• মঙ্গলবার , ২১ মে ২০২৪

দেশের ৯৫ ভাগ মানুষ জামায়াতের হরতালের বিপক্ষে


প্রকাশিত: ৩:২৬ এএম, ৭ নভেম্বর ১৪ , শুক্রবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৫৩ বার

 

 jjjjjjjjjjjjjjjjj

শাহদীন মালিক:

গত কয়েক দিনে আদালতের রায়ে মতিউর রহমান নিজামী ও মীর কাসেম আলী যুদ্ধাপরাধের জন্য দোষী প্রমাণিত হয়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। আর আমাদের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ আরেক যুদ্ধাপরাধীর দোষ ও সাজা বহাল রেখেছেন, অর্থাৎ কামারুজ্জামানকে দেওয়া যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল রেখেছেন।
মানুষ মাত্রই ভুল করতে পারে, অন্যায় করতে পারে, অপরাধ করতে পারে; এমনকি নৃশংস-নির্মম-জঘন্য যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধ করতে পারে। কিন্তু এত খারাপ কাজ করলেও, মানুষের তো বিবেক থাকার কথা। মনুষ্যত্বের একটা দিক নিশ্চয় ‘বিবেকের দংশন’। যত বড় অপরাধীই হোক না কেন, এটা ধরে নেওয়া স্বাভাবিক যে কোনো একদিন সেই অপরাধীও বিবেকের দংশনে জর্জরিত না হলেও কিছুটা হলে প্রায়শ্চিত্তবোধ তার হবে। মনে মনে হলেও দুঃখিত, লজ্জিত হবে; কিছুটা হলে অনুশোচনা বোধ হবে। তার নৃশংসতা, জঘন্যতা, বর্বরতার শিকার ব্যক্তিদের জন্য মানবিক কিছু চিন্তাধারণা হবে। কিন্তু এই এক সপ্তাহের তিনটা রায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু ঘটনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে শুধু এই যুদ্ধাপরাধীরাই নন, তাঁদের সাঙ্গপাঙ্গদের অনেকেই তাঁদের মতো বিবেকহীন, ভয়ংকর ও ভয়ানক।
যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম মারা গেলেন দিন কয়েক আগে। সংবাদমাধ্যমে এল তাঁর শেষ ইচ্ছার কথা। যেকোনো মৃত ব্যক্তির শেষ ইচ্ছা পূরণে সাধ্যমতো চেষ্টা করা অবশ্যই করণীয়। কিন্তু শেষ ইচ্ছাটা যদি বীভৎস ও ভয়ংকর হয়? গোলাম আযমের শেষ ইচ্ছা ছিল, সংবাদমাধ্যমে কথাটা যেভাবে এসেছে, সেটার ওপর নির্ভর করছি: দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী অথবা মতিউর রহমান নিজামী তাঁর জানাজা পড়াবেন।
বিবেকের দর্শন, প্রায়শ্চিত্ত, অনুশোচনা ইত্যাদির খাতায় নিঃসন্দেহে শূন্য। সাঈদীর ট্রাইব্যুনালে বিচার হয়েছিল অনেক আগে। আপিল বিভাগও রায় দিয়েছেন বেশ কয়েক সপ্তাহ আগে। আমৃত্যু কারাদণ্ড। অর্থাৎ আমাদের সর্বোচ্চ আদালত শেষ সিদ্ধান্ত দিয়ে দিয়েছেন। স্পষ্টত গোলাম আযম যখন সাঈদীর পড়া জানাজার পর কবরে শায়িত হতে চেয়েছিলেন, এটা মনে করাই স্বাভাবিক যে গোলাম আযম সাঈদীকে পূতপবিত্র পরহেজগার ব্যক্তি মনে করতেন, শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত।
কী ভয়ংকর, বীভৎস মনমানসিকতা! নিঃসন্দেহে চিন্তাচেতনা অনেকটা এ রকম, তোমাদের আইন বিচার যা-ই বলুক না কেন, আমরা হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষ হত্যা করলেও, ধর্ষণ করলেও, অগ্নিসংযোগ করে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিলেও খারাপ কাজ তো কিছুই করিনি। তাই সাঈদী বা নিজামীর মতো লোকেরা এসব কাজ করলেও খারাপ তো কিছু করেননি। গোলাম আযম যেন ঘোষণা দিয়েই বলছেন, সাঈদী-নিজামীর মতো পূতপবিত্র-পরহেজগার বান্দারাই আমার জানাজা পড়াবেন।
হায় আল্লাহ! এঁরাই নাকি এ দেশে আমাদের ধর্মের দিশারি। আমরা নাকি এঁদের কাছ থেকে ধর্ম শিখব!
মীর কাসেম আলী রায় ঘোষণার পর ‘ভি সাইন’ দেখিয়েছেন। স্পষ্টতই ভাবখানা হলো হাজার লোক মেরেছি তো কী হয়েছে, পারলে আরও মারতাম, মারব! দোষী ঘোষিত হওয়ার পর তাঁর মতো আরও অনেকেই এই ‘ভি সাইন’ দেখিয়েছেন রায় শোনার পর। যুদ্ধাপরাধীরা ক্রমাগত মনে করিয়ে দিয়ে চলেছেন যে তাঁরা এই রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের আইন, বিচার—কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করেন না। ১৯৭১ সালে তাঁরা যে কোনো অপরাধ করেছিলেন, সেটাও স্বীকার করেন না। মরে গিয়েও সেই একই ঘোষণা দিয়ে গেলেন, জানাজার ইমামতি করবে যুদ্ধাপরাধী।
জিম্মি হয়ে ঘরে বসে আছি সেই ৩০ অক্টোবর থেকে। স্পষ্টত ১৯৭১ সালের পর ৪৩ বছরে এখনো এসব খুনি-যুদ্ধাপরাধী-মানবতাবিরোধী অপরাধীরা হরতালের নামে গোটা বাংলাদেশকে জিম্মি করে রেখেছে। পুরো সপ্তাহ ধরে তারা আমাদের গৃহবন্দী করে রেখেছে। কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে অনেকে বেরোচ্ছে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের ধৃষ্টতায় অধম অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। রাজনৈতিক কারণে, অর্থনৈতিক নীতি বা সিদ্ধান্ত বা অন্য অনেক কিছুতেই হরতাল হতে পারে। তবে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচারে এবং সে বিচারে রায়ের বিরুদ্ধে যে দল হরতাল ডাকে, তারা নিঃসন্দেহে আইনকানুন, বিচার-আদালত, ন্যায়-অন্যায় কিছুরই তোয়াক্কা করে না।
অবশ্য এটাও স্পষ্ট যে যত দিন এ দেশের মানুষ দরিদ্র-অশিক্ষিত থাকবে, তত দিন ধর্ম বিকিয়ে যারা তথাকথিত রাজনীতি করে, তাদের প্রভাব থাকবে। পিছিয়ে পড়া মানুষই তাদের ভরসা-সম্বল। অর্থনীতিটাকে যতই এগোতে না দেওয়া যায়, তাদের জন্য ততটাই মঙ্গল। দারিদ্র্য-অশিক্ষা-কুশিক্ষা দূর করতে যত বেশি সময় লাগবে, ততই তাদের লাভ। তাই দিনের পর দিন তারা হরতাল ডাকবে। আমাদের জিম্মি-বন্দী করে রাখবে। আর আমরা কিছুই করতে পারছি না।
অবশ্য জামায়াতের তথাকথিত হরতালের ব্যাপারে আমাদের সংবাদমাধ্যমগুলো নিঃসন্দেহে ব্যাপক ‘অবদান’ রাখছে। হরতালের ঘোষণা নাকি থাকে জামায়াতের ওয়েবসাইটে। আর খুঁজে খুঁজে ওয়েবসাইটের ঘোষণা দেখে সাংবাদিকেরা সেটা তাঁদের নিজ নিজ রেডিও-টেলিভিশন-সংবাদপত্র আর আজকাল নিউজ পোর্টাল আর ব্লগের মাধ্যমে হু হু করে সবদিকে ছড়িয়ে দেন। আসলেই আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ হয়ে যাচ্ছি। ওয়েবসাইটে একটা বিজ্ঞপ্তি আপলোড করে সংবাদমাধ্যমের বদৌলতে আজকাল হরতাল ডাকা যায়, সারা দেশে, দিনের পর দিন।
অধমের ধারণা, এ মুহূর্তে দেশের শতকরা ৯৫ ভাগ, সম্ভবত আরও বেশি মানুষ রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াতের এই চলমান হরতালের বিপক্ষে।
এই সরকারের বেশির ভাগ মন্ত্রীর মুখ্য কাজ একটা, টেলিভিশনের পর্দায় তারস্বরে চিৎকার করে বিরোধী দলের মুণ্ডপাত করা। বিরোধীদের খুনি-ডাকাত-চোর-বদমাশ ইত্যাদি বিশ্লেষণে ভূষিত করা। সামনের সপ্তাহে সংসদের অধিবেশন শুরু হবে। সেখানেও প্রধান কর্ম যেটা সম্পন্ন হবে, সেটাও হবে তারস্বরে চেঁচামেচি করা। অথচ যে ব্যাপারে অন্তত শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষের সমর্থন আছে, সে ব্যাপারে কোনো কিছু করতে না পারাটাই মনে হচ্ছে এই সরকারের অর্জন। রায়ের ব্যাপারে ডাকা হরতালের বিরুদ্ধে যে ব্যাপক জনমত আছে, সরকার তা কোনোমতেই কাজে লাগাতে পারছে না।
সরকার একটা সুবর্ণ সুযোগ হারাচ্ছে।

