• বৃহস্পতিবার , ২৭ মার্চ ২০২৫

‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ কি সত্য আছে-মাসরুর আরেফিনের উপন্যাসে-


প্রকাশিত: ১২:০১ এএম, ১০ এপ্রিল ২১ , শনিবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ২৬৫ বার

লাবণ্য চৌধুরী : ‘ক্ষমতা তুমি ততটাই জঘন্য যতখানি নাপিতের আঠা-আঠা আঙুলগুল’-‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ কি সত্য আছে- মাসরুর আরেফিনের উপন্যাসে-
আনপ্যারালাল উপন্যাস ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’। লেখক ব্যাংকার মাসরুর আরেফিন তাঁর একাধিক গ্রন্থের পর এবার ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ উপন্যাস লিখে উপন্যাস লেখার যেন ধারাই পাল্টে দিলেন তিনি। ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ আছে-অগ্রগতির বায়োস্কোপ উপরে, আর নিচে আতঙ্ক ছড়ানোর ‘প্রজেক্ট-কালাকানুন‘, একটা আরেকটার আবার পরিপূরক। তিনি জানাতে চাইছেন রাষ্ট্রের নৈতিক ও মানসিক পরিকাঠামোটিকে, যা এমন এক সিস্টেম গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর যেখানে সবকিছু ‘ওভারগ্রাউন্ড‘ ও ‘আন্ডারগ্রাউন্ড‘-এর মধ্যে ভাগ ভাগ—অগ্রগতির বায়োস্কোপ উপরে, আর নিচে আতঙ্ক ছড়ানোর ‘প্রজেক্ট-কালাকানুন‘, একটা আরেকটার আবার পরিপূরক।
বাস্তববাদীরা বলেন, নির্দিষ্ট ওই একভাবে ‘সিস্টেম’-টা চলে বলেই টিকে আছে রাষ্ট্রব্যবস্থা। কিন্তু কী সেই ‘সিস্টেম’ যার আছে শুধু ভয়জাগানো এক শারীরিক বাস্তবতা? আর তাই যা কিনা রাষ্ট্রের নাগরিকদেরকে মন ও মননের আধ্যাত্মিক জায়গাটুকুতে নিঃস্ব ও খোজা করে রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ?
এখানে ছাব্বিশ বছর পরে এক ভাই তার হারিয়ে যাওয়া বড় ভাইকে খুঁজছে দূর এক দেশের লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া এই কালে; দুই বন্ধু হিসাব মেলাতে চাইছে শৈশবের বরিশালে ঘটে যাওয়া ভয়ংকর এক অন্যায়ের সঙ্গে পরের এক নৃশংস সাম্প্রদায়িক খুনের; আর নিঃস্ব হয়ে যাওয়া এক লোককে তারই স্বদেশী ধনী বড় ভাই সাহায্য করতে রাজি কেবল ওই নিঃস্ব মানুষটার স্ত্রীকে বিছানায় নিতে পারার শর্তেই। সেইসঙ্গে বিশ শতকের শ্রেষ্ঠতম রাশিয়ান কবি ওসিপ মান্দেলশতামের বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাহরণকারী হত্যাকাণ্ড যত তার জট খুলছে, তত স্পষ্ট হচ্ছে যে কেন লেখকের ক্ষমতা রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বিপরীতমুখীভাবে ক্রিয়াশীল।

বইমেলায় কথাপ্রকাশ স্টলে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ কিনতে ভিড় পাঠকদের-

মান্দেলশতাম বলেছিলেন, ‘ক্ষমতা তুমি ততটাই জঘন্য, যতখানি নাপিতের আঠা-আঠা আঙুলগুলি।’ এই ভাষার জন্যই কি জীবন দিতে হল তাকে? লেখক-কবি-শিল্পীরা কি শাসকের সঙ্গে চিরকাল ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে শাসকের চেয়ে তার ভাষা ও মানসিকতা দৃঢ়তর বলেই? এমন কি যে, তারা আন্ডারগ্রাউন্ডের সত্যকে বোঝেন বলেই ওপরের পরিস্থিতির রাজনৈতিক সত্যটুকু তাদের কাছে তামাশা বা ইয়ারকি মাত্র?
ওভারগ্রাউন্ডে কি তাহলে কোনো ‘সত্য’ নেই? শেষ বিচারে ‘সত্য’ আছে কি কেবল আন্ডারগ্রাউন্ডে, যেহেতু ওখান থেকেই প্রসেস করা হয় মাটির ওপরের মৃত্যুগুলি? আর বিপ্লবের পরে রাষ্ট্র যে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং ব্যক্তি আরও শক্তিহীন, সেটাও কি কেউ নিশ্চিত করে দেয় ওই আন্ডারগ্রাউন্ডে বসেই?
উপন্যাসে আন্ডারগ্রাউন্ডের কালো প্রান্তরে নায়কের সঙ্গে দেখা হয় সাক্ষাৎ শয়তানের। যে-মুহূর্তে নায়ক বুঝতে পারে শয়তান, নরঘাতক ও জাঙ্গিয়া-পরে-নাচা নীতিনির্ধারকদের দেখবার জন্য নরকের ওই দিকটায় যাবার আসলে দরকারই নেই, শয়তান তখুনি তাকে বলে দেয়: ‘রোসনলাল, নরঘাতক, গেট আউট ফরোম দিস উন্টারগ্রুন্ড।’

আন্ডারগ্রাউন্ড সম্পর্কে উপন্যাসিক তাঁর ফেসবুক পেজে লিখেছেন, আমার এসব তুর পাহাড়ের ধর্মীয় বা গায়েবী কথাবার্তায় বিশ্বাস নেই। আমি মনে করি, খাটতে খাটতে এমনকী একদিন ‘শব্দ‘ নামের ফোনেটিক ইউনিটে খামখেয়াল মতো ঠিকই নিজের মনপছন্দ মিনিংও যুক্ত করা যায়। আমি মন ভরে সেটা করেছি ‘আন্ডারগ্রাউন্ড‘-এ, যেখানে এমন সব শব্দ আছে যা কোনো ডিকশনারিতে নেই। ওই সাহসটাই এই আমি আগে কিন্তু পাইনি আমার আগের দু উপন্যাস ও দু কবিতার বইয়ে। যেমন, এবারের এক কবিতায় লিখলাম ‘তারিন্দ’-এর কথা। বাস্তবে ‘তারিন্দ‘ নামের কোনো পশু নেই, কিন্তু আমার মনে হল যে, যে-দানব মানুষের মৃত্যু ঘটাতে আসে, তার নাম যম না, তার নাম তারিন্দ। অতএব, লিখতে-লিখতে লেখার ব্যাপারটা রপ্ত করতে করতে নিজের ভোকাবুলারি তৈরি করা অবশ্যই সম্ভব। কে বলেছে নতুন ভাষা শুধু নেতার আর মোল্লার আর যাজকের আর রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের সম্পত্তি?

দেশ থেকে দেশে তারা দেখবেন প্রায়ই কথা বলেন একদম নতুন ভাষায়, নতুন ধাঁচে, মানে যখনই তারা চান যে, বৃহত্তর জনতার ব্রেনওয়াশ করতে হবে। আমি বলতে চাই, তারা পারলে লেখকও ‘সজ্ঞানে‘ করতে পারেন সেটা।

সুতরাং লেখালেখি, তর্কের খাতিরেই মানছি, কিছুটা ‘অজ্ঞান‘ সৃজনশীলতা—আর বেশিটা ‘সজ্ঞান‘ এক প্লাস্টিক-নির্মাণকর্ম। লেখককে বেশি লিখতে হয় ওই দরজার কাছে পৌঁছাতে, যে-দরজা একদিন আপনার সামনে এসে দাঁড়ায় আপনি কাগজে কলম ঘষার আর্টটা ধীরে ধীরে হাতের মুঠোয় নেওয়া শিখলে পরেই (আমি কলম দিয়ে এ-ফোর সাইজ সাদা কাগজেই লিখি, কম্পিউটারে না)। তাই মিনিমাম পাঁচ উপন্যাস ও পাঁচ কবিতার বইয়ের চৌহদ্দিতে আমার ওই চুন দিয়ে দাগ টানা।

আমার এসব কথা শুনে যারা আমাকে কম চেনেন বা চেনেন না, তারা বলবেন আমি আলগা বিনয় করছি। কিন্তু আমি আলগা বিনয়-টিনয়ের ধারেকাছের মানুষ না। তাই ঘনিষ্ঠ যে-কজন জানেন আমার গোপন এই বিশ্বাসের কথা, তারা জানেন আমি এসব আমার নিশ্চিত ও নিঃসন্দেহ বিশ্বাস থেকেই বলি। সেজন্যই, সে কারণেই, বিষাদটা এমন যে—মানুষ এভাবে কম-বেশি আমার বই কিনে তো কিছু অ্যাভারেজ বা মোটামুটি-অ্যাভারেজ লেখাই পড়ছে শুধু। কবে আমি লিখব আমার ভাল লেখাগুলো? কবে লেখা সিনথেটিক হয়েও তথাকথিত দৈব-প্রদত্ত হবে?

অমর একুশে গ্রন্থমেলায় ‘কথাপ্রকাশ’ স্টলে পাওয়া যাচ্ছে আন্ডারগ্রাউন্ড।