• রোববার , ৫ মে ২০২৪

ধনী গরিবের ঈদ আনন্দ


প্রকাশিত: ১:৫২ এএম, ১৬ জুন ১৮ , শনিবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৩৪১ বার

ড. মোহীত উল আলম  :  ঈদ সবসময় তিনটি। উচ্চবিত্তদের জন্য একটি, মধ্যবিত্তদের জন্য একটি, আর নিম্নবিত্তদের জন্য একটি। ইসলাম ধর্মের শুরু থেকেই অর্থনৈতিক এ বিভাজন না থাকলে জাকাত, ফিতরা ইত্যাদি দাতব্য সেবার সৃষ্টি হতো না। বিশ্ব আঙ্গিকেও ঈদ তিনটি। ধনী দেশগুলোর জন্য একটি, মধ্যম আয়ের দেশগুলোর জন্য একটি, আর গরিব দেশগুলোর জন্য আরেকটি। এ রোজার সময় মেসেঞ্জার নামক ডিভাইসটির প্রচুর ব্যবহার হয়েছে।

যে যা পেরেছে ফান মেইল আর ভিডিও পাঠিয়ে বন্ধুদের মনোরঞ্জনে অকাতরে একে অপরকে ট্যাগ করেছে। খানিকটা যেন রোজার উপবাসের ক্লান্তি মোচনের জন্য। এর মধ্যে একটা পেলাম সৌদি আরবের শেখদের ইফতার করার একটি ভিডিও। একটা হলঘরে বিরাট আয়োজন। প্রতিটা টেবিলে বিরাট বিরাট আরব দেশীয় দুম্বার রোস্ট এভারেস্টের আকার নিয়ে বসে আছে। তার চারপাশে চেয়ারে ঘিরে বসে আছে সৌদিরা, যারা হাত দিয়ে খুবলে খুবলে ওই দুম্বাগুলোর গা থেকে মাংস চিরে বের করছে আর খাচ্ছে। মনে মনে বললাম, আলহামদুলিল্লাহ।

ঠিক তার পাশে আরেকটা ভিডিও, বাংলাদেশের কোনো একটা শহরের বস্তির মধ্যে ইফতার উদযাপনের দৃশ্য :একটি থালায় কিছু মুড়ি আর ছোলা। আর তা থেকে খুবলে খুবলে খাচ্ছে দশ-বিশটা হাত। মনে মনে বললাম, সোবহান আল্লাহ্‌। এ ভিডিওযুগল ইসলামী জগতের অর্থনৈতিক বৈষম্যের একটি আঙুল-নির্দেশকারী ছবি। পরিস্কারভাবে এ ভিডিওযুগলের বাস্তব প্রতিফলন ঈদের দিনেও দেখা যাবে। কিন্তু এ অর্থনৈতিক পার্থক্য নিয়ে আসলে কিছুই করার নেই। এভাবে চলেছিল, এভাবেই চলছে এবং এভাবেই চলবে।

তবে ঈদ উদযাপনের জন্য রোজার মাস ধরে যে ব্যস্ততা, তার আবার শ্রেণিবিন্যাস হেতু রকমফের আছে। ইংরেজ কবি জন ডানের একটি কবিতায় আছে যে, প্রকৃতিতে যেসব ছোটখাটো দুর্যোগ সেগুলো চোখে দেখা যায়; কিন্তু যেগুলো বড়মাপের পরিবর্তন যেমন গ্রহ-নক্ষত্রের চলাফেরা, সেগুলো চোখে দেখে বোঝা যায় না। যেমন, কালবৈশাখী চোখে দেখা যায়; কিন্তু ভূমিকম্প চোখে দেখা যায় না বা পৃথিবীর মেয়ে চাঁদের অভিযাত্রা হয়তো খালি চোখেও খেয়াল করা যায়; কিন্তু সম্রাট সূর্যের গতি বুঝতে পারা যায় না।

ঠিক সে রকম ঈদ উদযাপনকে যদি মাছের সঙ্গে তুলনা করি, তা হলে পুঁটি মাছ যতটা বুদবুদ তোলে; রুই-কাতলা অতটা ঘাই মারে না। সেভাবে ঈদ উদযাপনের বেলায় দৃশ্যমানভাবে সবচেয়ে বেশি জঙ্গম, অস্থির, উত্তেজিত, হতাশ, খুশি- এসব নিয়ে যে সম্প্রদায় জড়িত, তারা সমাজের অর্থনৈতিকভাবে নিম্নবিত্ত শ্রেণি। তার চেয়ে আরেকটু কম ব্যস্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণি, আরও কম ব্যস্ত হলো উচ্চবিত্ত শ্রেণি। বরং বলা ভালো, শেষের শ্রেণির লোকদের সারা বছরেই প্রায় ঈদের পরিতৃপ্তি থাকে বিধায় রোজার মাসে ঈদের ব্যস্ততা নিয়ে তাদের আলাদা কোনো চিত্ত-চাঞ্চল্য থাকে না।

গরিবের ঈদ উদযাপনের শানে নজুল হলো, সাধ ও সাধ্যের মধ্যে এক প্রচণ্ড রক্তারক্তি লড়াইয়ের কাহিনী। বঞ্চনা, বঞ্চনা মেটানোর পরিতৃপ্তি কিংবা না মেটানোর অতৃপ্তি- এগুলো নিয়ে গল্প-উপন্যাস কম রচিত হয়নি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, গরিবের ঈদ পালন এখনও মহাকাব্যিক শোকগাথা রচনার উপজীব্য হতে পারে। এ ছাড়া আছে মর্মন্তুদ ঘটনাগুলো। হয়তো শ্রমিক তার বেতন আর বোনাস নিয়ে রাতে ঘরে ফিরছে, পথিমধ্যে হাইজ্যাকারের হাতে খুন হয়ে গেল। হয়তো এক নিম্নবিত্ত কেরানি সৎ জীবন যাপনকারীর ঘরে আণ্ডাপাণ্ডা শিশুর সংখ্যা ভারি।

ছোট মেয়ে দুটির জন্য কোনোভাবে নতুন জামা কিনতে পারছে, বাকি বড় দুটির জন্য তার কেনার সঙ্গতি নেই। তখন সেই পিতা (বা ঘরে উদ্বেগাকুল চিত্তে অপেক্ষমাণ স্ত্রী) যে কী করবে, মাথা ফাটিয়েও বের করতে পারে না। আবার হয়তো বাবা বের হয়েছে বাজারে, ছোট্ট মেয়েটি আবদার করেছিল একটা লাল জামার জন্য। বাবা সেটি দামের জন্য কিনতেই পারল না। তখন হয়তো পুরনো কাপড়ের দোকান থেকে পুরনো একটা লাল জামা কিনে মেয়েকে বুঝ দিল।

রাতে স্বামী-স্ত্রী এ নিয়ে হাপুস-হুপুস নিজেদের মধ্যে কান্নাকাটি। ঈদের মধ্যে যে প্রতিযোগিতার উদ্ভব হয় প্রতিবেশী-প্রতিবেশী কিংবা আত্মীয়-আত্মীয়তে যে মর্যাদার লড়াই, সেটিও নিম্নবিত্তকে (এমনকি মধ্যবিত্ত পরিবারেও) দারুণভাবে আঘাত করে। ‘বাবা, পাশের বাসার ছন্দা আপুরা সবাই নতুন জামা কিনেছে, আমরা পাব না’- শিশু বলে বাবাকে। তখন বাবার (এবং মা) মনে হয়, এ ঈদটা না এলেই ভালো হতো।

মধ্যবিত্তদের ক্ষেত্রে এ প্রতিযোগিতা একটু ভিন্নভাবে হলেও চরিত্র একই। গরিব পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসাবাসির পরিমাণ কোনো অংশে কম না হলেও অধিক সংখ্যক শিশুর কোলাহল, ঘর ছোট ও স্বামী-স্ত্রীর জন্য প্রায়ই আলাদা শোবার ঘর না থাকায় এখানে ভালোবাসাটা প্রায়ই বিগ্রহতে পরিণত হয় এবং অর্থনৈতিক টানাপড়েনের কারণে হতাশা থেকে দু’জনেরই মুখের বুলি গালিতে, হাতের নখ-নখরে এবং পুরুষের পা ধাবিত হয় স্ত্রীর মাঝ পেট বরাবর। তখন ঈদ আনন্দের জায়গা দখল করে নেয় দাম্পত্য সন্ত্রাস।

আমি ছোটবেলায় বেড়ে উঠেছি কাজীর দেউড়িতে। তখন সেখানে প্রচুর সংখ্যক নিম্নবিত্তের মানুষ বাস করত। ঈদ এলে এসব অধিবাসীর ঘরে ঘরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কুরুক্ষেত্র ঘর থেকে বেরিয়ে গলিতে ছড়িয়ে পড়ত। রিকশাওয়ালা স্বামী তার অন্তঃসত্ত্বা বৌকে পেট বরাবর লাথি মারছে- এটা আমার স্মৃতির ক্যামেরায় স্থিরচিত্র হয়ে গেঁথে আছে। আরেকবার এক ইটের শ্রমিককে বৌয়ের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে না পেরে নিজের মাথায় ইট মেরে আঘাত করা দেখে আমার শিশু বয়সের অনেক রাতের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারে ঠিক সে টানাপড়েন নেই। সে জন্য স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসাবাসিও বেশি। কিন্তু এটা আরও বড় প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র। ‘পাশের ফ্ল্যাটের ভাবি বড় মেয়ের জন্য একটি গলার হার কিনেছে না? তো আমাদের টুসকিও তো সমান বয়সের আর একই কলেজে পড়ে। কেমন লাগবে না দেখতে! আমরা কি মেয়েকে কম দেখতে পারি?’ বৌয়ের কথা শুনে স্বামী বৌয়ের গা থেকে আগ্রহভরা হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলবেন, কী করতে বলো?

আমার তো টাকা নেই, আমি তো ঘুষ খাই না, চুরিও করি না।’ বৌ রিভার্স মুডে চলে গেলেন। অর্থাৎ সরাসরি ঘায়েল না করে আড়াল থেকে ঘায়েল করার কৌশল প্রয়োগ করলেন। তাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্ত হয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে, আর কী করা যাবে?’ কিন্তু স্বামীর মনে মন-ঘুরানি শুরু হলো- তার আদরের স্ত্রী নিজের জন্য তো চায়নি; মেয়ের জন্য চেয়েছে। স্ত্রীও জানেন যে, এই দাওয়াইয়ে কাজ দেবে। ঘুমের ভান করে পড়ে থাকলেন।

বিশ মিনিট যেতে না যেতেই স্বামী বৌয়ের গালে ঠোনা মেরে বললেন, ‘এই শোনো, নতুন একটা ক্রেডিট কার্ড পেয়েছি। ওইটা পাঞ্চ করব। তোমার মেয়ের জন্যও একটা হার হবে, তোমার জন্যও একটা হার হবে।’ স্ত্রী কপট রাগ দেখিয়ে বলবেন, ‘না বাবা, ওই ক্রেডিট কার্ড ক্রেডিট কার্ড আর করিও না তো। মাসের বেতনই থাকবে না। আর আমার জন্য কী দরকার? তোমার মেয়েকে দিতে চাচ্ছ, দাও।’ কিন্তু মনে মনে তিনি খুশি, নিজের শরীরে আলতো হাত বুলিয়ে নিজেকে থ্যাংকু দিলেন এ জন্য যে, এ বয়সেও স্বামীকে চোখ কানা করে রাখতে পেরেছেন।

স্ত্রী পরিচালিত এ রিভার্স মুডের ব্যবসায়িক নাম হচ্ছে, ‘বাই ওয়ান, গেট ওয়ান ফ্রি।’ আর এ পদ্ধতির বিরাট গ্রাহক হচ্ছে বড়লোকেরা। কারণ এদের কাছে কোনো টাকাই টাকা না। গরিবদের ক্ষেত্রে ঈদ হলো সে উপলক্ষ যখন তারা সংসারের আশু কিছু প্রয়োজন অল্প টাকার ভেতরে মেটাতে সচেষ্ট হয়। আর মধ্যবিত্তদের জন্য ঈদ হলো সংসারের কিছু জিনিস স্থায়ীভাবে সংগ্রহ করার উপলক্ষ, যেমন একটা ফ্রিজ।

আর ফ্রিজের মধ্যে জোগাড় হয়ে গেলে একটা ডিপ ফ্রিজ (এখন জানিয়ে রাখি, ৭ জুন ঘোষিত বাজেটে ফ্রিজের দাম কমানো হয়েছে) কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে গাড়ি (এ বাজেটে গাড়ির দাম বেড়েছে) ইত্যাদি। কিন্তু বড়লোকদের ক্ষেত্রে পুরো ঈদের বাজারটাই হচ্ছে ফাউ। না করলেও হয়। তখন তারা শুধু বিদেশ ঘোরার প্ল্যান নেয়, যেখানে ‘বাই ওয়ান, গেট ওয়ান ফ্রি’ প্র্যাকটিসটা খুবই কার্যকর। প্রতিযোগিতাটা হয় এভাবে :এক বাড়ির পুরো পরিবার ঈদের সময় অস্ট্রেলিয়া গেল তো, পাশের বাড়ির পুরো পরিবার নিদেনপক্ষে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া যাবেই।

ধর্মীয়ভাবে ঈদ মুসলিম জাহানের জন্য ধনী-গরিব নির্বিশেষে অবশ্য পালনীয় একটি সম্প্রীতিমূলক আচারানুষ্ঠান হলেও, সামাজিকভাবে বিশেষ করে আমাদের সমাজে ঈদ অর্থনৈতিক চেহারার ব্যারোমিটারও বটে। অন্য একটা দিক থেকে ঈদ সামাজিক ও পারিবারিক ইতিহাসের অ্যালবামের মতো। ইচ্ছা করলে যে কোনো পরিবার তাদের সংরক্ষিত অ্যালবামে গত দুই যুগের ঈদের ছবি মেলালে দেখতে পারবে- কী ছিল, কী হয়েছে;

কী ছিল না, কী হলো না- এ পর্যায়গুলো। তেমনি কারা ছিল, কারা চলে গেল; কারা এলো- সব ধারণ করা থাকতে পারে ঈদ অ্যালবামগুলোতে। এখন স্মার্টফোন আর ফেসবুকের যুগ। এন্তার ছবিতে সবার মোবাইলের পেট ফুলে উঠবে (যদিও জানিয়ে রাখি যে, এবার বাজেটে প্রযুক্তিনির্ভর সেবার ওপর ট্যাক্স বেড়েছে। এমনকি উবার-পাঠাও কল করতে গেলেও বর্ধিত ট্যাক্স দিতে হবে)।

অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশের গোত্রভুক্ত হওয়ার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বাংলাদেশের গরিবরা আসলে আর আগের মতো গরিব নেই। মধ্যবিত্তরাও শক্তিশালী ভোগী গোত্রে পরিণত হয়েছে। আর এবারের বাজেট নাকি উচ্চবিত্তদের দিকে সুনজর দিয়েছে। ফলে সবার লক্ষ্য এখন হতে পারে উচ্চবিত্তে পরিণত হওয়ার। সেদিক থেকে গোটা দেশে একটা সচ্ছলতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যেটা চোখে দেখা যায়। সে জন্য মাদক-জাত পরিস্থিতি ও যোগাযোগ উন্নয়নের কাজ চলাতে যোগাযোগের সাময়িক অসুবিধা ছাড়া এবারের রোজা এ পর্যন্ত শান্তভাবেই কেটেছে। আশা করি, ঈদ পর্যন্ত তাই থাকবে। সামাজিক মানুষ সবকিছুর ওপরে জানমালের নিরাপত্তাকে মূল্য দেয়।

অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়লে আনন্দের বহরও প্রলম্বিত হয়। খুব ছোটবেলায় ঈদ ছিল মনে হতো এক দিনের। পরে বড় হতে হতে শুনলাম, ঈদ আসলে তিন দিনের। এক মাস রোজা রাখার পর এক দিনের ঈদে মোটেও মন ভরত না। তিন দিনটা ঠিক মনে হতো। আবার ডিজিটাল যুগে টিভি চ্যানেলগুলো দেখলাম ঈদকে পাঁচ দিন; পাঁচ দিন থেকে সাত দিন, আর এবার কোন একটা চ্যানেলে দেখলাম ঈদের অনুষ্ঠান বর্ধিত হয়ে চলে গেছে ১১ দিনে।

অনেকটা ‘বাই ওয়ান গেট ওয়ান ফ্রি’র মতো। ঈদ যেমন ব্যবসার দিক থেকে বহু উদ্যমী প্রকল্পের সূতিকাগার, তেমনি সৃজনশীলতার ক্ষেত্রেও বিস্তৃত একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দেয়। এবারের সব জাতীয় পত্রিকার ঈদ সংখ্যা ৫১২ পৃষ্ঠার ঢাউশ ভল্যুম। এন্তার গল্প-উপন্যাস-কবিতা-ভ্রমণকাহিনীতে ভরে আছে এগুলো। কিনবেন আর পড়বেন। বাংলাদেশ সৃজনশীল দেশ হলেই না সবদিক থেকে উন্নতি লাভ করবে।অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম