৪০০ কোটি টাকা জামানত দিয়ে ব্যাংক খাতে কারা লাভবান হচ্ছে!
গিয়াসউদ্দীন মানিক : আরও দুটি নতুন ব্যাংক অনুমোদন পাচ্ছে বলে ক’দিন যাবৎ আলোচনায় আসছে। ৫৬টি সিডিউল ব্যাংকের পর সীমান্ত ব্যাংকসহ বর্তমানে ব্যাংকের সংখ্যা ৫৭। সব মিলিয়ে শাখার সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। আরও ব্যাংক কেন, বা বিদ্যমান ব্যাংকগুলোর প্রকৃত অবস্থা কী_ এ পর্যালোচনা একান্ত প্রয়োজন। ১৯৯১ থেকে ব্যাংকিং সেক্টরে এবং প্রায় দেড় যুগ শাখা পরিচালনায় সরাসরি দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে বর্তমান ব্যাংকিং অভ্যন্তরে সুস্থতার চাইতে অসুস্থতাই অধিক বলে প্রতীয়মান।
ব্যাংক কী করে বা কী চায়? এমন প্রশ্নে প্রাসঙ্গিকভাবে বলতে হয়, ব্যাংক একটি সেবাধর্মী আর্থিক প্রতিষ্ঠান। প্রধানত, জনগণের আমানত নিশ্চিত সুরক্ষা প্রদানের মাধ্যমে চাহিবামাত্র গ্রাহককে ফেরত দিয়ে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধিবদ্ধ নিয়ম ও ব্যাংক কোম্পানি আইন-১৯৯১ অনুসারে আমানতকৃত পুঞ্জীভূত সঞ্চয় থেকে উদ্যোক্তাদের মধ্যে আর্থিক জোগান দিয়ে অর্থনীতিতে চালিকাশক্তির কাজ করে।
বিনিময়ে লাভসহ অর্থ ফেরত আনে। সেই লাভের অর্থ ব্যাংক পরিচালনা ব্যয়, আমানতকারীদের লভ্যাংশ প্রদান ও প্রভিশন সংরক্ষণের পর নিট লাভ পরিচালক তথা শেয়ার হোল্ডারদের মাঝে ডিভিডেন্ট আকারে বণ্টিত হয়ে থাকে।
৪শ’ কোটি টাকা জামানত দিয়ে প্রাইভেট উদ্যোক্তারা ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় এত আগ্রহী কেন? বাংলাদেশ সৃষ্টির এক যুগ পর সর্বপ্রথম প্রাইভেট সেক্টরে ব্যাংক অনুমতি লাভ করে। ব্যক্তিগতভাবে নূ্যনতম ৫/১০ লাখ টাকা জামানত পরিশোধ করেই তখন অনেকে ব্যাংকের পরিচালক হন। প্রথমদিকে প্রাইভেট ব্যাংকিং কিছুটা প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে গেলেও ১৯৮৬-পরবর্তী সময়ে ব্যাংকগুলোর নিট মুনাফা দৃষ্টিগোচর হতে থাকে।
সঙ্গে সঙ্গে উদ্যোক্তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়। মুনাফার চিন্তা মাথায় না নিয়েই প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকের তরতর প্রবৃদ্ধির কারণে নতুন নতুন উদ্যোক্তা ব্যবসায়কে মুখ্য বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হন। ২য়, ৩য় সর্বশেষ ৪র্থ প্রজন্মের ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় আগ্রহ, তদবির ও রাজনীতিকে সরাসরি ব্যবহারের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ মুনাফাকেন্দ্রিক। ৪শ’ কোটি টাকা জামানত ও বিশাল অংকের অঘোষিত প্রাসঙ্গিক ব্যয় মাথায় নিয়ে ব্যাংক চালু করার পর সেবার দিকটা একদিকে রেখে সব কর্মকাণ্ডের মূল মুনাফা অর্জন হওয়া অস্বাভাবিক নয়। সব উদ্যোক্তাই মূলত ব্যবসায়ী। তাই যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগ করেই তারা এ পথ বেছে নিয়েছেন।
বিগত ৩ বছর বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত ভারসাম্যহীনভাবে চলছে। শুধু আমানতের সুদহার কমেছে, তাই নয়। ব্যাংক টু ব্যাংক সুদহার ৫০% পর্যন্ত পার্থক্য লক্ষণীয়। ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে এসেছে বটে, সে ক্ষেত্রেও গ্রাহক টু গ্রাহক, ব্যাংক টু ব্যাংক অনেক পার্থক্য বিরাজমান, যা অসুস্থ ও ভারসাম্যহীন প্রতিযোগিতার বড় উদাহরণ। এদিকে ৪র্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলো জনআস্থা (অভাব) বিবেচনায় বেশি হারে সুদ দিয়ে আমানত নিচ্ছে। নতুন বলে তাদের প্রশাসনিক ব্যয়ও বেশি। ফলে সিঙ্গেল ডিজিটে ঋণ দিতে পারছে না, যা পুরো আর্থিক খাতে অস্থিরতার প্রকট চিত্র।
মুনাফার পথ কী? আগেই বলেছি, জনগণের সঞ্চিত আমানত উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিনিয়োগ করে লাভসহ ফেরত আনার মধ্যেই মুনাফা লুক্কায়িত। তাই ব্যাংকারদেরই খুঁজে বের করতে হয়, কোথায় এবং কীভাবে অর্থ লগি্ন করা যায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রায় ১০ হাজার ব্যাংক শাখা সঠিক খাতে বিনিয়োগ করে কাঙ্ক্ষিত মুনাফা অর্জন যে কত কঠিন এবং বাস্তবতাবিবর্জিত, তা সবচেয়ে বেশি জ্ঞাত যারা সরাসরি এ পেশায় সম্মুখ সারিতে অবস্থান করেন।
মালিকপক্ষের চাপে ম্যানেজমেন্ট থাকে দিশেহারা। সেই চাপ পড়ে শাখার ওপর। অসম ‘টার্গেট’ মাথায় নিয়ে শাখা পরিচালক ব্যবসায় অন্বেষণে দিগ্গি্বদিক ছুটতে থাকেন। টার্গেটের চাপে, চাকরির মায়ায় ত্রাহি ত্রাহি অবস্থার সুযোগ নিচ্ছেন আরেক শ্রেণির ‘পরিকল্পিত ব্যবসায়ীরা’।
মুনাফার আশায় প্রয়োজনের তুলনায় অধিক বিনিয়োগ, সম্পদের অতি মূল্যায়ন, অপাত্রে বিনিয়োগ ইত্যাদি কারণে ঋণ কু-ঋণে পরিণত হচ্ছে। সম্পদের গুণমান দিন দিন খারাপ হয়ে পরের অর্থে পরিচালিত সেক্টরটি প্রচ্ছন্নভাবে বিরূপ হয়ে যাচ্ছে। মুনাফা বিবেচনায় অনেক সময় হিসাবের প্রকৃত অবস্থা ব্যালান্স শিটে গোপন করা হচ্ছে। কিছু বড় গ্রাহক পরিকল্পিত খেলাপি হয়ে ঋণ অবলোপনের সুবিধা নিচ্ছে। অরক্ষিত(!) চাকরি হারিয়ে সাজা খাটছেন দুর্ভাগ্যের বলি অগণিত ব্যাংকার। বাস্তবে, জনআস্থার ওপর প্রতিষ্ঠিত আমানতদার সেক্টরটি গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার উপক্রম।
নতুন ব্যাংক অনুমোদনের চিন্তা বাদ দিয়ে এখন সর্বাগ্রে উচিত হবে আর্থিক বিবেচনায় দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করে শুধু মুনাফা অর্জনের ক্ষেত্র বিবেচনা না করা ও শক্ত হাতে সেক্টরটিতে সুশাসন আনয়ন।
সুতরাং আর নতুন ব্যাংক অনুমোদন নয়। বিদ্যমান ব্যাংকগুলোকে সুস্থ ও টেকসই পরিবেশে পরিচালনার মাধ্যমে অগ্রসর হতে হবে। নতুবা এ সেক্টরের বিশৃঙ্খলা এক সময় পুরো অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মাধ্যমে দায়দায়িত্ব সরকারের ঘাড়ে নিপতিত হয়ে ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধির কাঁটা নিম্নগামী হতে বাধ্য।