• রোববার , ১৯ মে ২০২৪

দুর্গোৎসব শেষে মূর্তি বিসর্জনের সময় কুপ্রবৃত্তি’ও বিসর্জন দিতে হবে


প্রকাশিত: ২:৪৬ পিএম, ২২ অক্টোবর ১৫ , বৃহস্পতিবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৭৪ বার

222222222222সৈয়দ আবুল মকসুদ:     দুর্গাপূজা শরৎকালে অনুষ্ঠিত হয়। ভাদ্র-আশ্বিন দুই মাস শরৎকাল। কার্তিকেও পূজা হয়। এবারে কার্তিক মাসে দুর্গাপূজা পড়েছে। এটা হেমন্ত ঋতু। আমার প্রিয় ঋতু শরৎ ও হেমন্ত। বর্ষা শেষ হয়ে যায়। পরের চারটি মাস আমার কাছে অন্য মাসগুলোর তুলনায় অন্য রকম। এটি নবান্নেরও সময়। বাংলার কৃষি সভ্যতায় নবান্ন গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ। কবির কথায়_ নতুন ধান্যে হবে নবান্ন …। এক সময় কার্তিক মাসকে মঙ্গার সময় বলা হতো। এখন আর সে অবস্থা নেই। এখন সারাবছর ধান উৎপন্ন হয়। আগে প্রধান ফসল ছিল আমন ধান। এ ধান উঠলে বাংলার ধর্মনির্বিশেষে কৃষক সমাজের মধ্যে এক ধরনের সচ্ছলতা লক্ষ্য করা যায়। আর ঠিক সে সময়েই প্রতি বছর একের পর এক পূজা অনুষ্ঠিত হতে থাকে। পূজার এ মৌসুমে বাড়ি বাড়ি আনন্দের একটি পরিবেশ সামাজিকভাবেই তৈরি হতো। দুর্গাপূজা শেষ হতে না হতেই লক্ষ্মীপূজা। ঘরে ঘরে এর আয়োজন। এর ১৫ দিন পর কালীপূজা। অমাবস্যার রাতে এ পূজার আয়োজন হতো। তার পর ভাইফোঁটা। কার্তিকের শেষে কার্তিকপূজা। শীতের সময়ে সরস্বতীপূজা। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তখন শিক্ষার দেবীর জন্য কত আয়োজন!

আমাদের মানিকগঞ্জ এলাকায় মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তির দিক থেকে হিন্দুদের গুরুত্ব ছিল। সবচেয়ে প্রভাবশালী হিন্দু পরিবার ছিল কিরণশঙ্কর রায়দের পরিবার। তেওতার বড় জমিদার হিসেবেই তাদের পরিচয় ছিল। তাদের বাড়িকে বলা হতো তেওতার রাজবাড়ি। সেই রাজবাড়িতে ছিল নাটমন্দির। আমাদের বাড়ি থেকে ওই বাড়ির দূরত্ব ছিল মাইলখানেক। আমাদের বাড়িও পদ্মা নদীর তীরে। তেওতার রাজবাড়িও। কখনও সড়কপথে, কখনও নৌকায় তেওতার রাজবাড়ি যেতাম। বিরাট ফুলের বাগান ছিল সেখানে। দুর্গাপূজার মাসখানেক আগে থেকে রাজবাড়িতে সাজসাজ রব পড়ে যেত। পূজার ধর্মীয় অনুষঙ্গ হতো রাজবাড়ির বিরাট এবং অতি সুদৃশ্য মন্দিরে। উচ্চতায় তিন তলার সমান। সেখানে প্রতিষ্ঠিত হতো বিরাট প্রতিমা। তার পাশেই নাটমন্দিরে সঙ্গীত, নৃত্য ও যাত্রাপালার আয়োজন থাকত। এসব অনুষ্ঠান চলত কয়েক দিন। তাতে দর্শক-শ্রোতার দলে মুসলমানরাই থাকত বেশি। আমি যে সময়ের কথা বলছি সেটা পঞ্চাশের দশক। আমার শৈশব-কৈশোরের সময়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কয়েক বছর। জমিদারদের অনেকে কলকাতা চলে গেছেন। কিরণশঙ্কর রায় কলকাতার ইউরোপীয় অ্যাসাইলাম লেনের বিরাট বাড়িতে থাকতেন। বাংলা ভাগের কয়েক বছর পরই তার মৃত্যু হয়। তার পরিবারের অনেকেই ষাটের দশক পর্যন্ত তেওতার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। আমার বাবা পদ্মার পাঙ্গাশ, ইলিশ এসব কিরণশঙ্কর রায়ের পরিবারের জন্য মাঝে মধ্যে পাঠাতেন। ট্রেনে সময় বেশি লাগত না। পদ্মার অপর তীরেই গোয়ালন্দ স্টেশন। সেখান থেকে ট্রেনে বেশি সময় লাগত না। সামান্য বরফেই মাছ তাজা থাকত।
