• বৃহস্পতিবার , ২ মে ২০২৪

পাকা তেল চোর-বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী পাইপলাইনের তেল চুরি


প্রকাশিত: ১১:৫২ পিএম, ২৫ নভেম্বর ২৩ , শনিবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৩৪ বার

বিশেষ প্রতিনিধি/ চিরির বন্দর প্রতিনিধি : একেই বলে পাকা তেল চোর! যে কিনা বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী পাইপলাইন কেটে সেখান থেকে তেল চুরি করেছে। কিন্তু বিধি বাম, ধরা পড়েছে বিশেষ সংকেতের কারণে। তেল চোর চক্রের রাঘববোয়াল ধরা না পড়লেও চক্রের ৪ সহযোগীকে ধরেছে পুলিশ। চিরিরবন্দর থানার ওসি বজলুর রশিদ দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেন, এই পাইপলাইনটি যেখানে ছিদ্র করে তেল বের করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তা অতি সুক্ষ্মভাবে করেছে

তেল চোররা। প্রথমে ওরা ব্যর্থ হলেও পাশের স্থানে কেটে সফল হয়। একটি স্থান খুড়ে তেল বের করার চেষ্টা করেছিল চোরেরা। কিন্তু সেটা সফল হয়নি। পরে এই স্থানটিতে মাটি খুড়ে তারা এই যন্ত্রাংশ স্থাপন করে। যে যন্ত্রাংশ স্থাপন করা হয়েছে তা সবই স্থানীয়ভাবে তৈরি।ওই পাইপে যেসব যন্ত্রাংশ স্থাপন করা হয়েছে তা সবগুলোই স্থানীয়ভাবে তৈরি এবং পুঙ্খানুপুঙ্খুভাবে সেট করা হয়েছিল। ফলে ধরেই নেওয়া যায় যে, অতি পাকা চোর এবং দক্ষ তেল চোর।

বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী পাইপলাইন এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছে, যাতে করে পাইপের কোনও অংশে ত্রুটি দেখা দিলে কিংবা লিকেজ হলে তাৎক্ষণিকভাবে স্বয়ংক্রিয় বার্তা পৌঁছে যাবে দুই দেশের মনিটরে। সেইসঙ্গে কোন স্থানে ত্রুটি বা লিকেজ হয়েছে; তার সম্ভাব্য স্থানটিকেও চিহ্নিত করবে সেন্সর ও মনিটর। অথচ এই পাইপলাইনেই ‘বুদ্ধি খাটিয়ে’ তেল চুরির দুঃসাহসী পরিকল্পনা করেছে একটি চক্র। বিষয়টি দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার মাধ্যমে ঘটানো হয়েছে। এ বিষয়ে ‘দক্ষ কারও’ মাধ্যমেই এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে বলে ধারণা করছে পুলিশ। এ ঘটনায় এরই মধ্যে চার জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, জড়িত অন্যান্যদের শনাক্ত করতে চলছে অভিযান।

শনিবার (২৫ নভেম্বর) পাইপলাইনে তেল চুরি করতে পরিকল্পিত স্থান দিনাজপুর চিরিরবন্দর উপজেলার ৩ নম্বর ফতেজংপুর ইউনিয়নের চক ইসবপুর ফেরুশাডাঙ্গা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পাইপলাইন ছিদ্র করে স্থানীয়ভাবে তৈরি কিছু যন্ত্রাংশ দিয়ে এই তেল চুরির পরিকল্পনা করা হয়েছে। সেসব যন্ত্রাংশ খুলে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এসব যন্ত্রাংশের মধ্যে আছে লোহা, টিনের মোটা পাত, নাট-বল্টু ও হাতলের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা অন-অফ সুইচ বা কল।

ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের উপরে সেন্সর কার্যক্রমের জন্য বিভিন্ন উপকরণ রয়েছে, রয়েছে রাবার ও প্লাস্টিকের প্রলেপ। সেগুলোকে ভেদ করে পাইপ ছিদ্র করে সেখানে অন্য একটি সুইচ বা কল স্থাপন করা সাধারণ কোনও চোরের পক্ষে সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, অতি সাবধানতার সঙ্গে সেখানে কাজ করছেন ভারতের দুই বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী সৌমেন ভট্টাচার্য ও শুভঙ্কর জানা। পাশাপাশি সেখানে কাজ করছেন পাইপলাইনে তেল সরবরাহের বাংলাদেশ অংশের ইনচার্জ প্রবীর হীরাসহ বাংলাদেশের কয়েকজন প্রকৌশলী। উপস্থিত ছিলেন, বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী পাইপ লাইনের প্রকল্প পরিচালক টিপু সুলতান, চিরিরবন্দর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা একেএম শরীফুল হক, চিরিরবন্দর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রুলান্ট চাকমাসহ সংশ্লিষ্টরা।

উপস্থিত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই ছিদ্র করার ফলে এরই মধ্যে বেশ কিছু তেল নষ্ট হয়েছে। মাটির সঙ্গে মিশে থাকা প্রায় ১০০ লিটার তেল উদ্ধারও করা হয়েছে। এখন ছিদ্র করা ওই পাইপটিকে মেরামত করে ভারত থেকে আনা একটি বাড়তি যন্ত্রাংশ স্থাপন করা হবে; যাতে করে ওই অংশে ভবিষ্যতে আর কোন সমস্যা না হয়।

এই ঘটনায় পাঁচ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও কয়েকজনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে বলেও জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি জানান, এ ঘটনায় ইতোমধ্যে চার জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং তাদের ৫ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করা হয়েছে। আমরা তদন্ত করছি, যারা প্রকৃত অপরাধী তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।

এই পাইপলাইন চুরির ঘটনা সাধারণ চোরেরা করেনি, দক্ষরাই করেছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘যাদের এই পাইপলাইনের বিষয়ে জ্ঞান ও দক্ষতা রয়েছে। যাদের আসামি করা হয়েছে বা গ্রেফতার করা হয়েছে; তাদের বাইরেও অনেকেই থাকবে এটাই স্বাভাবিক। দক্ষতার সঙ্গে এই চুরির পরিকল্পনাকারীদের প্রত্যেককেই আইনের আওতায় আনা হবে। তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’

পাইপলাইনে তেল সরবরাহের বাংলাদেশ অংশের ইনচার্জ প্রবীর হীরা বলেন, ‘আমরা যখন মনিটরে সংকেত পাই যে, বাংলাদেশের ১১৭ কিলোমিটারের কাছাকাছি অংশ দিয়ে তেল বের হচ্ছে, তখনই বিষয়টি জাহাঙ্গীর নামের একজনকে পাঠানো হয়। তিনি সেখানে গিয়ে মাটি খোড়ার বিষয়টি প্রত্যক্ষ করেন এবং তেলের গন্ধ পান। পরে আমরা বিষয়টি পুলিশকে অবহিত করি এবং ঘটনাস্থলটি খুড়ে দেখতে পাই তেল চুরির কার্যক্রম। ওই স্থান থেকে কিছু মাটিতে মিশ্রিত তেল উদ্ধার করা হয়েছে। কতটুকু তেল চুরি হয়েছে, এটা সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে ধারণা করা হচ্ছে তেমন কোনও তেল চুরি যায়নি।’

পাইপলাইনের প্রকল্প পরিচালক টিপু সুলতান জানান, ‘বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। সেখান থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হতে পারে। চেয়ারম্যান মহোদয়ের অনুমতি ছাড়া কিছু বলা যাবে না। সরকারিভাবে তেমন কোনও ক্ষতি হয়নি। উন্নত প্রযুক্তির কারণে সহজেই ধরা পড়ে গেছে।
এ বিষয়ে ভারতীয় প্রকৌশলী সৌমেন ভট্টাচার্য জানান, আমরা শুক্রবারই ঘটনাস্থলে এসেছি। ভারত থেকে মালামাল নিয়ে এসে পাইপলাইনটি মেরামতের কাজ চলছে।এতে করে কী পরিমাণে অর্থ ব্যয় হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে ধারণা নেই। কারণ এসব মালামাল ভারত ও বাংলাদেশের মন্ত্রণালয় থেকে ক্রয় করা।’

এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলা সূত্রে জানা যায়, গত শুক্রবার সকালে ভারতের শিলিগুড়িস্থ নুমালীগড় রিফাইনারি লিমিটেডে কর্মরতরা সেন্সরের মাধ্যমে বুঝতে পারেন বাংলাদেশ অংশে পাইপ লিকেজ হয়েছে। পরে বাংলাদেশের পার্বতীপুর অয়েল হেড ডিপোতে বিষয়টি জানালে সেন্সরে নির্দেশিত অংশে পাইপ লাইন চেক করেন। এ সময় দিনাজপুর চিরিরবন্দর উপজেলার ৩নং ফতেজংপুর ইউনিয়নের চক ইসবপুর ফেরুশাডাঙ্গা এলাকায় দেখতে পান মাটি ভেজা। বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশকে অবহিত করা হলে তারা উপস্থিত হয় এবং তাদের উপস্থিতিতে লাইনম্যানরা মাটি খুঁড়ে দেখতে পান তেলের পাইপ ছিদ্র করা এবং ছিদ্রটি ক্লিপ দিয়ে বন্ধ করা। মাটির ৬ ফুট নিচে মূল পাইপলাইন ফুটো করে তাতে স্ক্রু লাগিয়ে বিশেষ কায়দায় অন্য একটি চিকন পাইপ লাগিয়ে তেল চুরি হচ্ছিল।

এই ঘটনায় চিরিরবন্দর উপজেলার উত্তর ভবানীপুর (ডাঙ্গারহাট) গ্রামের আলী উদ্দিনের ছেলে জাহাঙ্গীর আলম (২৭), পার্বতীপুর উপজেলার সোনাপুকুর গ্রামের মাজুম আলীর ছেলে মানিক শাহ (৪৫), নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর উপজেলার সাশকান্দর গ্রামের মৃত তাবির উদ্দিনের ছেলে নাজমুল হক (৬৫) ও একই এলাকার ছলেমন বসু মিয়ার ছেলে আমিনুল ইসলামকে (৪৮) আটক করে পুলিশ। পরে মামলা হলে তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়।

কম খরচে এবং কম সময়ে ভারত থেকে পাইপলাইনে জ্বালানি তেল সরবরাহের জন্য এই পাইপলাইনটি নির্মাণ করা হয়। গত ১৮ মার্চ দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী ভার্চুয়ালি পাইলাইনে তেল আমদানি কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। ভারতের শিলিগুড়ির নুমালীগড় রিফাইনারি লিমিটেড থেকে শুরু হওয়া ১৩১ দশমিক ৫৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পাইপলাইন শেষ হয়েছে দিনাজপুরের পার্বতীপুর বিপিসি রেলহেড ডিপোতে। এই পাইপলাইনটি বাংলাদেশ অংশের পরিমাণ ১২৬ দশমিক ৫৭ কিলোমিটার এবং ভারত অংশে ৫ কিলোমিটার।