নারীর উরুতে হাত দেয়া ‘জজ’ তুলকালাম
‘শাহপরান’ কারসাজিতে ফৌজদারি আসামী জজ-
শফিক রহমান/সাইফুল বারী মাসুম : তদবিরে ফৌজদারি আসামী জজ বনে গিয়েছিল। কিন্তু বিধি বাম; শেষরক্ষা হয়নি। ঘটনা ফাঁস হয়ে গেলে ১৩তম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষার মাধ্যমে সহকারী জজ পদে নিয়োগ পাওয়া শাহ্ পরানের যোগদান স্থগিত করেছে মন্ত্রণালয়। তার বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা চলমান বলে অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত নিয়ে! তারা হবু জজের ফ্রেস রিপোর্ট দিলো কি করে? শুধু কি তাই এই শাহপরান নারীর উরুতে হাত দিয়েছিল!
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নেত্রকোনায় সহকারী জজ (শিক্ষানবিস) হিসেবে যোগদান করার কথা ছিল শাহ্ পরানের। তার নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত করেছে মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগ। বৃহস্পতিবার (০২ ডিসেম্বর) এ সম্পর্কিত একটি আদেশ জারি করা হয়েছে।
মন্ত্রণালয় বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের জানান, শাহ পরানের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা চলমান থাকার বিষয়টি আইন ও বিচার বিভাগ অবগত ছিল না। এছাড়া, মো. শাহ্ পরান তার বিরুদ্ধে মামলা থাকার বিষয়টিও আইন ও বিভাগকে জানায়নি। বিষয়টি আইন ও বিভাগের গোচরীভূত হওয়ার পর তার সহকারী জজ (শিক্ষানবিশ) পদে যোগদানের কার্যক্রম বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে স্থগিত করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত,বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন ১৩তম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা ২০১৯ এর মাধ্যমে প্রার্থী মো. শাহ্ পরান-কে সহকারী জজ পদে নিয়োগের জন্য আইন ও বিচার বিভাগে সুপারিশ করে। সেই প্রেক্ষিতে, মো. শাহ্ পরানের সহকারী জজ পদে নিয়োগের আগে তার প্রাক-পরিচয় যাচাইয়ের জন্য আইন ও বিচার বিভাগ হতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার প্রাক-পরিচয় যাচাইপূর্বক মন্তব্যসহ প্রতিবেদন পেশ করে। সেখানে মো. শাহ্ পরান সম্পর্কে কোন বিরূপ তথ্য পাওয়া যায়নি মর্মে উল্লেখ করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রাপ্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে আইন ও বিচার বিভাগের ২৫ নভেম্বর ২০২১ তারিখের প্রজ্ঞাপনমূলে মো. শাহ্ পরানকে সহকারী জজ (শিক্ষানবিশ) পদে নিয়োগ প্রদান করে নেত্রকোনায় পদায়ন করা হয়েছিল।
ওদিকে-
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীনে দায়ের করা একটি মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি শাহ পরানকে সহকারী জজ হিসেবে নিয়োগের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। সংগঠনটি জানায়, গত বছরের ৪ ডিসেম্বর কক্সবাজার থেকে ঢাকাগামী বাসে এক নারী যাত্রীকে উত্ত্যক্ত করেন শাহ পরান। ওই নারী প্রতিবাদ করলে এক পর্যায়ে তাকে শারীরিক নির্যাতন ও যৌন হয়রানি করা হয়।
এ ঘটনায় ভুক্তভোগী বাদী হয়ে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া থানায় শাহ পরানের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন ২০২০-এর ১০ ধারায় মামলা করেন বলে মহিলা পরিষদ প্রেস বিবৃতিতে উল্লেখ করে। এ ঘটনায় সেসময় শাহ পরানকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সহকারী পরিচালক পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
মহিলা পরিষদ জানায়, একজন বিচারক বিচার বিভাগের বিচারিক কার্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই ধরণের গুরুত্বপূর্ণ পদে একজন নারী নির্যাতকারীকে কিভাবে নিয়োগ দেয়া হলো এবং কিভাবে পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়েছে এ বিষয়গুলো তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। পরিষদ শাহ পরানের নিয়োগ স্থগিত রেখে এই নিয়োগ প্রক্রিয়ার কোনো পর্যায়ে অবহেলা থাকলে অবহেলার সাথে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছে মহিলা পরিষদ।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, পুলিশ ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে এ ধরনের নিয়োগ প্রক্রিয়ার গুণগত মান বজায় রাখা না হলে তা নারী ও মেয়েদের বিচার পেতে বাধা সৃষ্টি করবে। সহকারী জজ পদে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় তথ্য গোপন ও কারচুপির অভিযোগে শাহ পরানের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনটি। একইসঙ্গে পৃথক আইন প্রণয়নসহ যৌন হয়রানি বন্ধে হাইকোর্টের রায় কার্যকর করারও দাবি জানানো হয়।
নারীর উরুতে হাত দিয়েছিল সে-
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ ধারায় চট্টগ্রামের লোহাগড়া থানায় শাহ পরানের বিরুদ্ধে মামলা হয় ২০২০ সালের ৪ ডিসেম্বর। অভিযোগ, কক্সবাজার থেকে ঢাকাগামী বাসে পাশের নারীযাত্রীকে শ্লীলতাহানি ও শারীরিকভাবে আঘাত করেছেন তিনি।
নারী নির্যাতন মামলার বাদী জানান, যখন আমার একটু একটু ঘুম আসছিল তখন তার ডান হাতটা বের করে আমার বা পাশের উরুতে পানস করে। পর পর দুইবার উনি পানস করে। তারপর আমি যখন তার দিকে তাকায় তখন উনি একটা চাদর দিয়ে তার মুখটা ঢেকে ফেলে। তখন ওনার চাদরটা সরিয়ে দেখি উনি ঘুমাননি। আমি তাকে সরি বলতে বলি কিন্তু সে সরি বলবে না। তখন আমার ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙুলটা সে মুচড়ে দেয়।
পরবর্তীতে এই মামলায় শাহ পরানকে গ্রেফতার করে পুলিশ; পাঠানো হয় কারাগারে। তদন্ত শেষে ১৬১ ধারায় সাক্ষীদের জবানবন্দি এবং প্রমাণের ভিত্তিতে শাহ পরানের বিরুদ্ধে ৮ ফেব্রুয়ারি অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রাফিকুল ইসলাম জানান, ১০ ধারায় বাদী যে অভিযোগ করেছে, সে অভিযোগ অনুযায়ী চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। বাদীর অভিযোগের প্রমাণ আমরা পেয়েছি। মামলার ইনফরমেন্টের আইনজীবী জানিয়েছেন মামলাটির চার্জ হেয়ারিং হবে আগামী ২২ ফেব্রুয়ারি, তাই আসামি অব্যাহতির কোনো সুযোগই নেই।