তেওতার জমিদাররা চলে যাওয়ার পরও পঞ্চাশের দশকে আমাদের এলাকায় অবস্থাপন্ন ও সম্ভ্রান্ত হিন্দুদের অনেকে ছিলেন। সাধারণ হিন্দু-মুসলমান সবার অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। কিন্তু শারদীয় দুর্গোৎসবের সময় যে কোনোভাবেই হোক সামাজিক আনন্দের নানা রকম আয়োজন হতো। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আসত জোয়ার। তার মধ্যে আমার বিশেষভাবে মনে পড়ে নাটক ও যাত্রার কথা।সে সময়ে অমলেন্দু বিশ্বাসের যাত্রা পার্টির রমরমা অবস্থা। পূজা ও শীতের মৌসুমে নানা স্থানে তারা যাত্রাপালা পরিবেশন করত। রাতভর মানুষ তা উপভোগ করত। এই যে বাঙালির সাংস্কৃতিক বিশিষ্টতা দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হতো, তা শুধু হিন্দুদের উপভোগের বিষয় ছিল না। সামাজিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় এসব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বড় ভূমিকা পালন করত। তখন সাধারণ মানুষের আর্থিক অবস্থা এখনকার তুলনায় খারাপ ছিল। এখন দেখি নতুন কাপড়চোপড়ের প্রতি প্রবল ঝোঁক। শহর ও গ্রাম সর্বত্র নতুন ও ঝলমলে পোশাকের ছড়াছড়ি। হাতের কাছেই রয়েছে পছন্দের পোশাক। টাকা থাকলেই হলো। আগের দিনগুলোতে এমনটি দেখা যেত না। ঈদ কিংবা দুর্গাপূজা, কোনো সময়েই না। বিলাসিতার প্রতি তেমন আগ্রহ সর্বসাধারণের মাঝে ছিল না। অভাব-অনটনের মধ্যেও তাদের মনোযোগ ছিল সাংস্কৃতিক বিষয়গুলোর দিকে। শারদীয় দুর্গোৎসবে সেকালে যে সামাজিক সংহতি লক্ষ্য করা যেত, তা বাঙালি জাতিকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করেছিল। পাকিস্তান ছিল ইসলামিক রিপাবলিক। কিন্তু শারদীয় উৎসবের সময় মনে হতো, সেটা না হিন্দুর দেশ, না মুসলমানের_ বরং মনে হতো সব বাঙালির দেশ।
শারদীয় দুর্গোৎসবের সঙ্গে বাংলার অর্থনৈতিক উন্নতির কিছু উপাদান ছিল। আমাদের এলাকায় কোথাও কোথাও দেখেছি, কুটির শিল্পের মেলা বসত। বিভিন্ন পরিবার তাদের উৎপাদিত সামগ্রী নিয়ে আসত মেলায়। মানুষ আনন্দও করত। কিছু উপার্জনও হতো। লক্ষ্মীপূজা ছিল উপভোগ্য। আজ যখন দেখি একালের তরুণ প্রজন্মের পিজ্জা-হ্যামবারগার প্রভৃতি খাদ্যের প্রতি সীমাহীন আসক্তি, তখন আমার মনে পড়ে লক্ষ্মীপূজার যেসব খাবার আমাদের বাড়িতে আসত_ যেমন নারকেলের তৈরি নাড়ূসহ নানা পদ, মুড়ি-খৈ-চিড়ার মোয়া, চিরকালের বাঙালির খাদ্য। দুধের মিষ্টি যে কত প্রকার হতে পারে, সেটা এখন ভাবাও যায় না! খাঁটি দুধের সুস্বাদু সব খাদ্য। এই যে বাঙালি সংস্কৃতির বিষয়গুলো ধর্মীয় উৎসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েও যেভাবে আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃৃদ্ধ করেছিল, এখন বিশ্বায়নের ধাক্কায় সব যেন হারিয়ে যাওয়ার পথে। বাঙালির ধর্ম ও সংস্কৃতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, ঘনিষ্ঠ সম্পর্কিত। খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, জীবনযাপন_ সবকিছুর সঙ্গে প্রকৃতি ও ধর্মীয় বিষয় যেন একাকার হয়ে এক সি্নগ্ধ সমাজ ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছিল। এখন বহুজাতিক কোম্পানির উৎপাদিত নানা দ্রব্যের অতিপ্রচারিত আবহে বাঙালির যে খাদ্য-রুচি, তা পর্যন্ত হারিয়ে যাচ্ছে।
