• মঙ্গলবার , ৭ মে ২০২৪

পাকিস্তানের ‘ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন’ অমাণ্য-আন্তজার্তিক আদালতে বিচারযোগ্য অপরাধ


প্রকাশিত: ৬:৫৩ পিএম, ২৭ নভেম্বর ১৫ , শুক্রবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৫১ বার

1971_surrender_of_Pakistan-www.jatirkhantha.com.bdডা. এম এ হাসান  :  পাকিস্তানের ‘ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন’ অমাণ্য আন্তজার্তিক আদালতে বিচারযোগ্য অপরাধ। লক্ষ প্রাণের মর্যাদা, অগণিত আত্মার দীপাবলি এবং সামগ্রিক শান্তিকে যে পৈশাচিক দানব নিষ্পেষিত করেছিল ‘৭১-এ, সেই অপশক্তি ঘটনার ৪৪ বছর পর আবার তাদের দানবতুল্য মুখচ্ছবি প্রদর্শন করছে। এই দানবটি আর কেউ নয়। এ চিরচেনা পাকিস্তান, তাদের অনুচর ও দোসররা।

এরাই আজ তাদের পোষ্য অনুচর তথা ঘাতককুলের বিচারে মর্মাহত হয়ে আমাদের দেশের (বাংলাদেশ) মর্যাদার ওপর আঘাত হানছে। সীমাহীন আস্পর্ধায় সব শিষ্টাচার তথা নানা ‘ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন’ সমর্থিত আন্তর্জাতিক আইন ও বাধ্যবাধকতা অমান্য করে একটি স্বাধীন দেশের বিচারকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে ওই পাকিস্তান ও তাদের সমর্থকরা। এটি নিজেই একটি বিচারযোগ্য অপরাধ।

মানবতাবিরোধী অপরাধ তথা গণহত্যার বিচার যা কিনা প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যবাধকতা এবং ‘অবলিগেশন’; সে কাজটি নিজে না করে এমন কাজে বাধা দিয়ে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক কনভেনশনকেই চ্যালেঞ্জ করছে। এই দুটি কারণে পাকিস্তানের বিচার হতে পারে হেগের আরবিটারি আদালতে এবং আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্টে। আমাদের রাষ্ট্র কি পারে না এমন উদ্যোগটি নিতে!

১৯৭১-এ সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সম্পৃৃক্ত ১৯৫ জনের বেশি পাকিস্তানি সামরিক অফিসার এবং অন্য সদস্যদের বিচার না করে পাকিস্তান যে অপরাধ করেছে, তারই বিচার হওয়াটা এখন সময়ের দাবি। ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল পাকিস্তান, ভারত এবং বাংলাদেশ যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সম্পাদন করে, তার মূল লক্ষ্য ছিল বন্দি সেনা ও অবরুদ্ধ জনগণের রিপ্যাট্রিয়েশন। শান্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু যে Conditional Clemency কথা বলেছিলেন, তা কোনো অবস্থায় অ্যামনেস্টির সমার্থক নয়। ভুট্টো নিজ দেশে ওই সেনাদের আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে বিচারাধীন না করায় বঙ্গবন্ধু ক্ষুব্ধ ও বিরক্তবোধ করছিলেন। এ কারণেই বঙ্গবন্ধু ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ সালে সংসদে দাঁড়িয়ে দেশীয় রাজাকারদের ক্ষমার বিষয়ে বলেন_ ‘কোনো দেশের ইতিহাসে নাই বিপ্লবের পর বিপ্লবকে বাধা দিয়েছে যারা, শত্রুর সঙ্গে সহযোগিতা করেছে যারা; যারা দেশের মানুষকে হত্যা করেছে তাদের কোনো দেশে কোনো যুগে ক্ষমা করা হয়েছে। কিন্তু আমি করেছিলাম…। …বলেছিলাম, দেশকে ভালোবাসুন, দেশের জন্য কাজ করুন; দেশের স্বাধীনতাকে গ্রহণ করে নিন। কিন্তু তাদের অনেকের পরিবর্তন হয় নাই। তারা এখনও গোপনে বিদেশিদের কাছ থেকে পয়সা এনে বাংলার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন।’

২৬ মার্চ, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু তার এক ভাষণে বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম পাকিস্তানিরা নিশ্চয় দুঃখিত হবে, আমার (দেশের) সম্পদ ফেরত দেবে। আমি ওয়াদা করেছিলাম_ তাদের বিচার করব।’ এ বাস্তবতাতেই পাকিস্তানি ও তাদের সহযোগীদের বিচারের ক্ষেত্রে অগ্রগামী হতে হবে।

