নব্য জেএমবির সুইসাইডার নায়কদের খুঁজছে গোয়েন্দারা
বিশেষ প্রতিনিধি : হঠাৎ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে নব্য জেএমবিরা। এরা নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে আত্মঘাতি হামলার মত জঘন্য তৎপরতা চালাচ্ছে। গোয়েন্দারা বলছেন, ঘটনার নেপথ্যে দেশবিরোধী একটি চক্র জড়িত।এদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে বলে জাতিরকন্ঠকে জানিয়েছেন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা।
গোয়েন্দারা জানান, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মুখে যখন নব্য জঙ্গিরা কোণঠাসা ঠিক তখনই নব্য কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা রাখতে জঙ্গিদের একটি গ্রুপ আত্মঘাতী হামলা চালাচ্ছে। সহকর্মীদের দেখানোর চেষ্টা করে তাদের কার্যক্রমও থেমে নেই। তবে এদের তৎপরতার সঙ্গে দেশবিরোধী চক্রও জড়িত। এরা সরকারকে বিব্রত এবং অস্থিতিশীল করতে জঙ্গি তৎপরতায় ইন্ধন দিচ্ছে।
সূত্র মতে, গুলশানে হলি আর্টিজানে হামলার আট মাসের মধ্যে নতুন নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছে নব্য জেএমবি। এবার তারা আরও বড় আক্রমণের লক্ষ্যে সদস্যদের আত্মঘাতী হামলার জন্য প্রস্তুত করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১০ দিনে শতাধিক জঙ্গি সদস্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে গ্রেফতার হয়েছে। এছাড়া ৭ জন জঙ্গি এসব অভিযানে নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে অভিযান চলাকালে দুই জঙ্গি আত্মঘাতী হয়ে মারা যায়। আর দুই জন পুলিশের গুলিতে মারা গেছে। এছাড়া আশকোনা র্যাব ব্যারাকে আত্মঘাতী হয়ে মারা যায়। ওই ঘটনায় একজন গ্রেফতার হয়। পরে সেও মারা গেছে। এছাড়া গতকাল ভোরে র্যাবের তল্লাশি চৌকিতে গুলিতে এক যুবক নিহত হয়। তার শরীরেও বিস্ফোরক বাঁধা সুসাইডার ভেস্ট ছিল।
পুলিশ সূত্র জানায়, ৮ মার্চ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার চান্দিনায় গ্রেপ্তার হওয়া আহমেদ আজওয়াজ ইমতিয়াজ তালুকদারও জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, তাঁরা নতুন সদস্য সংগ্রহ করেছেন। একই সঙ্গে আত্মঘাতী হামলার প্রস্তুতি নিয়ে পরবর্তী আক্রমণের পরিকল্পনা করেছে তাদের সংগঠন।
সাবেক সেনা কর্মকর্তার ছেলে আহমেদ আজওয়াজসহ দুজন চট্টগ্রাম থেকে হাতে তৈরি বোমা নিয়ে ঢাকা আসার পথে ধরা পড়েন। তাঁরা এর আগে দুই বোমার দুটি চালান চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পৌঁছান বলে আজওয়াজ রিমান্ডে পুলিশকে বলেছেন।
ঢাকায় কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একটি সূত্র জানায়, ঢাকায় টানা অভিযান ও নজরদারির কারণে জঙ্গিরা প্রস্তুতির জন্য বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও চট্টগ্রামকে বেছে নেয়। এর বাইরে খুলনা, ঝিনাইদহ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজধানী ঢাকায় নব্য জেএমবি কিছু ‘সেফ হাউস’ বা আস্তানা গড়ে তুলেছে বলে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কাছে তথ্য রয়েছে।
এ সম্পর্কে পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক বলেন, এসব আত্মঘাতী হামলা করে কোনো লাভ হবে না। আমরা জঙ্গিদের কোনো ছাড় দেব না। আমরা কঠোর অবস্থানেই আছি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগে পুলিশের উপর যে বর্বরোচিত হামলা হয়েছিল সেখানেও ঘুরে দাঁড়িয়েছিল পুলিশ। এখনও সেই একইভাবে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে কাজ করছে পুলিশ। জঙ্গিদের নির্মূল না করা পর্যন্ত অভিযান চলবে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ২০০৫ সালে আগস্ট থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে জঙ্গিরা অনেকগুলো হামলা চালায়। এর মধ্যে ঝালকাঠিতে দুই বিচারককে আত্মঘাতী হামলার মাধ্যমে হত্যা করে জঙ্গিরা। এছাড়া গাজীপুরে বার ভবনে ঢুকে আত্মঘাতী হামলা চালায় জঙ্গিরা। সেখানেও ৭ জন নিহত হন। ওই ঘটনার পর গ্রেফতার হয় বেশ কিছু জঙ্গি। তখন তারা জানিয়েছিল একটি রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় তারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কিন্তু ওই রাজনৈতিক দলটি সরকারের সহযোগী হওয়ায় বিষয়টি তখন প্রকাশ পায়নি। ওই সময় গ্রেফতার হওয়া কয়েকজন জঙ্গিকে পরে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। তখনই ওই রাজনৈতিক দলের বিষয়টি ফাঁস হয়ে যায়।
গোয়েন্দা পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, জঙ্গিদের শেকড় উপড়ে ফেলার জন্য শুধু অভিযান দিয়ে হবে না। সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবেও সবাইকে কাজ করতে হবে। যারা এই ভুল পথে যাচ্ছে তারা একটা অন্ধ বিশ্বাস থেকে এই পথে যায়। সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়া বেশ কয়েকজনকে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তারা জিজ্ঞাসাবাদে শুধু বলে স্যার আমাকে মেরে ফেলেন আমি বেহেস্তে যাব। কিন্তু কোনোভাবেই সহকর্মীদের ব্যাপারে কোনো তথ্য দেয় না। এদের প্রশিক্ষণ ও মোটিভেট করা হয়েছে এমনভাবে যে, নির্যাতনে মরে গেলেও মুখ খুলবে না।
সীতাকুণ্ডে দুটি আস্তানায় অভিযানের পর পুলিশের চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপমহাপরিদর্শক মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেছেন, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যুক্ত বিদেশিদের লক্ষ্যবস্তু করে জঙ্গিরা সেখানে জড়ো হচ্ছিল।
চট্টগ্রাম পুলিশ বলছে, মাঈনুল ইসলাম ওরফে মুসার (২৯) নেতৃত্বে চট্টগ্রামে নব্য জেএমবি নতুন করে সংগঠিত হয়েছে বলে তারা তথ্য পেয়েছে। ঢাকা কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করা রাজশাহীর বাগমারার মুসা এর আগে ঢাকার আশকোনায় জঙ্গি আস্তানা গড়ে তুলেছিলেন। গত ২৪ ডিসেম্বর ওই আস্তানায় পুলিশ অভিযান চালায়।
সেখানে এক নারী আত্মঘাতী হামলাও চালান। মুসা এবং ইতিপূর্বে নিহত মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী আত্মসমর্পণ করেন। তখন ওই আস্তানা থেকে বোমা ও বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়। ওই সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী টের পায় যে নব্য জেএমবি নতুন করে আক্রমণের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা করছে। ওই অভিযানের পর মুসা চট্টগ্রামের দিকে আস্তানা গাড়েন।