• রোববার , ১৯ মে ২০২৪

মতিঝিল ঘরোয়ার মালিক সোহেল যেভাবে গুলি করে মারল কর্মচারী রিয়াদকে


প্রকাশিত: ৪:২২ পিএম, ৩০ অক্টোবর ১৫ , শুক্রবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৭৩ বার

garowa shohel-www.jatirkhantha.com.bdএস রহমান:   কথিত টাকা ও মোবাইল ফোন চুরির অভিযোগে নিজেই আইন হাতে তুলে নিলেন মতিঝিল ঘরোয়ার মালিক সোহেল।এরপর কর্মচারী রিয়াদকে ওয়ারীর স্বামীবাগের ৭৩ নম্বর নির্মাণাধীন ভবনে নিয়ে টিনশেড ঘরে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে লাঠি দিয়ে পিটান।এরপর রিয়াদের নিথর দেহ সোজা করে গুলি করে হত্যা করেন সোহেল।পরে ঘটনা ধামাচাপা দিতে ছিনতাই এর কথিত নাটক সাজান বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের জাতিরকন্ঠকে জানিয়েছেন।

মতিঝিলের ঘরোয়া হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের কর্মচারী রিয়াদ হোসেনকে পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যার এ ধরনের রোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে তারা বলেছেন, টাকা ও মোবাইল ফোন চুরির অভিযোগে মঙ্গলবার গভীর রাতে কিশোর রিয়াদকে ওয়ারীর স্বামীবাগের ৭৩ নম্বর নির্মাণাধীন ভবনে নেওয়া হয়। সেখানে ঘরোয়ার কর্মচারীদের থাকার টিনশেড ঘরে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রিয়াদকে লাঠি দিয়ে পেটান হোটেলের মালিক আরিফুল ইসলাম সোহেলসহ ছয়-সাতজন।

ওয়ারী থানার ওসি তপন চন্দ্র সাহা জাতিরকন্ঠকে জানান, হোটেল মালিক সোহেলই কিশোর রিয়াদকে গুলি করে হত্যা করেন। তাকে ও খবির নামে অপর এক আসামিকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে। এরই মধ্যে এজাহারভুক্ত আসামি জসীমকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
মঙ্গলবার গভীর রাতে রাজধানীর ওয়ারীর স্বামীবাগ এলাকায় ১৬ বছরের রিয়াদকে হত্যা করা হয়। এর পর ঘটনাটি ভিন্ন খাতে নিতে ছিনতাইকারীদের গুলিতে নিহত হওয়ার গল্প সাজান সোহেল। এ ঘটনায় নিহতের ভাই রিপন হোসেন বাদী হয়ে সোহেল, জসীম ও খবিরের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেছেন।

তাদের মধ্যে দু’জন হলেন হোটেলটির গ্রিল কারিগর জসীম ও মেসিয়ার খবির। এ সময় রিয়াদ চিৎকার করে তাদের কাছে প্রাণভিক্ষা চায়। কিন্তু তাতে মন গলেনি সোহেলসহ অন্যদের। এক পর্যায়ে উত্তেজিত সোহেল তার সঙ্গে থাকা পিস্তল রিয়াদের ডান চোয়ালে ঠেকিয়ে গুলি করেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনার পাশাপাশি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ ও প্রাথমিক তদন্তেও সোহেলের হত্যাসংশ্লিষ্টতা বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। তার দেশত্যাগ ঠেকাতে বিমানবন্দর, স্থলবন্দরসহ সীমান্তের সব পয়েন্টে সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছে।

এদিকে হত্যায় প্রধান অভিযুক্ত সোহেলের ভাই শহিদুল ইসলাম রাসেল ঘটনাটি ‘মীমাংসা’ করার চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ জন্য গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে রাসেল ফোন করে নিহত রিয়াদের ভাই রিপনকে গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় আসতে বলেছেন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ওয়ারী থানার পরিদর্শক (অপারেশন) আলীম হোসেন শিকদার বলেন, মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে পুরো ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থলটি হোটেল কর্মচারীদের থাকার জায়গা হওয়ায় সেখানে অনেকেই ছিলেন। এর মধ্যে নিহতের খালাত ভাই মাইনুদ্দিনও উপস্থিত ছিলেন। তিনিসহ আট থেকে ১০ জন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাক্ষী পাওয়া গেছে। তারা পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে ঘটনার বিস্তারিত জানিয়েছেন।

এর ফলে হত্যার দায় থেকে সোহেলের রেহাই পাওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই। তাকে দ্রুত গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নেওয়া হবে। পাশাপাশি তার সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করবে পুলিশ।সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও তদন্তের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, রিয়াদকে নিয়ে মঙ্গলবার রাত পৌনে ১টার দিকে স্বামীবাগের নির্মাণাধীন ভবনে ঢোকেন সোহেল। এ সময় তার সঙ্গে আরও কয়েকজন কর্মচারী ছিল। তাদের হাতে লাঠিও দেখা গেছে।

এর পর রিয়াদকে টিনশেড ঘরে নিয়ে পেটাতে পেটাতে ‘চুরি করা’ টাকা ও মোবাইল ফোন ফেরত দিতে বলা হয়। রাত ১টার দিকে সোহেল তার সঙ্গে থাকা পিস্তল দিয়ে রিয়াদের ডান চোয়ালে ঠেকিয়ে গুলি করেন। এর পর ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ার গল্প ফাঁদেন সোহেল। পরে তিনি ও জসীমসহ তিনজন রিয়াদের নিথর দেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে তারা মতিঝিলের শাপলা চত্বরে ছিনতাইকারীর গুলিতে ‘আহত’ হওয়ার গল্প বলেন।

পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, সোহেলের লাইসেন্স করা একটি আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। তবে হত্যায় সেটিই ব্যবহার করা হয়েছে কি-না তা ফরেনসিক পরীক্ষার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে।তদন্ত কর্মকর্তা জানান, হত্যার পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হোটেলের ব্যবস্থাপক ও কর্মচারীসহ বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়। এরই মধ্যে তাদের অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বাকিদেরও ছেড়ে দেওয়া হবে।

নিহতের ভাই রিপন হোসেন বলেন, গতকাল দুপুর ১টার দিকে ঘরোয়া হোটেলের মালিক সোহেলের ভাই রাসেল তাকে ফোন করে ঢাকায় আসতে বলেন। রিয়াদ হত্যার ব্যাপারে কথা বলার জন্যই তিনি ডেকে পাঠান। তবে স্বজনরা রিপনকে তার সঙ্গে দেখা করতে নিষেধ করেছেন। বিষয়টি তারা পুলিশকেও জানিয়েছেন। এর আগে সকালে গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার হাড়িয়াইন সাহেববাড়ি এলাকায় রিয়াদের লাশ দাফন করা হয়।

সোহেলের ভাই রাসেলের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য গতকাল তার মোবাইল ফোনে কল করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। সোহেল ও হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের নম্বরগুলো বুধবার থেকে বন্ধ রয়েছে।সোহেলের শ্রমিক নির্যাতন ও বেপরোয়া আচরণের ঘটনা এটিই প্রথম নয়। হোটেলটির শ্রমিক ও সংশ্লিষ্টদের সূত্রে জানা যায়, কথায় কথায় অধীনস্তদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও মারধর করেন সোহেল। এ ছাড়া প্রায়ই তিনি নিজের অস্ত্র বের করে লোকজনকে হুমকি দেন। পুলিশের এক শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে তার সখ্য রয়েছে বলে প্রচার করে নানা রকম অন্যায় সুবিধা নিতেন। তার হোটেলে অস্ত্র-মাদকের লেনদেন হয় বলেও তথ্য রয়েছে। চলতি বছরেই সেখান থেকে অস্ত্রসহ দুই সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ঘরোয়া হোটেলের ভবনটির মালিক হামিদ আলী চৌধুরী জানান, ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে দুই বছর ধরে ভাড়া দেন না সোহেল। তিনি মাদকাসক্ত বলেও জানা যায়।

মঙ্গলবার রাতে রিয়াদকে হত্যার পর বুধবার থেকে ঘরোয়া হোটেলের মতিঝিল শাখা বন্ধ রয়েছে।আমাদের চাঁদপুর প্রতিনিধি জানান, বৃহস্পতিবার সকালে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার ৮নং হাটিলা পূর্ব ইউনিয়নের হাড়িয়াইন এলাকার গ্রামের বাড়িতে রিয়াদের মরদেহ পৌছে। পরে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়। এ সময় আশপাশের হাজারো মানুষ ওই বাড়িতে ভিড় জমান। এদিকে ছেলের খুনের ঘটনা কোনোভাবেই মানতে চাচ্ছেন না মা রোকেয়া বেগম, আত্মীয়-স্বজন ও এলাকাবাসী।