৯ এপ্রিল ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলেন, ‘এই সব যুদ্ধবন্দি যেসব বাড়াবাড়ি ও অপরাধ করেছে তা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত এবং আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং গণহত্যার পর্যায়ে পড়ে, এবং এই সার্বজনীন ঐকমত্য রয়েছে যে, যাদের বিরুদ্ধে ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দির মতো অপরাধের অভিযোগ; তাদের বিচার বিচারের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার স্বার্থেই হওয়া উচিত’; তখন পাকিস্তান সরকারের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী আজিজ আহমেদ জানান, ‘এ ধরনের কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকলে তার সরকার সে জন্য গভীরভাবে দুঃখ প্রকাশ করছে এবং এর নিন্দা করছে।’

ভুট্টো ওই অপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকার করেন। পরবর্তীকালে বেনজির ভুট্টো একই মনোভাব প্রকাশ করেন। তবে ভুট্টোর শঠতা ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরোধিতার কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। তাদের কোনো উদ্যোগ বা বিন্দুমাত্র সদিচ্ছার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

এ পরিপ্রেক্ষিতেই ৯ এপ্রিল ১৯৭৪-এর ওই চুক্তিটি বাংলাদেশের সার্বভৌম সংসদে অনুমোদিত হয়নি। এতে ‘৭৩-এর সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত আর্টিকেল ৪৭ এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন ১৯/৭৩-এর বলে ওই চুক্তি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অকার্যকর হয়ে ওঠে। এতে অবারিত হয় বিচারের ক্ষেত্র। আন্তর্জাতিক আইনে এ ধরনের অপরাধে Clemency বা Amnesty

কোনোভাবেই প্রযোজ্য নয় বা তা প্রয়োগের সুযোগ নেই এটি আইসিসির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আইনজ্ঞদের অভিমত। এ অপরাধের বাদী কেবল বাংলার জনগণ নয়; এ মামলার বাদী সভ্য পৃথিবী।

পাকিস্তানি ও তার সমর্থকরা যে শান্তির কথা বলে, তার ভিত্তি হতে হবে অপরাধ অনুধাবন, অপরাধীর বিচার ও রিকনসিলিয়েশনের বাস্তব উদ্যোগ। মুখ্য অপরাধীদের বিচারের সঙ্গে সঙ্গে রিপারেশন এই সমঝোতাকে এগিয়ে নিতে পারে। ‘৭১-এ পাকিস্তানের স্টেট ব্যাংকে সংরক্ষিত বিলিয়ন ডলারের গোল্ড রিজার্ভ ও অন্যান্য সম্পদ ফেরতের বিষয়টি অমীমাংসিত রেখে, জীবন ও সম্পদ নাশের ক্ষতিপূরণ তথা রেপ ভিকটিমদের রিপারেশন ইত্যাদি বিষয় সমাধান না করে সমঝোতা ও শান্তি নির্মিত হতে পারে না। মুখের বুলি আর ইসলামের ভ্রাতৃত্বের কপট ছোঁয়া দিয়ে ওই কাজটি হবে না। শান্তির জন্যই পাকিস্তানকে আত্মবীক্ষণ করতে হবে।

ওয়ার ক্রাইম্স ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির হাতে যে ৩৫৯ জন অপরাধীর আমলনামা রয়েছে তা তাদেরকেই পাঠ করতে হবে। এটা পাঠ করলে তারা মেজর নাদের পারভেজকে সাংসদ বানাতে পারতেন না। এ দেশে এসে নির্যাতিত নারী ও যুদ্ধশিশুদের মুখোমুখি হতে হবে তাদের প্রতিনিধিকে এবং তা করতে হবে তাদের রাষ্ট্রপ্রধান ও সেনাপ্রধানকে।

বলা বাহুল্য, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা বিষয়ক বিচারে অপরাধের ‘রিকগনিশন’ ও ‘রিপারেশন’ একটি আবশ্যক উপাদান। পাকিস্তানের মতো যে বর্বর দেশে এ ধরনের বড়মাপের অপরাধে অনুশোচনা নেই, এ সংক্রান্ত অনুভব নেই, বিন্দুমাত্র আত্মবীক্ষণ বা অনুতাপ নেই, সেখানে ন্যায়বোধের বাতাস আদৌ বইবে কি-না সন্দেহ। এক্ষেত্রে দেবতার দায়িত্ব অসুরকে বধ করা। বাংলাদেশের জনগণের দায়দায়িত্ব হলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে ‘৭১-এর ঘাতক তথা প্রাইম পারপেট্রেটর পাকিস্তানি ও তার সহচর অপশক্তির বিচার চাওয়া এবং আন্তর্জাতিক শক্তিকে তাদের দায়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া।আহ্বায়ক, ওয়ার ক্রাইম্স ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি।