• বুধবার , ৮ মে ২০২৪

কাপ্তানহীন বিএনপির গুগলিতেও দুর্বলতা!


প্রকাশিত: ৩:২৬ এএম, ৫ আগস্ট ২৩ , শনিবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ২৫ বার

লাবণ্য চৌধুরী : নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে রাজনীতিকরা বলছেন এবার খেলা হবে। সব দলের একই কথা। কিন্তু খেলা যে হবে তার খেলোয়াড় কই? কে কার সঙ্গে খেলবেন তা নিয়েও খেলা হচ্ছে। খেলায় কেউ ছক্কা হাঁকায়। এক ওভারেই ৬ ছক্কা! খেলা শেষ? একই খেলায়-কেউবা গুগলি মারে। কিন্তু গুগলি মেরে বোল্ড আউট করলেও প্রতিপক্ষ অনেক সময় জেতে না। কারণ দক্ষ কাপ্তান না থাকার কারণে। বলা হয় জেতা ম্যাচ হেরে গেছে! আবার অনেক দক্ষ কাটার মাষ্টার বা স্পিন বোলার কে দেখা যায় এক ওভারেই কিস্তি মাত করে প্রতিপক্ষকে ধসিয়ে দিয়েছেন।

বিএনপির সর্বশেষ কর্মসূচিকে ক্রিকেটের ‘গুগলি বলের’ সাথে তুলনা করেছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি সমাবেশে বলেছিলেন, বিএনপির গুগলিতে বোল্ড হয়েছে আওয়ামী লীগ। অবস্থান কর্মসূচি কে কেন্দ্র করে তাদের অর্জন কী এমন প্রশ্নে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তাদের মহাসমাবেশ ও অবস্থান কর্মসূচি সফল হয়েছে ক্রিকেটের ‘গুগলি বলের’ কারণে।

কিন্তু রাজপথে ভিন্ন আলোচনাও আছে। বলা হচ্ছে, একটা ম্যাচে জিতলেই তো সিরিজ জয় হয়ে যায়না।
সিরিজ জয় করতে হলেতো দক্ষ ক্যাপ্টেন বা কাপ্তান লাগবে! ভাল দল লাগবে! যা নিয়ে বিএনপির সমস্যা রয়েছে। এই সমস্যাটা আরো প্রকট হয়ে উঠল ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমান এবং তার স্ত্রী জুবাইদা রহমানকে দুর্নীতি দমন কমিশনের একটি মামলায় সাজা দেয়ার কারণে। যদিও আগে থেকেই তারেক রহমান সাজাপ্রাপ্ত! সুযোগ ছিল জুবাইদার। কিন্তু তাও গুড়েবালি!

ফখরুলের মতে, বিএনপি’র গুগলিতে ‘বোল্ড আউট’ হয়ে গেছে আওয়ামী লীগ। এরপর দলের ভেতরে অনেকেই মহাসমাবেশ এবং অবস্থান কর্মসূচিকে বলছেন, বিএনপি’র গুগলি কৌশল। কিন্তু এই গুগলি কৌশলে যখন বিএনপি সারাদিন ধরে রাজপথে অবস্থান নিয়ে থাকতে পারেনি, তখন দলটির অর্জন কী তা বলাই বাহুল্য। আর আওয়ামী লীগ কিভাবে বোল্ড আউট হলো এ নিয়ে এখনো চলছে নানা আলোচনা সমালোচনা।

বাংলাদেশে প্রায় মাসখানেক ধরে সরকার পতনের এক দফা আন্দোলন করছে বিএনপি। সম্প্রতি দলটির সবচেয়ে বড় কর্মসূচি ছিল ঢাকায় মহাসমাবেশ এবং ঢাকার বিভিন্ন প্রবেশমুখে অবস্থান। দ্বিতীয় কর্মসূচিকে ঘিরে আইন-শৃংখলা বাহিনীর তৎপরতা ও বিভিন্ন এলাকায় সংঘাত-সহিংসতা ছিলো লক্ষণীয়। অনেকে মনে করেন , পুলিশি বাধার মুখে রাজপথে কর্মসূচি পালনে বিএনপি’র ‘দুর্বলতা আবারো স্পষ্ট’ হয়েছে।

রাজনৈতিকরা বলছেন, বিএনপি’র ভেতরে যে মূল্যায়ন পাওয়া যাচ্ছে সেটা হচ্ছে, নানা ধরণের চাপের মুখেও দিন-তারিখ পরিবর্তন করে হলেও শুক্রবারের মহাসমাবেশে নেতা-কর্মীদের বড় জমায়েত করা বিএনপি’র সফলতা।
এই ‘সফলতার’ পর বিএনপি চেয়েছে রাজপথের আরেকটু কঠোর কর্মসূচি অর্থাৎ অবস্থান কর্মসূচিতে যেতে।

এসব কর্মসূচীর এক সপ্তাহের মধ্যেই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমান এবং তার স্ত্রী জুবাইদা রহমানকে দুর্নীতি দমন কমিশনের একটি মামলায় সাজা দিয়েছে ঢাকার একটি আদালত। এর বাইরে দলটির আরো বহু নেতা-কর্মীও বিভিন্ন মামলার আসামী হয়ে বিচারের মুখোমুখি। এ অবস্থায় সামনে আন্দোলন কিভাবে এগিয়ে নেবে বিএনপি? এছাড়া অবস্থান কর্মসূচিতে বিএনপি’র দুর্বলতার কারণ কী?বিএনপি’র মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা বলছেন, প্রতিটি কর্মসূচিতে অংশ নেয়া বেশ চ্যালেঞ্জ। কারণ পুলিশের চোখ ফাঁকি দেয়া সহজ নয়।

মহিলা দলের একজন নেত্রী বলেন, গত ২৯শে জুলাই ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচিতে দেবার সময় রাস্তায় নানা কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছে।আমি রাস্তায় বের হওয়ার সময় হাতে চিকিৎসার কাগজ নিয়ে বের হয়েছিলাম। কারণ পুলিশ অনেককেই রাস্তায় থামিয়ে চেক করছিল, কোথায় যাচ্ছেন জিজ্ঞেস করছিল। আমার সঙ্গে যারা ছিল, তারা বিভিন্ন কৌশলে আলাদা আলাদাভাবে গিয়েছিলো। আমরা একসঙ্গে যেতে পারি নাই বলে জানাচ্ছিলেন সাজেদা বেগম।বিএনপি’র অনেক নেতা-কর্মী বলছেন, তাদের জন্য পরিস্থিতি ছিলো আরো বিরূপ। যার একটা প্রভাব দেখা যায় শনিবারের কর্মসূচিতে।

বিএনপি এর আগে যেসব জনসভা কর্মসূচি পালন করেছে সেখানে নেতা-কর্মীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। সপ্তাহখানেক আগে ঢাকার মহাসমাবেশেও বড় জমায়েত করে বিএনপি। কিন্তু এর একদিন পর ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচিতে সে তুলনায় নেতা-কর্মীর বিপুল উপস্থিতি দেখা যায়নি।

কর্মসূচি ঘিরে আইন-শৃংখলা বাহিনীর কঠোর মনোভাব, তল্লাশি এবং সরকারি দল আওয়ামী লীগের পাল্টা অবস্থানের মুখে সেদিন রাজপথে বিএনপি’র অবস্থান ছিলো ঘণ্টাখানেকের মতো। যদিও কর্মসূচি ছিলো ৫ ঘণ্টার।
এমন অবস্থাকে মাঠের রাজনীতিতে বিএনপি’র সাংগঠনিক দুর্বলতা হিসেবেই দেখা হচ্ছে। যদিও বিএনপি বলছে, অবস্থান কর্মসূচিতে বহু লোক জড়ো করা কিংবা সেখান থেকে চূড়ান্ত আন্দোলনের দিকে যাওয়ার মতো কোন উদ্দেশ্য ছিলো না তাদের।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান গনমাধ্যমেককে বলেন, আমাদের লোক জড়ো করার কর্মসূচি ছিলো শুক্রবারের মহাসমাবেশে, শনিবারের অবস্থান কর্মসূচিতে নয়।আমাদের মূল প্রোগ্রাম ছিলো শুক্রবারের মহাসমাবেশ। শনিবার ছিলো একটা প্রতিবাদ কর্মসূচি মাত্র, শান্তিপূর্ণভাবে আমরা ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান করবো এটুকুই। কাজেই সেদিন লোক এসেছে কি-না বা আসেনি কেন? সেটা তো কোন প্রশ্ন না। সেখানে তো লোক আনার কর্মসূচি ছিলো না, বলেন মি. খান।

তৃণমূলে বিএনপি’র বড় সমর্থকগোষ্ঠী থাকলে মাঠের রাজনীতিতে দলটির সাংগঠনিক দুর্বলতা আছে বলেই মনে করে অনেকে। অবস্থান কর্মসূচিতে অর্জন কী এমন প্রশ্নে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি এক জনসভায় তাদের মহাসমাবেশ ও অবস্থান কর্মসূচিকে ক্রিকেটের ‘গুগলি বলের’ সাথে তুলনা করেছেন।

রাজনৈতিকরা বলছেন, বিএনপি’র ভেতরে যে মূল্যায়ন পাওয়া যাচ্ছে সেটা হচ্ছে, নানা ধরণের চাপের মুখেও দিন-তারিখ পরিবর্তন করে হলেও শুক্রবারের মহাসমাবেশে নেতা-কর্মীদের বড় জমায়েত করা বিএনপি’র সফলতা।
এই ‘সফলতার’ পর বিএনপি চেয়েছে রাজপথের আরেকটু কঠোর কর্মসূচি অর্থাৎ অবস্থান কর্মসূচিতে যেতে।

তাছাড়া অবস্থান কর্মসূচিতে ব্যাপক লোক সমাগম হলে সেটি হতো বড় ঘটনা। কিন্তু বিএনপি মনে করছে, অবস্থান কর্মসূচিতে আইন-শৃংখলা বাহিনীর বাধা দেয়া এবং সরকারি দলের ‘হামলা-সন্ত্রাস’ ব্যাপকভাবে দেশে-বিদেশে আলোচিত হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এসব নিয়ে মন্তব্য করেছে। যেটা সরকারের উপর চাপ বাড়াবে।

দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলছেন, শনিবারের ঘটনা বিশ্বের সকল গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যমে স্থান পেয়েছে। এবং সেখানে সরকারের যে মারমুখী আচরণ সেটা সরকার প্রমাণ করে দিয়েছে।এছাড়া অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে সংঘাতের নিন্দা জানিয়েছে, বিএনপি মনে করছে সেটি তাদের পক্ষে যাবে। এছাড়া বিষয়টি সরকারের উপর চাপ বাড়বে, যেটা বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে সামনের আন্দোলন সফল করার ক্ষেত্রে কাজে দেবে।

বিএনপি মনে করছে, সামনে আরো বেশি মাঠের আন্দোলনের কর্মসূচি আসবে। সেক্ষেত্রে আগেভাগেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করা গেলে সেটা সরকার এবং আইন-শৃংখলা রক্ষা বাহিনীর উপর ‘বাড়তি চাপ’ হিসেবে কাজ করবে।
দলটি ইতোমধ্যেই গত বুধবার ঢাকায় ২৫টি দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করে পুলিশ এবং সরকারি দলের কর্মীদের হামলার ভিডিও দেখিয়েছে।

বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক ঘটনাবলী কী ঘটছে, ২৯ তারিখে আমাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচীতে সরকার ও সরকারি দলের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের যে যৌথ কর্মকাণ্ড, মিথ্যা মামলা, গ্রেপ্তার- এই বিষয়গুলো আমরা তাদের বলেছি।

বাংলাদেশে যারা গণতন্ত্র দেখতে চায়, গণতান্ত্রিক অর্ডার দেখতে চায়, মানবাধিকার দেখতে চায়, একটা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচীতে পুলিশ, আনসার বাহিনী, র‍্যাব যেভাবে আক্রমণ করেছে, এটা তাদের জানা দরকার।বাংলাদেশে এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর বিশেষ নজর আছে এটা ঠিক। মানবাধিকার লংঘন বিষয়ে র‍্যাব নিয়ে মার্কিন স্যাংশন এবং পরে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য মার্কিন ভিসানীতি বাংলাদেশে বিএনপিকে আন্দোলনে উজ্জীবিত করেছে এমন আলোচনা আছে রাজনীতিতে।

তবে দলটির জন্য এটাও এক বাস্তবতা যে, এর আগে আন্দোলনে সহিংসতার অভিযোগসহ বিভিন্ন কারণে দলটির অনেক নেতা-কর্মী মামলার মুখোমুখি। বিএনপি সবসময় দাবি করে তাদের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে দেড় লাখের বেশি মামলা আছে।ঢাকায় কর্মসূচির আগের দিন পুরনো মামলায় বেশ কিছু নেতা-কর্মীকে আটক করে পুলিশ। দলের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতা-কর্মীদের নামে মামলা থাকায় সেটা আন্দোলনে প্রভাব ফেলে।

তাহলে এসব মামলা-গ্রেফতারের মধ্যে বিএনপি কিভাবে আন্দোলন এগিয়ে নেবে সেটা একটা বড় প্রশ্ন। বিএনপি’র সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক রুমিন ফারহানা গনমাধ্যমকে বলেন, মামলার চাপ বিএনপি’র জন্য নতুন কিছু নয়। কর্মীরা এখন এটার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে।
আমাদের নেতা-কর্মীরা যেটা বলে যে ঘরে থাকলেও মামলা খাই, বাইরে গেলেও মামলা খাই। আন্দোলন করলেও মামলা হয়, আন্দোলন না করলেও মামলা হয়। তারচেয়ে এবার লড়াইটা করেই দেখি বলছে কর্মীরা। রুমিন ফারহানার মতে, এখন বিএনপি’র সামনে ‘ডু অর ডাই’ পরিস্থিতি। সুতরাং নেতা-কর্মীদের মামলা-গ্রেফতারের চাপ দেখিয়ে আন্দোলন থামানো সম্ভব নয়।

বিএনপি বলছে আন্দোলনের কথা, অন্যদিকে আওয়ামী লীগও ঘোষণা দিয়েছে মাঠে থাকার। এছাড়া আইন-শৃংখলা বাহিনীর উপর হামলা কিংবা গাড়ি ভাংচুরের মতো বিষয়গুলোর জন্য বিএনপিকে দায়ী করে দলটিকে নতুন করে চাপে ফেলার চেষ্টাও আছে আওয়ামী লীগের। সবমিলিয়ে সরকারের বাধা এবং চাপ মোকাবেলা করে রাজপথে কোন কৌশলে আন্দোলনে এগুবে বিএনপি সেটা একটা বড় প্রশ্ন।