দেশে সঞ্চয় বাড়ছে, কিন্তু বিনিয়োগ বাড়ছে না। ওই টাকা দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে। নানাভাবে টাকা পাচার হচ্ছে। পণ্য আমদানির নামে ঋণপত্রের মাধ্যমে। কম দামে কম পণ্য এনে দেনা শোধ করা হচ্ছে বেশি দাম ও বেশি পণ্য দেখিয়ে। রফতানি পণ্যের একটি অংশের মূল্য দেশে আসছে না। ওই টাকাও পাচার হয়ে যাচ্ছে। দেশ থেকে হুণ্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। নগদ ডলার বা স্বর্ণের মাধ্যমেও দেশ থেকে টাকা চলে যাচ্ছে। এছাড়া চিকিৎসা ব্যয়, বিদেশ ভ্রমণ, লেখাপড়ার খরচ- এসব মাধ্যমেও টাকা পাচার হচ্ছে। সীমান্ত এলাকা দিয়ে চোরাচালানের মাধ্যমেও টাকা পাচার হয়।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোব্যাল ফাইনান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৪ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে, যা দেশের মোট জাতীয় বাজেটের দেড়গুণ। প্রতি বছর গড়ে পাচার হয়েছে ৪৪ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। প্রতি বছরই এই হার বাড়ছে। এর মধ্যে কেবল ২০১৩ সালেই পাচার হয়েছে ৭৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা, যা আগের বছরের চেয়ে ৩৪ শতাংশ বেশি। অর্থ পাচারে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান।

সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) হল সুইজারল্যান্ড সরকারের স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিশেষ আইন দ্বারা পরিচালিত এই ব্যাংকটি এর নীতিনির্ধারণে সম্পূর্ণ স্বাধীন। ২০০ বছরের পুরনো ইউরোপের এ প্রতিষ্ঠানটি মুদ্রা পাচারকারীদের নিরাপদ স্বর্গ। ১৮৯১ সালে সুইজারল্যান্ড সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত একটি ধারার অধীনে ১৯০৭ সালে প্রতিষ্ঠানটি স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে। এরপর থেকে ব্যাংকটির মুদ্রানীতি এবং সুশৃংখল কার্যক্রম বিশ্বের উন্নত দেশগুলো অনুসরণ করে। তবে পাচারকারীদের আশ্রয়দাতা হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে তাদের পরিচিতি রয়েছে।

ব্যাপক সমালোচনার মুখে ২০০২ সাল থেকে দেশভিত্তিক আমানতকারীদের তথ্য প্রচার শুরু করেছে তারা। যেসব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি রয়েছে, সেসব দেশের ব্যক্তিগত পর্যায়ে তথ্য দেয়া হয়। যে কারণে সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশীদের আমানত কমেছে। তবে সুযোগ থাকলেও সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে এখন পর্যন্ত কোনো সমঝোতা চুক্তি করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে বাংলাদেশীরা এখনও সুইজারল্যান্ডকেই পাচার করা টাকা রাখার নিরাপদ স্থান মনে করে।