• মঙ্গলবার , ৭ মে ২০২৪

খেল খতম জুয়ার সম্রাটের:পাকরাও


প্রকাশিত: ৩:২৬ পিএম, ৬ অক্টোবর ১৯ , রোববার

নিউজটি পড়া হয়েছে ১৯৯ বার

কুমিল্লা সীমান্তের এই বাড়ি থেকেই গ্রেফতার হন জুয়ার সম্রাট ওরফে ক্যাসিনো সম্রাট ও আরমান

শফিক রহমান :  অবশেষে খেল খতম জুয়ার সম্রাটের! আজ সকালে তাকে গ্রেফতার করেছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। তাঁরা জাতিরকন্ঠকে জানায়, বহুল আলোচিত ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আজ রবিবার ভোর ৫টার দিকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার কুঞ্জুশ্রীপুর গ্রামে অভিযান চালিয়ে সহযোগী আরমানুল হক আরমানসহ সম্রাটকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-১।জানা গেছে, সম্রাট কুঞ্জশ্রীপুর গ্রামের যে বাড়ি থেকে গ্রেফতার হন সেটির মালিক মনির চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি। তিনি একজন পরিবহন ব্যবসায়ী।মনির চৌধুরীর এই বাড়িতেই ঘনিষ্ঠ সহযোগী আরমানহ আত্মগোপনে ছিলেন সম্রাট।কুঞ্জশ্রীপুর গ্রামটি ভারত সীমান্তবর্তী। ধারণা করা হচ্ছে, সম্রাট সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইসমাইল হোসেন সম্রাট যুবলীগ নেতা হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিলেও ঢাকার বাসিন্দাদের কাছে সে ছিল জুয়ার সম্রাট ওরফে ক্যাসিনো সম্রাট। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় জমা পড়েছে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। সবশেষ ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের সবুজ সংকেত পেয়েই তাকে আজ তাকে গ্রেফতার করা হলো। গোয়েন্দা কার্যালয়ে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলেও তাকে গ্রেফতার করা না করা নিয়ে দো-টানায় ছিল প্রশাসন। ক্ষমতাসীন দলে সম্রাটের প্রভাব এত বেশি যে সুস্পষ্ট নির্দেশনা ছাড়া তাকে গ্রেফতার করতে ইতস্তত ছিল র‌্যাব-পুলিশ। এক পুলিশ কর্মকর্তা জাতিরকন্ঠ কে জানান, সম্রাটের সুবিধাভোগীদের তালিকায় মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, পুলিশ, সাংবাদিকসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক ব্যক্তিই আছেন। এ কারণে তাকে গ্রেফতারে ইতস্তত করছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। চলমান শুদ্ধি অভিযানে গ্রেফতারকৃতরা তাদের অপরাধে ভাগীদার হিসেবে সম্রাটের নাম বললেও তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি। এ কারণে অনেকে ধারণা করছিলেন, সম্রাট গ্রেফতার না–ও হতে পারেন।

চলমান মাদক ও ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও জি কে শামীমসহ যুবলীগের কয়েকজন নেতা গ্রেফতার হওয়ার পরই সম্রাটের নাম উঠে আসে। তখন থেকেই গ্রেফতার এড়াতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেকে বাঁচাতে পারলেন না সম্রাট। আটকা পড়লেন র‍্যাবের জালে। ক্যাসিনো ক্যাণ্ডে সম্রাটের নাম প্রকাশের পর, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সম্রাট সর্ম্পকে নানা অভিযোগের সত্যতা পান। যুবলীগ নেতা শামীম ও খালেদও জিজ্ঞাসাবাদে সম্রাটের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নানা তথ্য দেন।জানা গেছে, প্রতি রাতে রাজধানীর ১৫টি ক্যাসিনো থেকে ৪০ লাখ টাকা চাঁদা হিসেবে নিতেন ইসমাইল হোসেন সম্রাট।

সদ্য বহিষ্কৃত যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও টেন্ডার কিং জিকে শামীমের সব অবৈধ আয়ের ভাগ দিতে হত সম্রাটকে। আবার মতিঝিল, ফকিরাপুল, পল্টন, কাকরাইল, বাড্ডা এলাকায় অপরাধ জগতের একক আধিপত্য তৈরি করে চাঁদাবাজি করতেন।সদ্য গ্রেফতার হওয়া ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদের সঙ্গে মিলে ঢাকার অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করতেন সম্রাট।

যুবলীগ নেতা সম্রাট ক্যাসিনো ব্যবসার পাশাপাশি চাঁদাবাজিতেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা জাকাত ও দানের টাকা দিতেন আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামে। সেখান থেকেও চাঁদা নিতেন সম্রাট। যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের মতো একটি বড় ইউনিটের সভাপতি হওয়ার সুবাধে তার ছিল বিশাল বাহিনী। তিনি কাকরাইলের অফিসে অবস্থান করলেও কয়েকশ’ নেতাকর্মী সবসময় তাকে ঘিরে রাখত। অফিস থেকে বের হয়ে কোথাও গেলে তাকে প্রটোকল দিতেন শতাধিক নেতাকর্মী। অবৈধ উপার্জনের টাকা দিয়েই এ বাহিনী পালতেন সম্রাট।

সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে বড় জুয়ার আস্তানা মেরিনা বে স্যান্ডস ক্যাসিনোতে পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ থেকেও আসেন জুয়াড়িরা। কিন্তু সেখানেও সম্রাট ভিআইপি জুয়াড়ি হিসেবে পরিচিত। প্রথম সারির জুয়াড়ি হওয়ায় সিঙ্গাপুরের চেঙ্গি এয়ারপোর্টে তাকে রিসিভ করার বিশেষ ব্যবস্থাও আছে।এয়ারপোর্ট থেকে মেরিনা বে স্যান্ডস ক্যাসিনো পর্যন্ত তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বিলাসবহুল গাড়ি ‘লিমুজিন’যোগে। সিঙ্গাপুরে জুয়া খেলতে গেলে সম্রাটের নিয়মিত সঙ্গী হন যুবলীগ দক্ষিণের নেতা আরমানুল হক আরমান, মোমিনুল হক সাঈদ ওরফে সাঈদ কমিশনার, সম্রাটের ভাই বাদল ও জুয়াড়ি খোরশেদ আলম।

এদের মধ্যে সাঈদ কমিশনারের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তিনি ১০ বছর আগে ঢাকায় গাড়ির তেল চুরির ব্যবসা করতেন। এখন তিনি এলাকায় যান হেলিকপ্টারে চড়ে। এমপি হতে চান আগামী দিনে। যার তোড়জোড় শুরু হয়েছে এখন থেকে। দোয়া চেয়ে এলাকায় লাগানো হচ্ছে পোস্টার।সম্রাটের অফিস রাজধানীর কাকরাইলে রাজমণি সিনেমা হলের উল্টোপাশে। সেখানেও গভীর রাত পর্যন্ত ভিআইপি জুয়া খেলা চলে। প্রতিদিনই ঢাকার একাধিক বড় জুয়াড়িকে সেখানে জুয়া খেলার আমন্ত্রণ জানানো হয়।

কিন্তু সম্রাটের অফিসে খেলার নিয়ম ভিন্ন। সেখান থেকে জিতে আসা যাবে না। কোনো জুয়াড়ি জিতলেও তার টাকা জোরপূর্বক রেখে দেয়া হয়। নিপীড়নমূলক এই জুয়া খেলার পদ্ধতিকে জুয়াড়িরা বলেন ‘চুঙ্গি ফিট’। অনেকে এটাকে ‘অল ইন’ও বলেন। ক্যাসিনোকাণ্ডে ইতোমধ্যে যাদেরই জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে, তারাই সম্রাটের নাম বলছেন। তার সহযোগী হিসেবে নাম আসছে যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, কাউন্সিলর ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মমিনুল হক ওরফে সাঈদ, যুবলীগের সহসভাপতি এনামুল হক ওরফে আরমানসহ আরও কয়েকজনের।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় মোহামেডান, আরামবাগ, দিলকুশা, ওয়ান্ডারার্স, ভিক্টোরিয়া ও ফকিরেরপুল ইয়াংমেনস ক্লাবে অবৈধ ক্যাসিনোর ছড়াছড়ি। এর মধ্যে ইয়াংমেনস ক্লাবে ক্যাসিনো চালাতেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সম্রাটের শিষ্য খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। বাকি পাঁচটি ক্লাবে ক্যাসিনো চালাতেন সম্রাটের লোকজন।সম্রাটের ক্যাসিনোর দেখাশোনা করতেন ওয়ার্ড কাউন্সিলর মমিনুল হক ওরফে সাঈদ। তারা এক বছর আগে পল্টনের প্রীতম–জামান টাওয়ারে ক্যাসিনো চালু করেছিলেন। অভিযান শুরু হওয়ার পর মমিনুল সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমান।

আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৪ সেপ্টেম্বর দলের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় যুবলীগ নেতাদের নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি যুবলীগের কয়েকজন নেতার কথা উল্লেখ করে বলেন, তারা শোভন-রাব্বানীর চেয়েও খারাপ। প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুবলীগের ঢাকা মহানগরের একজন নেতা যা ইচ্ছে করে বেড়াচ্ছে, চাঁদাবাজি করছে।

আরেকজন এখন দিনের বেলায় প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে চলেন। সদলবলে অস্ত্র নিয়ে ঘোরেন। এসব বন্ধ করতে হবে। যারা অস্ত্রবাজি করেন, যারা ক্যাডার পোষেণ, তারা সাবধান হয়ে যান, এসব বন্ধ করুন। তা না হলে যেভাবে জঙ্গি দমন করা হয়েছে, একইভাবে তাদেরও দমন করা হবে।এর পরই শুদ্ধি অভিযানে নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গ্রেফতার করা হয় একে একে খালিদ, শামীমসহ যুবলীগ নেতাদের। আজ গ্রেফতার করা হল সম্রাট ও এনামুল হক আরমানকে।