পূজা শেষ না হতেই হেমন্তে ঘরে ঘরে নতুন ধান উঠত। তাতে গ্রামের মানুষের হাতে কিছু কাঁচা টাকা আসত। তাদের কেনাকাটার কারণে অর্থনীতিতে নতুন গতি আসত। এখন গ্রামের চিরায়ত অনেক পেশাজীবী পরিবার বিপন্ন। বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে এটা লক্ষ্য করা যায়। তাঁতি, কামার, কুমার, স্বর্ণকার_ তাদের কথা খুব মনে পড়ে। এখন বাঙালি সংস্কৃতিতে বিদেশি প্রভাব প্রকট। এর দাপটে অনেকে পেশা হারিয়ে ফেলছেন। একদল লোক শোলা দিয়ে কত রকমের খেলা তৈরি করে নিয়ে আসত বাজারে! বিশেষভাবে এর উৎপাদনের সঙ্গে ছিল নারীসমাজ। শোলার কাজ করত যেসব পরিবার তাদের বলা হতো মালাকার। কী অপূর্ব নাম! বহুদিন পর আমার নস্টালজিক বোধ হচ্ছে। দুটি মালাকার পরিবার ছিল আমাদের এলাকায়। তারা শোলা ও অন্যান্য উদ্ভিদে তৈরি জিনিসপত্র পূজার সময় আমাদের উপহার দিত। আমাদের সংস্কৃতির সেই যে সি্নগ্ধ দিক, বিশেষ করে শরৎ-হেমন্তের দিনগুলোতে লক্ষ্য করা যেত, তা এখন কমে গেছে। পাকিস্তানি আমলেও হিন্দু সম্প্রদায় পূজার দিনগুলোতে সবসময় উদ্বেগে থাকত না। সংখ্যালঘুদের অনেক সমস্যা তখনও ছিল। তাদের জমিজমা হাতছাড়া হয়ে গেছে। অনেকে দেশত্যাগ করেছেন। মন পড়ে থাকত এখানে, কিন্তু ঘরবাড়ি ছেড়ে দেশান্তরী হয়েছে কত যে পরিবার! শারদীয় উৎসব সব সম্প্রদায়কে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধত। আজ একুশ শতকে এসে আমরা লক্ষ্য করছি শাশ্বত সেই বাঙালি সমাজ ভেঙে পড়ছে। উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠী সামাজিক ভীতি সৃষ্টি করছে। আনন্দ কী, অনেকে সেটা ভুলে যাচ্ছে। ফলে এখন শারদীয় উৎসবের সময় সব সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ থাকলেও কোথাও কোথাও লক্ষ্য করা যায় আইন-শৃঙ্খলার অভাবজনিত আতঙ্ক। এ প্রেক্ষাপট সামনে রেখেই বলছি_ বাঙালি জাতির হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-আদিবাসী সবাই হাজার বছর ধরে যে ঐক্য, সম্প্রীতি ও পারস্পরিক সহমর্মিতা নিয়ে বসবাস করছে, তাকে আরও সংহত করার দায়িত্ব একালের মানুষের। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি হয়েছে। সমাজ চিরকাল এক রকম থাকবে না। প্রত্যেক যুগেরই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কিন্তু শাশ্বত মূল্যবোধ ও সম্প্রীতি বিসর্জন না দিয়ে আরও কীভাবে দৃঢ় করা যায় সেই সাধনায় প্রতিটি সুস্থ, বিবেকবান ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের ভাবনা হওয়া উচিত। দুর্গোৎসব শেষে মূর্তি বিসর্জন হয়। আমাদের কুপ্রবৃত্তি বিসর্জন দিতে হবে। আমাদের ভেতরের যা কিছু কুৎসিত তা বিসর্জন দিয়ে হয়ে উঠতে হবে শুভ, সুন্দরের পরাকাষ্ঠা।শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে সবাইকে জানাই আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা।