• রোববার , ১৯ মে ২০২৪

ঘুসখোরের পেটে যাচ্ছে ২৮৮১ কোটি


প্রকাশিত: ৮:৩২ পিএম, ৩০ আগস্ট ১৮ , বৃহস্পতিবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ১৪৭ বার

 

 

 

বিশেষ প্রতিনিধি : ঘুষ অনুসন্ধান করলো এবার টিআইবি।তাদের অনুসন্ধানে মিলেছে-দেশের ৮৯ শতাংশ মানুষ মনে করেন, ঘুষ না দিলে কোনো সেবা খাতেই সেবা মেলে না। এ ছাড়া হয়রানি বা জটিলতা এড়াতে কিংবা নির্ধারিত সময়ে সেবা পেতে সেবাগ্রহীতারা ঘুষ বা নিয়ম-বহির্ভূত অর্থ দিতে বাধ্য হন।

দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) খানা জরিপ-২০১৭ তে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার জরিপটি প্রকাশ করে টিআইবি। আজ বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর ধানমন্ডিতে মাইডাস সেন্টারে টিআইবির কার্যালয়ে এ জরিপ তুলে ধরা হয়।

অনুষ্ঠানে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ঘুষ দিতে বাধ্য হওয়ার তথ্য এবং ঘুষ ছাড়া সেবা না পাওয়ার তথ্যে বোঝা যায়, ঘুষ আদায় অনেকটাই প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে।টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল বলেন, দুর্নীতির সঙ্গে বসসবাস করার সংস্কৃতি আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে। এটা জাতিগতভাবে অসম্মানজনক ও অমর্যাদাকর।

জরিপে বলা হয়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রাক্কলিত ঘুষের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৬৮৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এটি মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ এবং জাতীয় বাজেটের ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। এর আগে ২০১৫ সালে টিআইবি সর্বশেষ খানা জরিপ করে। ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৭ তে ঘুষের পরিমাণ ২১ দশমিক ২ শতাংশ বেড়েছে।

২০১৭ সালের জরিপের তথ্য অনুসারে দেশের সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। এরপর রয়েছে যথাক্রমে পাসপোর্ট, বিআরটিএ, বিচারিক সেবা, ভূমি সেবা। টিআইবি মোট ১৫টি খাতকে এ জরিপে অন্তর্ভুক্ত করেছে। জরিপের খাতগুলো হচ্ছে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, ভূমি সেবা, কৃষি, আইনশৃঙ্খলা, বিচারিক সেবা, বিদ্যুৎ, ব্যাংকিং, বিআরটিএ, কর ও শুল্ক, এনজিও, পাসপোর্ট, বিমা ও গ্যাস।

এ ছাড়া অন্যান্যের মধ্যে আছে প্রশ্নপত্র, ওয়াসা, নির্বাচন কমিশন ও ডাক বিভাগ। সংস্থাটি বলছে, যেসব খাত সাধারণ মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও আর্থিক নিরাপত্তা বিধানে অবদান রাখে, সেগুলোকেই জরিপে আনা হয়। সংস্থাটি বলেছে, এই জরিপে দুর্নীতিকে তারা সংজ্ঞায়িত করেছে সেবা খাতে ব্যক্তিস্বার্থে ক্ষমতার অপব্যবহারকে। সার্বিকভাবে ৬৬ দশমিক ৫ শতাংশ খানা সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা
এই সংস্থার কাছে সেবা নিতে গিয়ে ৭২ দশমিক ৫ শতাংশ খানা কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতির শিকার হয়েছে। ৬০ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ ঘুষ দিয়েছেন বাধ্য হয়ে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার কাছ থেকে সেবা নিতেগিয়ে গড়ে প্রতিটি খানাকে ৬ হাজারে ৯৭২ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে।

জরিপের তথ্য অনুসারে সেবাগ্রহীতারা সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির শিকার হয়েছেন হাইওয়ে পুলিশের দ্বারা (৯২ দশমিক ১ শতাংশ)। আর সবচেয়ে কম হয়েছেন ট্রাফিক পুলিশের হাতে (৬৩ দশমিক ৩ শতাংশ)। এ ছাড়া স্পেশাল ব্রাঞ্চের কাছ থেকে সেবা নিতে গিয়ে ৮৩ দশমিক ৯ শতাংশ এবং অন্যান্য সংস্থার কাছ থেকে ৮২ দশমিক ৩ শতাংশ দুর্নীতির শিকার হয়েছে।

প্রতিবেদন বলছে, গ্রেপ্তারসংক্রান্ত বিষয়ে সেবা নিতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার কাছ থেকে বেশি দুর্নীতির শিকার হয়েছেন সেবাগ্রহীতারা। এরপর রয়েছে যথাক্রমে ট্রাফিকসংক্রান্ত, পাসপোর্টের ভেরিফিকেশন, এফআইআরের ক্ষেত্রে।

পাসপোর্ট
পাসপোর্ট সেবা খাতে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন সত্ত্বেও বিভিন্ন ধাপে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হতে হয়েছে। পাসপোর্ট সেবাগ্রহীতারা ৫৯ দশমিক ৩ শতাংশ ঘুষের শিকার হয়েছেন এবং খানাপ্রতি গড় ঘুষের পরিমাণ ২ হাজার ৮৮১ টাকা। ঘুষ ছাড়াও সেবাগ্রহীতাদের অনেকেই সময়ক্ষেপণ, দালালের সহযোগিতা নিতে বাধ্য হওয়া, দায়িত্ব পালনে অনীহা এবং প্রতারণারও শিকার হতে হয়েছে বলে জরিপে উঠে এসেছে।

বিআরটিএ
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কাছ থেকে সেবা নিতে গিয়ে ৬৫ দশমিক ৪ শতাংশ খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছে। সেখানে মালিকদের চেয়ে চালকদের দুর্নীতির শিকার হওয়ার হার বেশি। মোটরযানের চালক হিসেবে লাইসেন্স সংগ্রহ করতে গিয়ে বেশি খানা দুর্নীতির শিকার হয়। এরপর রয়েছে মোটরযানের নিবন্ধন করতে গিয়ে।

জরিপে বলা হয়, খাতওয়ারি জরিপের তথ্য অনুসারে গ্যাস, কৃষি ও বিচারিক খাতে উল্লেখযোগ্য হারে ঘুষ বেড়েছে। আর কমেছে শিক্ষা, পাসপোর্ট ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান খাতে। এ ছাড়া ২০১৫ সালের তুলনায় সেবা খাতে ঘুষের শিকার খানার হার কমলেও ঘুষ আদায়ের পরিমাণ বেড়েছে।

তথ্য অনুসারে ২০১৭ সালে খানাপ্রতি সর্বোচ্চ ঘুষ আদায়কারী খাতগুলো হলো গ্যাস (৩৩ হাজার ৮০৫ টাকা), বিচারিক সেবা (১৬ হাজার ৩১৪ টাকা) ও বিমা খাত (১৪ হাজার ৮৬৫ টাকা)।ঘুষ ও দুর্নীতির শিকার খানার মধ্যে নিম্ন আয়ের এবং গ্রাম অঞ্চলের মানুষের সংখ্যা বেশি। তাঁদের ব্যয়িত অর্থের পরিমাণও বেশি। চাকরিজীবী বা শিক্ষিত মানুষের তুলনায় কৃষক, শ্রমিক, জেলে, পরিবহন শ্রমিক বা সাধারণ পেশার মানুষেরাই বেশি দুর্নীতির শিকার হন।

প্রতিবেদন উপস্থাপনের পাশাপাশি টিআইবি ১২ দফা সুপারিশও তুলে ধরেছে। এর মধ্যে রয়েছে দুর্নীতিতে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা ও শাস্তি দেওয়া; দুদকের মাধ্যমে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া; নৈতিক আচরণবিধি প্রণয়ণ; ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রণোদনার সৃষ্টি; সেবা প্রদান পর্যায়ে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো; জনগণের সচেতনতা ও গণমাধ্যমের সক্রিয়তা বৃদ্ধি; তথ্য অধিকার আইন ও তথ্য প্রকাশকারীর সুরক্ষা আইনের কার্যকর বাস্তবায়ন; তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো, রাজনৈতিক সদিচ্ছা।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডর চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল বলেন, রাজনৈতিক নেতাদের সদিচ্ছা থাকলে দুর্নীতি কমানো এবং নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। যাঁরা সেবা দিচ্ছেন, তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনা হচ্ছে না। এটা দেশ পরিচালকদের ব্যর্থতা। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন যে আর্থসামাজিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে দুর্নীতিমুক্ত থাকা কঠিন হয়ে গেছে। ঘুষ ছাড়া সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। মানুষের আত্মমর্যাদাবোধে আঘাত লাগছে। দুর্নীতির কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য হচ্ছে।
‘বেতন বাড়লেও দুর্নীতি কমেনি’

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান এ সময় বলেন, দুর্নীতির এই ব্যাপকতা উদ্বেগজনক। তিনি বলেন, একসময় ধারণা করা হয়েছিল, বেতন-ভাতা বাড়লে দুর্নীতির প্রকোপ কমবে। কিন্তু তা দেখা যাচ্ছে না। যাঁরা ঘুষ আদায়ে অভ্যস্ত, তাঁদের জন্য বেতন-ভাতা কোনো উপকরণই নয়। জরিপের তথ্য তুলে ধরে বলেন, তরুণেরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার। তাঁদের মধ্যে দুর্নীতিবিরোধী সচেতনতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।

দুর্নীতির এত ব্যাপকতার মধ্যে সম্প্রতি সরকারি চাকরি আইন ২০১৮ নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। সে আইন পাস হলে দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মচারীদের গ্রেপ্তারে দুদকের ক্ষমতা কমে যাবে। এ ক্ষেত্রে কীভাবে দুর্নীতি দমন সম্ভব—এমন প্রশ্নের জবাবে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এটা অসাংবিধানিক ও অগ্রহণযোগ্য। কোনো বিশেষ শ্রেণিকে সুবিধা দেওয়ার জন্য আইন হওয়া উচিত নয়। তিনি বলেন, দুর্নীতির জন্য দুদক আইনে প্রধানমন্ত্রীসহ যেকোনো জনপ্রতিনিধিকে গ্রপ্তার করা গেলেও একজন সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করতে অনুমতি লাগবে—এটার কী যৌক্তিকতা?

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আইনের চোখে সবার সমান হওয়া উচিত। আমাদের যা আইন আছে তা সময়োপযোগী এবং যথার্থ। তবে তার প্রয়োগের ক্ষেত্রেই আমাদের যত ঘাপলা।অনুষ্ঠানে টিআইবির ব্যবস্থাপনা পরিষদের উপদেষ্টা সুমাইয়া খায়ের, রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান উপস্থিত ছিলেন। জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করেন গবেষণা ও পলিসির সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. ওয়াহিদ আলম, একই বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ফারহানা রহমান ও ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোহাম্মদ নূরে আলম।