ভারতের জেলে বসে বাংলাদেশের আন্ডারওয়ার্ল্ড চালাচ্ছে দুর্ধর্ষ সাজ্জাদ
প্রিয়া রহমান : ভারতের জেলে বসে বাংলাদেশের আন্ডারওয়ার্ল্ড চালাচ্ছে জামায়াত ক্যাডার দুর্ধর্ষ সাজ্জাদ। তাকে ভারত থেকে ফেরত আনতে ব্যবস্থা নিচ্ছে পুলিশ। জানা গেছে, একসময়কার শিবির ক্যাডার এই সাজ্জাদ হোসেন খানের বিরুদ্ধে থাকা আটটি মামলার সর্বশেষ তথ্যসহ নথি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ (সিএমপি)। এসব তথ্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ভারতের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছার পর সাজ্জাদকে দেশে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হবে বলে মনে করছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
সূত্রমতে, গত ফেব্রুয়ারিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আদেশক্রমে পুলিশ সদর দফতর থেকে সাজ্জাদ হোসেনের বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ চেয়ে একটি চিঠি দেয়া হয় সিএমপির বিশেষ শাখার উপ-কমিশনারের কাছে। সিএমপির বিশেষ শাখা থেকে অতিরিক্ত উপ পুলিশ কমিশনারকে (প্রসিকিউশন) এই বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য বলা হয়।
২০১২ সালের ৭ নভেম্বর ভারতের পাঞ্জাবের অমৃতসরে গ্রেফতার হয় সাজ্জাদ। বাংলাদেশের আবেদনের প্রেক্ষিতে আর্ন্তজাতিক সংস্থা ইন্টারপোলে মোস্ট ওয়ান্টেড হিসেবে সাজ্জাদকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। গ্রেফতারের পর থেকে সাজ্জাদকে দেশে ফেরাতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয় স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
২ মার্চ চিঠি দিয়ে চট্টগ্রাম মহানগর পিপি মো.ফখরুদ্দিন চৌধুরীর কাছে এই বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে তথ্য চাওয়া হয়। ২৮ মার্চ সাজ্জাদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য নগর পুলিশের কাছে পাঠান মহানগর পিপি।
এতে উল্লেখ করা হয়, সাজ্জাদ হোসেনের বিরুদ্ধে আটটি মামলা আছে। এর বিরুদ্ধে দুটি মামলায় তার বিরুদ্ধে সাজামূলে পরোয়ানা আছে। পাঁচটি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা আছে। একটি মামলার কার্যক্রম হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত আছে।
আটটি মামলার মধ্যে নগরীর চান্দগাঁও থানায় অস্ত্র আইনে দায়ের হওয়া একটি মামলায় তার দশ বছরের সাজা হয়েছে। বায়েজিদ বোস্তামি থানার জননিরাপত্তা আইনের একটি মামলায় ২০০৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর তার বিরুদ্ধে দশ বছরের সাজার রায় হয়েছে।
এক কোটি টাকা চাঁদার দাবিতে নিজ ভাই ছালামত আলী বাবুলের গাড়ি পোড়ানোর ঘটনায় নগরীর বায়েজিদ বোস্তামি থানার দুটি মামলায় (০৬(০৮)২০১১ ও ২৪ (০৮)২০১১) সাজ্জাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা আছে। মামলা দুটি যথাক্রমে সপ্তম যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ এবং অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে বিচারাধীন আছে।
বায়েজিদ বোস্তামি থানার অস্ত্র আইনের একটি মামলার (নম্বর-০১ (১০)২০০১) সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে। সর্বশেষ ২২ মার্চ মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণের সময় নির্ধারিত ছিল। সরকারী কর্মকর্তাদের কর্তব্যকাজে বাধাদান এবং হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণের অভিযোগে বায়েজিদ বোস্তামি থানায় দায়ের হওয়া একটি মামলা (নম্বর-০১ (১০)২০০১) অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের অপেক্ষায় আছে। গত ২ মার্চ মামলাটির সর্বশেষ ধার্য তারিখ ছিল।
পাঁচলাইশ থানায় দায়ের হওয়া একটি হত্যা মামলা (নম্বর- ৩৭ (০২) ২০০০) জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে আছে। গত ৯ মার্চ সর্বশেষ সাক্ষ্যগ্রহণ হয়। একই থানার আরেকটি মামলার (২৬ (০৩)১৯৯৮) কার্যক্রম বর্তমানে হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত আছে।
চট্টগ্রাম মহানগর পিপি অ্যাডভোকেট মো.ফখরুদ্দিন চৌধুরী বলেন, সাজ্জাদের বিষয়ে মামলাগুলো কি অবস্থায় আছে, সেটা জানতে চেয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে আমাকে চিঠি দেয়া হয়েছিল। আমি মামলার সর্বশেষ অবস্থা জানিয়েছি। এখন পুলিশ এসব তথ্য ভারতের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাবে।
এদিকে নগরীর ১৬ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) কাছেও চিঠি পাঠিয়ে সাজ্জাদ হোসেনের মামলার বিষয়ে তথ্য পাঠানোর নির্দেশনা দেয় সিএমপির বিশেষ শাখা। বায়েজিদ বোস্তামি, পাঁচলাইশ এবং চান্দগাঁও থানা থেকে গত ২৫ মার্চ মামলা সংক্রান্ত তথ্য পাঠানো হয়েছে বিশেষ শাখায়।
বায়েজিদ বোস্তামি থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিন বলেন, নিজের ভাইয়ের গাড়ি পোড়ানোসহ বায়েজিদ থানার চারটি মামলায় সাজ্জাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানার তথ্য দেয়া হয়েছে।
সূত্রমতে, সাজ্জাদের বিরুদ্ধে আটটি মামলার সর্বশেষ তথ্য ২ এপ্রিল নগর পুলিশের বিশেষ শাখা থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (প্রসিকিউশন) নির্মলেন্দু বিকাশ চক্রবর্তী বলেন, ভারতের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের জন্য সাজ্জাদের আটটি মামলার তথ্য আমরা নথি আকারে পাঠাচ্ছি।
পুলিশের উপ কমিশনার (বিশেষ শাখা) মোখলেছুর রহমান বলেন, সাজ্জাদ একজন শীর্ষ সন্ত্রাসী। তার বিরুদ্ধে সব তথ্য সবসময় আপডেট রাখা প্রয়োজন। এজন্য আমরা আদালত থেকে সর্বশেষ মামলাগুলোর কী অবস্থা সেটা চেয়েছিলাম। এখন প্রয়োজনে এসব তথ্য আমরা ব্যবহার করব।
শেষ পর্যন্ত গত বছরের মার্চে সাজ্জাদ হোসেনকে সরাসরি হস্তান্তরে সম্মত হয় ভারত। বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি নিয়ে ভারতের আদালতের ঝামেলা এড়াতে ভারত সরাসরি হস্তান্তরে সম্মত হয়। তবে এক্ষেত্রে সাজ্জাদের বিরুদ্ধে থাকা মামলার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ চায় ভারতের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
কে এই সাজ্জাদ
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০০০ সালে খুন হন পাঁচলাইশ এলাকার ওয়ার্ড কমিশনার লিয়াকত আলী। এই হত্যাকান্ডে নেতৃত্ব দেন সাজ্জাদ ও আরেক দুর্ধর্ষ শিবির ক্যাডার ক্যাডার জসিম উদ্দিন ওরফে ফাইভ স্টার জসিম। মূলত এ ঘটনার পরই অপরাধ জগতে সাজ্জাদের নাম ছড়িয়ে পড়ে।
এর কিছুদিন পর নগরীর বহদ্দারহাট মোড়ে মাইক্রোবাসে ব্রাশ ফায়ার করে ছাত্রলীগের আট নেতাকর্মীকে হত্যা করে শিবির ক্যাডাররা। এ হত্যাকান্ডেরও নেতৃত্ব দেন সাজ্জাদ।
এরপর ২০০১ সালের ৩ অক্টোবর নগরীর চালিত্যাতলী এলাকায় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধের পর সাজ্জাদ তার সহযোগী ও দুর্ধর্ষ শিবির ক্যাডার দেলোয়ার হোসেন ওরফে আজরাইল দেলোয়ার সহ গ্রেপ্তার হয়েছিল। এসময় তার কাছ থেকে পুলিশ একটি একে-৪৭ রাইফেল উদ্ধার করে।
২০০৫ সালে আজরাইল দেলোয়ার জামিনে মুক্তি পেয়ে র্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হন। তবে তিন বছর জেল খেটে দেলোয়ারের আগেই সাজ্জাদ ২০০৪ সালে জামিনে মুক্তি পান। এরপর কুমিল্লার জামায়াত দলীয় তৎকালীন একজন সাংসদ সাজ্জাদকে নিয়ে গাড়িতে করে র্যাব-পুলিশের গ্রেপ্তার এড়িয়ে কারাগার প্রাঙ্গন ত্যাগ করেন।
২০০৪ সালে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতির মুখে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র্যাব) গঠনের পর সাজ্জাদ আলী খান দুবাইয়ে পালিয়ে যান।