• সোমবার , ৬ মে ২০২৪

সংকটে বিএনপি- ভোটের পর কি আন্দোলন হবে!


প্রকাশিত: ১১:১৪ পিএম, ৪ জানুয়ারী ২৪ , বৃহস্পতিবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ২১ বার

গত ৬ মাসে বিভিন্ন আদালতে ৮৪টি মামলায় বিএনপির প্রায় দেড় হাজার নেতাকর্মীকে সাজা দিয়ে রায় ঘোষণা করা হয়েছে। এ অবস্থায় আন্দোলনের মাঠ এমনিতেই ঝিমিয়ে পড়বে বলে শংকা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা।

 

 

 

বিশেষ প্রতিনিধি : মাত্র ২ দিন পর ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ভোট হয়ে যাচ্ছে এটা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করেছে নির্বাচন কমিশন। ভোট ঠেকাতে পারেনি বিএনপি। এটা বিএনপির যেমন ব্যর্থতা তেমনি নেতাকর্মীদের জন্যে এটা বড় ধরনের হতাশা। দলের অভ্যন্তরে ইতিমধ্যে বিএনপির ভোট বিরোধীতার ফল কি এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারেক রহমান বিরোধীরা। দেখা গেছে, ভোটের পক্ষ বিপক্ষ দুটো শক্তিই বিএনপিতে বিরাজমান। একপক্ষ ভোটে থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু ওপর থেকে চাপিয়ে দেয়া দলীয় সিদ্ধান্তে নেতা কর্মীরা তা মানতে বাধ্য হয়। কিন্তু এতে অনেকের সায় ছিল না। আবার মুখ ফুটে কেউ বলতেও পারেনি। এমন অবস্থায় ভোটের পর কি রাজনীতি তা নিয়ে চিন্তিত বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা। তারা বলছেন, ভোটের পর কি তাহলে গভীর সংকটে পড়তে যাচ্ছে বিএনপি!

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ভোটের পর অস্তিত্ব সংকটে পড়তে পারে বিএনপি। কারণ, এখনকার মতো রাজনৈতিক আন্দোলন তখন আর হয়ত থাকবে না। তখন বড় ধরনের সংকটে পড়বে বিএনপির রাজনীতি। কারণ, এমনিতেই গত ৬ মাসে বিভিন্ন আদালতে ৮৪টি মামলায় বিএনপির প্রায় দেড় হাজার নেতাকর্মীকে সাজা দিয়ে রায় ঘোষণা করা হয়েছে। এ অবস্থায় আন্দোলনের মাঠ এমনিতেই ঝিমিয়ে পড়বে বলে শংকা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা।

নির্বাচন কমিশনের দৃঢতায় বোঝা যায়, ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়ে যাচ্ছে বড় ধরনের কোনো সমস্যা ছাড়াই। ইতিমধ্যে জাতীয় পার্টিকে ২৬টি ও ১৪ দলের শরিকদের ৬টি আসন ছেড়ে দেওয়ায় ভোটের মাঠে এখন আওয়ামী লীগের একচেটিয়া প্রভাব। এমন পরিস্থিতিতে সরকারবিরোধী বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি অসহযোগের ডাক দিয়ে ভোট বর্জন কর্মসূচি ঘোষণা করলেও মামলার চাপে কোণঠাসা ছাড়াও আন্দোলনও চলে চোরাগোপ্তা অবস্থায়।

বিএনপির একাধিক সূত্র বলছে, দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসসহ শীর্ষ নেতারা কারাবন্দি, অনেকেই আত্মগোপনে। দলের শীর্ষ সারির নেতা আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, রুহুল কবির রিজভী আহমেদ, জয়নুল আবদিন ফারুকসহ বাইরে যারা আছেন- তাদের বিরুদ্ধেও রয়েছে একাধিক মামলা। যেকোনো সময় গ্রেপ্তার করা হতে পারে তাদের, এমন বক্তব্যও আসছে পুলিশের পক্ষ থেকে।
টানা দুই মাসের বেশি সময় ধরে দলটির কার্যালয়ে ঝুলছে তালা। সবমিলিয়ে আন্দোলন নিয়ে রাজপথে দাঁড়াতেই পারছে না বিএনপি। মোটকথা দলটির নেতাকর্মীদের টিকে থাকাই দায় হয়ে পড়েছে।

এ অবস্থায় নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডই নয়, বিএনপির রাজনৈতিক অধিকার নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। মানবাধিকারকর্মী ও বিশ্লেষকরা বলছেন, দলটির রাজনৈতিক অধিকার ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে।
বিএনপির অভিযোগ, বিগত কয়েক বছর ধরেই সারা দেশে দলটির নেতাকর্মীরা হামলা-মামলা ও নিপীড়নের শিকার। গ্রেপ্তার এড়াতে অনেক বছর ধরেই বাড়ি ছেড়ে পলাতক রয়েছেন দলটির নেতাকর্মীরা। এরপরও ওই পলাতক নেতাদের বাড়িতে চলছে পুলিশের অভিযান। বিএনপি নেতাকর্মীদের না পেয়ে পরিবারের সদস্যদের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটছে। কেউ কেউ বেশকিছু দিন নিখোঁজের পর শোনা যাচ্ছে গ্রেপ্তারের খবর। কারও কারও খোঁজই মিলছে না। বিএনপির পক্ষ থেকে এসব অভিযোগের তীর সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকেই ছোড়া হচ্ছে। তবে সরকার, ক্ষমতাসীন দল ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করছে।

বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচনের পর যে সংসদ গঠিত হবে, সেখানে জাতীয় পার্টি এবং ১৪ দলীয় জোটের কয়েকজন ব্যতীত সবাই আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সদস্য বলেই আপাতত মনে হচ্ছে। অর্থাৎ বিগত ১৫ বছরের ধারাবাহিকতায় টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আসছে আওয়ামী লীগ।

বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, গত বছরের ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ কেন্দ্র করে এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন ২৪ হাজারের বেশি নেতাকর্মী। বিভিন্ন হামলায় গত ২ মাসে মারা গেছেন অন্তত ২৫ জন এবং আহত প্রায় ৭ হাজার। গত বছরের জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৮৪টি মামলায় ৯ জনের ফাঁসির আদেশ ও শীর্ষ নেতাসহ প্রায় ১৩০০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। গত অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত কারা হেফাজতে মারা গেছেন কমপক্ষে ৯ জন।

অন্যদিকে সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে দাবি করা হয়েছে, এই সময়ে বিএনপির প্রায় ১১ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে সংখ্যার তফাত থাকলেও গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত। সবমিলিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই রাজপথে আন্দোলনকারী দল বিএনপির রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে নানা প্রশ্ন।

আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘আর্টিকেল নাইন্টিন’ এর দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুক ফয়সলের মতে, স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কোনো রাজনৈতিক দলের এমন নির্মম পরিস্থিতি তিনি দেখেননি। তিনি বলেন, র‌্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কমে আসলেও কারা হেফাজতে মৃত্যু, বিনাবিচারে সাজা ও গ্রেপ্তার বেড়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মূল কথা বন্দির সংখ্যা কারাগারের ধারণ ক্ষমতা ছাড়িয়ে গেছে। মানবাধিকারকর্মী ও বিশিষ্ট আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, এসব ঘটনায় স্পষ্ট যে, কারা কর্তৃপক্ষদের দেশের মধ্যে আলাদা সংবিধান দিয়ে দেওয়া হইছে। কনডেম সেল তো সারা দুনিয়া থেকে উঠে গেছে, কিন্তু আমাদের দেশে আরও প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।

নিখোঁজ বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন ও ‘মায়ের ডাক’ সংগঠনের সমন্বয়কারী সানজিদা ইসলাম বলেন, নির্বাচন কেন্দ্র করে নিখোঁজ ও উঠিয়ে নেওয়ার ঘটনা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। যাদেরকে ৫ থেকে ৭ দিন পর ফেরত দেওয়া হচ্ছে তাদের নখে ব্যান্ডেজ করা। আর যারা এত বছর ধরে নিখোঁজ, শুধু আল্লাহ-মাবুদ জানেন তাদের অবস্থা!তবে এসব ঘটনাকে রাজনৈতিক নিপীড়ন বা মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে দেখেন না জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, ২৮ অক্টোবর থেকে শুরু করে সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে, সাধারণ মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। এখন তো বিচারিক কার্যক্রম চলমান আছে। এখানে মানবাধিকারের বিষয় হচ্ছে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।
তার দাবি, কোনো রাজনৈতিক দল হিসেবে কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি, অপরাধী এবং অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডে বিচার করা হচ্ছে। কারা হেফাজতে মৃত্যুর অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি।

ওদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যে বিএনপির কারাবন্দিদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছে বিএনপি।

বিএনপি নেতা কর্মীরা বলছেন, ২০২৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর সীতাকুণ্ডের বারৈয়াঢালা ইউনিয়নের লালানগরে যুবদলের সহ-সভাপতি ইসমাইল হোসেনকে না পেয়ে তার বড় ভাই নুরুল মোস্তফা বজলকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটে।এর আগে ২০২২ সালে বিএনপির ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ ঘিরে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মাঝে ৭ ডিসেম্বর রাতে রাজধানীর ওয়ারীতে নিজ বাড়িতে সন্ত্রাসীদের অতর্কিত হামলায় নিহত হন ওয়ারী থানা যুবদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ফয়সাল মেহবুব মিজুর বাবা মো. মিল্লাত হোসেন। সেসময় মিজুর চাচা শাহাদাত হোসেন স্বপনকে তুলে নিয়ে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

২০২২ সালের ২০ ডিসেম্বর হাতকড়া আর ডান্ডাবেড়ি নিয়ে মা সাহেরা বেগমের জানাজা পড়েছেন গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বোয়ালী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আলী আজম।
তবে ২০২৩ সালের ২১ অক্টোবর মৃত মায়ের জানাজা পড়তে পারেননি মিরসরাই উপজেলা বিএনপির সদস্যসচিব গাজী নিজাম উদ্দিন। বাড়ি ছেড়ে পলাতক অবস্থায় মায়ের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে জানাজায় উপস্থিত হয়েও পুলিশের ভয়ে আবার পালিয়ে যান তিনি। এ ধরনের ঘটনাকে বর্বরতা আখ্যায়িত করেছেন মানবাধিকারকর্মী ফারুক ফয়সল।