হরতালকে কেন্দ্র করে, বিশেষত রায়ের কারণে হরতাল ডেকে জামায়াত যে সাংঘাতিক জনবিরোধী কাজ করছে, সেটা সরকার কাজে লাগাতে পারছে না। শেষে কথার প্রসঙ্গটা একটু ভিন্ন। জঙ্গিবাদী ও উগ্র ধর্মীয় দলগুলোর একটা রীতি দেখছি আমাদের প্রগতিশীল বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন অনুকরণ করছে। ভিন্ন মত বা সমালোচকের ভূমিকার জন্য মুরতাদ ঘোষণা করা ধর্মীয় উগ্রবাদীদের কাজ। পাকিস্তানের ব্ল্যাসফেমি আইন আর এই গোত্র ওই গোত্রকে অমুসলিম ঘোষণার দাবি এই অপসংস্কৃতিরই বিভিন্ন রূপ। অন্যের মত, তা আমার জন্য যতই অগ্রহণযোগ্যই হোক না কেন, সেটা সহ্য করতে পারা, শেখা—এটাই গণতন্ত্র। সমালোচককে মুরতাদ ঘোষণা করাটা গণতন্ত্রকে অস্বীকার করা।

ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের ‘মুরতাদ’ ঘোষণা আর প্রগতিশীলদের ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করা মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। পিয়াস করিমের মৃত্যুর পর তাঁকে এবং পর পর আরও নয়জনকে প্রকারান্তরে মুরতাদ ঘোষণা করা হয়েছিল। তাঁদের অনেকেই আমার পরিচিত, অনেকেই ঘনিষ্ঠ।
অবাক হয়েছিলাম প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর এই ‘মুরতাদ’ অপসংস্কৃতিতে গা ভাসিয়ে দেওয়া দেখে। সম্ভবত তারুণ্যের আতিশয্যে। আর দিনের পর দিন যুদ্ধাপরাধী-মানবতাবিরোধী রায়ে ঘোষিত জঘন্যতম অপরাধীরা হরতালের নামে আমাদের জিম্মি-বন্দী করে রাখছে। আমরা কিছুই করতে পারছি না। আর অদক্ষ সরকার বুঝতেও পারছে না শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষের মত কীভাবে কাজে লাগাবে।বিচিত্র এই দেশ!ড. শাহদীন মালিক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট; অধ্যাপক, স্কুল অব ল, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি