• মঙ্গলবার , ৩০ এপ্রিল ২০২৪

একুশের প্রথম প্রহরে রাষ্ট্রপতি -প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধাঞ্জলী 


প্রকাশিত: ১২:৩৮ এএম, ২১ ফেব্রুয়ারি ২৪ , বুধবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ২০ বার

 

লাবণ্য চৌধুরী কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার থেকে : আজ বাঙালি জাতির আত্মত্যাগের দিন মহান একুশে ফেব্রুয়ারি জাতীয় শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। মহান এই দিবসটি স্মরণে একুশের প্রথম প্রহরে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মধ্যরাতে ঘড়ির কাঁটা ১২টা ছোঁয়ার আগেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সারি দেখা যায় শহীদ মিনারে।১২টা এক মিনিটে শহীদ বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপ্রধান মো. সাহাবুদ্দিন। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শ্রদ্ধাঞ্জলী অর্পণ করেন।

পরে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে দলের পক্ষ থেকে শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধা জানান। এরপর জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শ্রদ্ধা জানান।এছাড়া জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু এবং চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী হুইপদের নিয়ে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানান।

পর্যায়ক্রমে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন তিন বাহিনীর প্রধান, ভাষা সৈনিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, অনুষদের ডিন ও হলের প্রাধ্যক্ষরা। এরপর সর্বস্তরের জনসাধারণের শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণের জন্য শহীদ মিনার উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ২১ বার পুষ্পস্তবক অর্পণের ছবি নিয়ে এবার আয়োজন করা হয়েছে বিশেষ প্রদর্শনী।

একুশের অজানা অধ্যায়- ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন অবসানের পর ভারতকে মাঝে রেখে পূর্ব ও পশ্চিমে দুটি অংশ নিয়ে গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে গঠিত হয়। এই রাষ্ট্র গঠনের শুরুতেই নিপীড়ণের শিকার হয় বাঙালিরা।পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে ফুঁসে ওঠে বাঙালি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বুকের রক্ত ঢেলে তারা ছিনিয়ে আনে মায়ের ভাষার অধিকার।

রাষ্ট্রভাষা কী হবে সেই বিতর্ক শুরু হয়েছিলো ১৯৪৭ সালের আগস্টে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন।ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তখন দৈনিক আজাদে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখে এর তীব্র বিরোধিতা করেন।

সে বছরই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথম মুদ্রা, ডাকটিকেট, ট্রেনের টিকেট, পোস্টকার্ড থেকে বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দু ও ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা হয়।পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের বাঙালি কর্মকর্তারা তার প্রতিবাদ করেন। মাতৃভাষার বাংলার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে একাট্টা হতে শুরু করেন ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীরা।

১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে ছাত্রলীগ, তমদ্দুন মজলিস এবং অন্যান্য দলের সমন্বয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ১১ মার্চের ধর্মঘটে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেক ভাষাসৈনিক সচিবালয়ের সামনে থেকে গ্রেপ্তার হন এবং ১৫ মার্চ মুক্তি পান।মুক্তি পাওয়ার পরদিন, অর্থাৎ ১৬ মার্চ শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পুনরায় ছাত্ররা প্রাদেশিক পরিষদ ভবন ঘেরাও করে, সেখানে পুলিশের লাঠিচার্জে অনেকেই আহত হন।

১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসে রেসকোর্স ময়দানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এক সমাবেশে ঘোষণা করেন- ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা’। সেই সমাবেশেই সম্মিলিত প্রতিবাদ জানায় বাঙালি।ভাষা-আন্দোলনকে জাতীয় আন্দোলনের রূপ দিতে দেশব্যাপী সফরসূচি তৈরি করে ব্যাপক প্রচারে অংশ নেন বঙ্গবন্ধু। সেই আন্দোলনের মধ্যে তিন দফা গ্রেপ্তার হয়ে তাকে ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কারাগারে কাটাতে হয়।

এর মধ্যেই ১৯৫২ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় এসে খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টনের সমাবেশে জিন্নাহর কথার পুনরাবৃত্তি করেন। এরপর ভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাঙালির প্রতিবাদ রূপ নেয় অগ্নিস্ফূলিঙ্গে।ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ থেকেও ভাষাসৈনিক ও ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে যোগযোগ রাখছিলেন বঙ্গবন্ধু, আন্দোলনকে বেগবান করার নানা পরামর্শ দিচ্ছিলেন। ৩ ফেব্রুয়ারি তিনজন দূত মারফত তিনি খবর পাঠান, ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী হরতাল ডাকতে হবে এবং মিছিল করে ব্যবস্থাপক পরিষদের সভাস্থল ঘেরাও করতে হবে।

৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের মিছিল শেষে এই ঘোষণা জানিয়ে দেয়া হয়। সেই পর্যায়ে শেখ মুজিব কারাগারে অনশনের ঘোষণা দিলে ১৫ ফেব্রুয়ারি কারা কর্তৃপক্ষ তাকে ঢাকা থেকে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তর করে।১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল পূর্ববাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদের বাজেট অধিবেশন। সেজন্যই সেদিন ধর্মঘট ডাকতে বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু। আর ধর্মঘট প্রতিহত করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার আশপাশের এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন।

সেই ১৪৪ ধারা ভেঙেই সেদিন মিছিল নিয়ে এগিয়ে যায় বাংলার মায়ের দামাল ছেলেরা। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর নির্দেশে মিছিলের ওপর পুলিশের গুলি চলে, শহীদ হন রফিক, শফিক, জব্বার, বরকত, শফিউদ্দীন, সালামসহ আরও অনেকে।এর দুই বছর পর ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তানের পার্লামেন্ট বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকার করে প্রস্তাব গ্রহণ করে। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি কার্যকর হতে লেগেছিলো আরও দুই বছর।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনেই তৈরি হয়েছিল বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের পথ, যে পথ ধরে বাঙালি এগিয়ে যায় স্বাধীনতার সংগ্রামে, পাকিস্তান থেকে আলদা রাষ্ট্র হয়ে একাত্তরে আত্মপ্রকাশ ঘটে বাংলাদেশের।১৯৯৮ সালে কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপনের জন্য জাতিসংঘে আবেদন করেন।

পরের বছর ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে ১৮৮টি দেশ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রস্তাবে সমর্থন জানায়।
পরে ২০১০ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে সিদ্ধান্ত হয়, প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি পালিত হবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। ভাষার জন্য বাঙালির আত্মত্যাগের দিনটি তাই আজ বিশ্বের সব ভাষাভাষীর অধিকার আদায়ের সময়।