সরকারকে ডোবাতে জেবুন্নিসারা’ই যথেষ্ট!

লাবণ্য চৌধুরী : রোজিনার গলা টিপে ধরা জেবুন্নিসারা কি সরকারকে ডোবাবে! এ প্রশ্ন এখন জনমনে। কার ইন্ধনে কার ইশারায় সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের গলা চেপে ধরেছিলেন অতিরিক্ত সচিব জেবুন্নেসা বেগম। সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের গলা চেপে ধরার সাহস কে তাকে দিল! রোজিনা গ্রেফতারের ঘটনায় এটা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। কেউ চুরি করলে তাকে থানা পুলিশের হাতে তুলে দিতে হবে এটাই নিয়ম; কিন্তু জেবুন্নেসা নিজের হাতে আইন তুলে নিলেন কেন? তাছাড়া তিনি কেন’ই বা রোজিনার ফোন কেড়ে নিলেন! এসব নানা প্রশ্ন এখন জনমনে! এতে সরকারের ভাবমূতি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সরকারের আমলা নির্ভরতা, আমলাদের চাটুকারিতা শেষমেষ সরকারের বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পেশাগত দায়িত্ব পালনে দেশের আমলাদের হাতে সাংবাদিক নির্যাতন ও মামলার ঘটনা বেড়েই চলেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছেন, আমলাদের দুর্নীতির খবর প্রকাশ করার কারণেই তারা সাংবাদিকদের ওপর চটে আছেন। সাংবাদিক লাঞ্ছনার ঘটনায় অভিযুক্ত আমলাদের কারও বিচার না হওয়াটাও এ ধরনের ঘটনা বাড়াচ্ছে।এর আগে ২০২০ সালের ১৩ মার্চ বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম রিগ্যানকে মধ্যরাতে অপহরণ ও বিবস্ত্র করে নির্যাতন করা হয়। এতে নেতৃত্ব দেন কুড়িগ্রামের তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমা। কুড়িগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের নির্দেশে রেভিনিউ ডেপুটি কালেকটর (আরডিসি) নাজিম উদ্দীন ও সহকারী কমিশনার (নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট) এসএম রাহাতুল ইসলাম আরিফুলকে আটক করে নির্যাতন করে। এমনকি মোবাইল কোর্টে তাকে একবছরের শাস্তিও প্রদান করে। পরে আরিফুল এদের আসামি করে মামলা করেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে এদের কারও এখনও শাস্তি হয়নি।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কারাবন্দি লেখক মুশতাক আহমেদ (৫৩) মারা যান। তিনি গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে ছিলেন। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হিসাব অনুযায়ী, ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ২২ বছরে বাংলাদেশে ৩৫ জন সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। প্রতিমাসেই দেশের কোথাও না কোথাও সাংবাদিক নির্যাতন ও হেনস্থার ঘটনা ঘটছে।সাংবাদিক ও মুক্তচিন্তার মানুষের ওপর হামলা, মামলা, নির্যাতন ও হয়রানি বেড়ে যাওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আর্টিকেল নাইনটিন। সংগঠনটির তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দেশে ১১ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে তিনজন সাংবাদিক কারাগারে আছেন।
আর্টিকেল নাইনটিনের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, ‘এই ন্যাক্কারজনক ঘটনা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সদিচ্ছাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সারাদিন শেষে প্রায় মাঝরাতে রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরকেও উদ্দেশ্যমূলক বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।গতবছর মার্চ ও এপ্রিলে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ ভবন ও এলজিইডি ভবনে আমলাদের হাতে লাঞ্ছিত হন বেসরকারি টেলিভিশন ইটিভি’র সিনিয়র রিপোর্টার সাইদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমি গতবছর মার্চে এলজিইডির গাড়ির অপব্যবহার নিয়ে কাজ করছিলাম। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বক্তব্য নেওয়ার জন্য ওই ভবনে যাই। এসময় আমাকে লাঞ্ছিত করা হয়। পরে বিষয়টি সেখানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের জানাই। লাঞ্ছনাকারীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থ নেওয়া হয়েছে তা আর আমাকে জানানো হয়নি।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি মোরসালিন নোমানি বলেন, আমলাদের জবাবদিহিতা নেই। তারা এসব করে পার পেয়ে যাচ্ছে। তাই সাংবাদিকদের ওপর হামলা বাড়ছে। তারা কেবল এই সরকারের আমলে এসব করছে তা না। বিভিন্ন সরকারের সময়েও হামলা-মামলা করেছেন।আর্টিকেল নাইনটিন-এর ২০২০ সালের হিসাব অনুযায়ী, সারাদেশে গতবছর দুজন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে, ৭৮ জন হামলায় গুরুতর আহত হয়েছেন, ১৬৬ জন সাংবাদিক হত্যা ও অপহরণের হুমকি পেয়েছেন, ৩৫টি মামলায় ৫৮ সাংবাদিককে আসামি করা হয়েছে, ১২টি ফৌজদারি মামলায় ২০ জনকে আসামি করা হয়েছে এবং ৩১ সাংবাদিকের ক্যামেরাসহ গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম ভাঙা হয়েছে। এসব ঘটনার সঙ্গে পুলিশ, আমলা, রাজনীতিবিদ ও ঠিকাদাররা জড়িত ছিল।
অতীতে আমলাদের মাধ্যমে এতো সাংবাদিক হামলার ঘটনার কথা শোনা যায়নি। বর্তমানে এসব ঘটনা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি মোল্লা জালাল জাতিরকন্ঠ কে বলেন, বর্তমানে আমলানির্ভর সরকার কখনও তার রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের শতভাগ বাস্তবায়ন করতে পারে না। আমলানির্ভর হওয়াতেই এসব ঘটনা বাড়ছে।