খালেদা’র অসুস্থতার রহস্য খুঁজছে দুদক
কোর্ট রিপোর্টার : খালেদাকে অসুস্থ দেখানো চিকিৎসককে আদালতে হাজিরের আবেদন (মৌখিক) করেছেন দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল। আদালতকে তিনি বলেন, ‘হাজিরার দিনই শুধু খালেদা জিয়া অসুস্থ হয়ে পড়েন।খালেদা জিয়া কি আদালতে আসবেন না? না ডাক্তার তাকে আদালতে পাঠাচ্ছেন না? এই বিষয় তদন্ত করা উচিৎ। চিকিৎসককে আদালতে হাজির করলে এর প্রকৃত রহস্য জানা যাবে এবং তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য আদালতের কাছে আবেদন (মৌখিক) করছি। ’
সোমবার (৪ জুন) রাজধানীর বকশিবাজারে অবস্থিত ঢাকার ৫নং বিশেষ জজ আদালতের বিচারক ড. আখতারুজ্জামানের আদালতে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার যুক্তি উপস্থাপনের জন্য দিন ধার্য ছিল। এদিন শুনানিতে এসব কথা বলেন দুদকের এ আইনজীবী।তিনি আরও বলেন, ‘চিকিৎসকের প্রক্রিয়াতে আমরা আটকে আছি। খালেদা জিয়াকে আদালতে হাজির করলে আমরা মামলাটা দ্রুত শেষ করতে পারতাম।’ তবে আদালত দুদকের আইনজীবীর বক্তব্যের বিষয় কোনো মন্তব্য করেনি।
এদিকে এই মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন বৃদ্ধি এবং তার বিরুদ্ধে যে প্রডাকশন ওয়ারেন্ট ছিল তা প্রত্যাহারের আবেদন করেন খালেদা জিয়ার আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত খালেদা জিয়ার জামিন ২৮ জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করেন এবং প্রডাকশন ওয়ারেন্ট প্রত্যাহার করেন।ওইদিন মামলাটির যুক্তি উপস্থাপনের জন্যও দিন ধার্য করা হয়েছে।অপরদিকে আসামি জিয়াউল ইসলাম মুন্না চিকিৎসা ও ওমরা হজ পালনের জন্য বিদেশ যাওয়ার আবেদন করেলে আদালত তা মঞ্জুর করেন।
এর আগে গত ১ ফেব্রুয়ারি আসামি পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনকালে আসামিপক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বলেন, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় এখতিয়ারবিহীন বিচার হচ্ছে। তাই আসামিরা খালাস পাবেন। ওই মামলার আসামি হারিছ চৌধুরীর (পলাতক) তখনকার সহকারী একান্ত সচিব ও বিআইডব্লিউটিএর নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মুন্নার পক্ষে তিনি যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করছেন।আমিনুল ইসলাম তার যুক্তিতে আরও বলেন, এটা কোনো পাবলিক ট্রাস্ট নয়, প্রাইভেট ট্রাস্ট। দলের অভ্যন্তরের ব্যক্তিদের টাকায় ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছে এবং ১৯৯৩ সালে আইনকানুন মেনে ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছে।
আমিনুল ইসলাম বলেন, বিএনপির তৎকালিন মহাসচিব বি চৌধুরীসহ ৭ জন ওই ট্রাস্টের সঙ্গে ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি চলে গেলে ২০০৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি পুনরায় এই ট্রাস্ট গঠন করা হয়।তিনি বলেন, ১/১১ সরকারের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি এই মামলাটি করা হয়।
এর আগে গত ৩০ জানুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মোশাররফ হোসেন কাজল এ মামলায় যুক্তি উপস্থাপন শেষ করেন। ওই দিন এ মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ সব আসামিদের সর্বোচ্চ ৭ বছর সাজার দাবি জানান তিনি। এই মামলার বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ মোট আসামি চারজন।
রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মোশাররফ হোসেন কাজল ওই দিন আদালতকে বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকাকালে (২০০১ থেকে ২০০৬ সাল) ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজে ও অন্যকে লাভবান করার জন্য জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট গঠন করেন। ১৯৪৭ সালের ৫(২), ধারা ও দণ্ডবিধি ১০৯ ধারায় অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। ৩২ জন সাক্ষির মাধ্যমে আমরা এটা প্রমাণ করতে পেরেছি। তাই এই মামলার প্রত্যেক আসামিকে সর্বোচ্চ ৭ বছর শাস্তির দাবি করছি।
তিনি আরও বলেন, বেগম খালেদা জিয়া ব্যক্তিগত স্বার্থে এ ট্রাস্ট গঠন করেন। ব্যাংক একাউন্ট খোলার সময় তিনি পেশার কথা লেখেননি। তিনি সে সময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।এরপর ওই দিনই আসামি ট্রাফিক বিভাগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মুন্নার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন শুরু করেন আইনজীবী আমিনুল ইসলাম।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে তিন কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা লেনদেনের অভিযোগ এনে খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে ২০১০ সালের ৮ আগস্ট তেজগাঁও থানায় মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক হারুন-অর-রশিদ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক বাসুদেব রায়।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন—খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী (পলাতক), হারিছের তখনকার সহকারী একান্ত সচিব ও বিআইডব্লিউটিএর নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান। প্রসঙ্গত, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় একটি মামলা করে দুদক। ২০১০ সালের ৫ আগস্ট তাদের
বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন দুদকের উপ-পরিচালক হারুন-অর-রশীদ। ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক বাসুদেব রায়। গত ৮ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার দুপুরে পুরান ঢাকার বকশীবাজারে স্থাপিত বিশেষ জজ আদালতের বিচারক ড. আখতারুজ্জামান জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় রায় ঘোষণা করেন।
রায়ে বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছর এবং সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মাগুরার সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) কাজী সলিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমানকে ১০ বছর করে কারাদণ্ডাদেশ এবং দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
রায়ের পর পরই খালেদা জিয়াকে আদালতের পাশে নাজিমউদ্দিন রোডের ২২৮ বছরের পুরান ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। নির্জন এই কারাগারে একমাত্র বন্দি হিসেবে গত ১১৭দিন ধরে কারাভোগ করছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।ওই মামলায় আপিলের পর খালেদা জিয়াকে চার মাসের জামিন দিয়েছিলেন হাইকোর্ট।
যেটি গত বৃহস্পতিবার (১৭ মে) বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। কিন্তু খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আরও ৩৬টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে কুমিল্লায় ৩টি, ঢাকায় ২টি ও নড়াইলের ১টি মামলায় তিনি জামিনে নেই। এর মধ্যে কুমিল্লার নাশকতা ও হত্যার দুই মামলায় হাইকোর্ট জামিন দিলেও পরেও ওই জামিনাদেশ ২৪ জুন পর্যন্ত স্থগিত করেছেন আপিল বিভাগ।
কারামুক্তি পেতে এসব মামলায় তাকে জামিন নিতে হবে। পাশাপাশি ৪টি মামলায় হাজিরা পরোয়ানা প্রত্যাহারের প্রয়োজন রয়েছে। যার মধ্যে একটিতে আদালত ইতোমধ্যেই হাজিরা পরোয়ানা প্রত্যাহারের আদেশ দিয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকার দুটি মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা কার্যকরের জন্য গত ১৭ মে নির্দেশ দিয়েছে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালত। একইসঙ্গে ৫ জুলাই পরোয়ানা সংক্রান্ত তামিল প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিন ধার্য রেখেছে আদালত। এ দুটি মামলায় খালেদা জিয়ার পক্ষে জামিন চাওয়া হলেও এ বিষয়ে কোনো আদেশ দেয়নি আদালত বলে জানান তার আইনজীবীরা।
প্রসঙ্গত, দীর্ঘ ৩৬ বছরের রাজনৈতিক জীবনে এর আগে একবার কারাগারে যেতে হয়েছিল বেগম খালেদা জিয়াকে। ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তাকে গ্রেফতার করা হয়। তখন জাতীয় সংসদ ভবন এলাকার স্পিকারের বাসভবনকে সাবজেল ঘোষণা করে সেখানে রাখা হয়েছিল তাকে। ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের এক আদেশে খালেদা জিয়া মুক্তি পান। এরপর তিনি দুর্নীতি মামলায় দ্বিতীয় বার জেলে যান।