• বুধবার , ১৫ মে ২০২৪

ক্রিকেট তারকাদের অন্যভূবন


প্রকাশিত: ১:০৯ এএম, ১৯ এপ্রিল ১৪ , শনিবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৫৯ বার

খেনার বাইরে কেমন সময় কাটান ক্রিকেট তারকারা।তা নিয়ে আকনকেরই কৌতুহলের শেষ নেই।কি্এট তারকাদের সেই অন্য ভূবনের কথা লিখেছেন টিপু সুলতান।কদিন আগে শেষ হলো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। বাংলাদেশসহ মোট ১৬টি দলের প্রায় প্রতিটিই উঠেছিল ঢাকার রূপসী বাংলা ও প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে। পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় ক্রিকেট-দুনিয়ার সব বড় তারকাকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন প্রতিষ্ঠান দুটির কর্মীরা।

ড্যারেন স্যামির প্রিয় পানীয় ছিল ডাব। ছবি: শামসুল হকসাকিবের ফলপ্রীতি
টেলিভিশনে বিপক্ষ দলের পুরোনো খেলাগুলো দেখতেন বিরাট কোহলিখেলার ফল হয়তো সব সময় হজম হয় না সাকিব আল হাসানের; তবে তাঁর খাবারের মেন্যুতে ফল থাকত সব সময়। কদিন আগে শেষ হওয়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময় খুব কাছ থেকে এ ক্রিকেটারকে দেখেছেন প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলের ওয়েটার মিরাদুল ইসলাম। সাকিবের ফলপ্রীতির তথ্য মিলল তাঁর কাছ থেকেই। সাকিবের ফলপ্রীতির পেছনে স্ত্রী উম্মে আহমেদ শিশিরের হাতও থাকতে পারে। কারণ, মিরাদ বলছিলেন, ‘অধিকাংশ সময় খাবারের অর্ডার দিতেন সাকিবের ওয়াইফ।’ যাক, মাঠের শিশির নিয়ে দুশ্চিন্তা করলেও ঘরের শিশির বরং সাকিবকে অনেক চিন্তা থেকেই রেহাই দিচ্ছেন! হোটেল কক্ষ থেকে সাকিব যে খুব বেশি বেরোতেন তা নয়, তবে মাঝেমধ্যে চক্কর দিয়ে যেতেন হোটেলের ভেতরের ডিপার্টমেন্ট স্টোর কিওস্কে। দোকানের মালিকদের একজন শোয়েব শরীফের ভাষায়, ‘একটা উঁকি দিয়ে চলে যেতেন।’
বিরাট-উপহার
ভারতের বিরাট কোহলি অবশ্য কেবল উঁকি দিয়েই চলে যাননি। বলতে গেলে প্রায় প্রতিদিনই ঢুঁ মারতেন কিওস্কে। প্রতিদিনের আসা-যাওয়ায় বেশ ভালো খাতিরও জমে গিয়েছিল দোকানের মালিকদের একজন ওয়াকার আহমেদের সঙ্গে। দেশে ফেরার আগে নিজের একটা জ্যাকেটও উপহার দিয়ে যান তাঁকে। ওয়াকারের ভাষায়, ‘এটা ছিল বিরাট- উপহার! প্রতিদিন এসে মূলত বাদাম, চকলেট, ডিভিডি ও পারফিউমই কিনতেন। আমাদের দোকানে সবচেয়ে বেশি এসেছিলেন ভারত ও পাকিস্তানের প্লেয়াররা। আমাদের মুশফিকুর রহিমও বেশ কয়েকবার ডিভিডি কিনে নিয়ে গেছেন। তামিম ইকবাল বেশি কিনতেন চকলেট ও পারফিউম।’
বিরাট প্রসঙ্গে বললেন ওয়েটার গোলাম কবীর, ‘খুব ঠান্ডা স্বভাবের বিরাট। অবসর সময়ে ঘরেই বসে থাকতেন। গেমস খেলতেন আর খুব মনোযোগ দিয়ে বিপক্ষ দলের আগের খেলাগুলো দেখতেন। এটা প্রায় প্রতিটি দেশের প্লেয়াররাই করতেন। বিরাট এ ক্ষেত্রে বেশি মনোযোগী ছিলেন।’
বাংলাদেশের ক্রিকেটার জাহানারা আলমের সঙ্গে ক্রিস গেইলছবি তোলায় ‘না’ ছিল না সাঙ্গাকারারঝকঝকে সাঙ্গাকারা
কেবল কুমার সাঙ্গাকারাই নন, পুরো শ্রীলঙ্কা দলই ছিল প্রাণবন্ত, আন্তরিক। প্রশংসায় ‘অষ্টমুখ’ দেখা গেল রূপসী বাংলা হোটেলের বীথিকা রেস্তোরাঁর আট কর্মীকে। সুপারভাইজার ইউসুফ আলীর বিশ্বাস, তাঁর তৈরি করা এক বিশেষ ডেজার্ট খেয়েই ফাইনালে বাজিমাত করেছিলেন সাঙ্গাকারা, ‘ফাইনালের আগের দিন ওকে বললাম, তোমার জন্য বিশেষ এক ডেজার্ট তৈরি করেছি। কালকে কিন্তু জিততে হবে। সাঙ্গাকারা খেয়ে তো মুগ্ধ। পরদিন সত্যি সত্যি ও দারুণ খেলল!’ অটোগ্রাফ কিংবা ফটোগ্রাফ—কোনো কিছুতেই ‘না’ ছিল না সাঙ্গার। ছবি তুলতে চাইলেই মুখে ট্রেডমার্ক হাসি টেনে দাঁড়িয়ে যেতেন ভক্তদের পাশে। ফাইনাল শেষে তো প্রায় জোর করেই ট্রফিটা ধরিয়ে দিলেন বীথিকার রেস্তরাঁর ওয়েট্রেস রোজলিন গোমেজের হাতে! তারপর হাসিমুখে আরেকটা ছবি।
‘আফটার ডিনার’ গেইল
মাঠে তাঁর হাত ও ব্যাট স্থির থাকার ‘জিনিস’ নয়। খাবার টেবিলে অবশ্য দারুণ স্থির ও মনোযোগী ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিস গেইল। উঠেছিলেন রূপসী বাংলা হোটেলে। সেখানকার রোজলিন গোমেজের মতে, গেইল ভীষণ চুপচাপ, ‘রাতে ডিনার করতে এলে গেইলের ভক্তরা ছবি তোলার আবদার করত। আর গেইল সব সময় একটা কথাই বলতেন, “নট নাউ!” ভক্তরা জিজ্ঞেস করত, “হোয়েন?” গেইলের রেডিমেড জবাব, “আফটার ডিনার”। ডিনারের জন্য কমসে কম দেড় থেকে দুই ঘণ্টা লাগত গেইলের। ভক্তরা তো তখনো অপেক্ষা করত। মাঝেমধ্যে মন-মেজাজ ফুরফুরে থাকলে গেইল ছবি তুলতেন, অটোগ্রাফ দিতেন।’ মাঠে গ্যাংনাম নৃত্যে পটীয়সী হলেও হোটেলে যে গেইল স্থিরতায় পটীয়সী ছিলেন, এটা আবার জানা গেল রূপসী বাংলা হোটেলের গেস্ট রিলেশন ম্যানেজার সায়মা বিলকিসের কাছে, ‘কেন জানি না, গেইল সব সময় দলছুট থাকতেন! সেমিফাইনালের আগে মাঠে যাচ্ছেন, আমরা সবাই তাঁকে “গুড লাক” বললাম। বললেন, “মন ভালো নেই!” জানতে চাইলাম, “কেন?” গেইল জানালেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজে ওঁর সন্তান নাকি অসুস্থ। সেদিনের মতো মলিন গেইলকে আর কখনো দেখিনি।’

মালিঙ্গার আসল চুল
মালিঙ্গার চুলগুলো কিন্তু নকল নয়‘মালিঙ্গাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার চুলগুলো কি আসল? ও মাথাটা নিচু করে বলল, “পরখ করে দেখো”।’ সায়মা বিলকিস কি আর লাসিথ মালিঙ্গার চুল টেনে দেখার সুযোগ ফেলে দিতে পারেন! বেশ জোরেশোরে টেনেই নিশ্চিত হলেন মালিঙ্গার চুল ‘আদি ও অকৃত্রিম’। ‘খুব কিউট একটা কালার করে ও চুলে। কোন ধরনের কালার যে ব্যবহার করে তা আর জিজ্ঞেস করা হয়নি!’
সায়মার কিঞ্চিৎ আফসোস থাকলেও রূপসী বাংলা হোটেলের রিক্রিয়েশন ক্লাবের অ্যাটেনডেন্ট রায়হানের মোটেও আফসোস নেই। মালিঙ্গার ব্যবহারে যারপরনাই মুগ্ধ রায়হানের চোখে শ্রীলঙ্কা দলটাই সবচেয়ে শৃঙ্খলাপরায়ণ ও আন্তরিক ছিল।
স্যুপ ভালোবাসেন ওয়াটসনফাইভ স্টার অস্ট্রেলিয়া
অন্যদিকে ওই রূপসী বাংলার রিক্রিয়েশন ক্লাবের সুপারভাইজার ফারুক আহমেদ মনে করেন, অস্ট্রেলিয়া দল ‘চূড়ান্ত ভদ্র’। তাঁর ভাষায়, ‘ওরা আসলেই ফাইভ স্টার মানের প্লেয়ার। খুব দিলখোলা, মিশুক। সবার সঙ্গেই সম্মান দিয়ে কথা বলত। ওরাই সবচেয়ে পরিশ্রমী। এ ছাড়া আয়ারল্যান্ড দলও সমান নম্বর পাওয়ার যোগ্য।’ মাঝে যোগ করলেন রায়হান, ‘ওরা সময় পেলেই জিমে আসত, সাঁতার কাটত। শারীরিক ফিটনেসের জন্য অস্ট্রেলিয়া দলটা জান দিয়ে দেয়। সবচেয়ে মজা হতো ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্লেয়াররা এলে। ওরা এসেই গান বাজিয়ে নাচানাচি শুরু করত। নাচই যেন ওদের শারীরিক কসরত!’
করলার জুস খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন জয়াসুরিয়াস্যুপ-ওয়াটসন ও জয়াসুরিয়ার করলার জুস
রূপসী বাংলার রোজলিন একদিন খেয়াল করলেন, অস্ট্রেলিয়ার শেন ওয়াটসন স্যুপই বেশি খান। তাই জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইউ লাইক স্যুপ?’ ওয়াটসনের জবাব, ‘উঁহু, আই লাভ স্যুপ!’ তার পর থেকে আরও যত্ন করে স্যুপের জোগান দেওয়া হলো ওয়াটসনকে। সনাথ জয়াসুরিয়ার ‘এক নম্বরের’ পছন্দ আবার করলার জুস। একগাদা করলা ব্লেন্ডারে ব্লেন্ড করে দেওয়া হতো মগ ভর্তি করে। সাতসকালে ঢকঢক করে খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতেন শ্রীলঙ্কার সাবেক অধিনায়ক!
খাবারেও পেশাদারি
খাবারদাবার নিয়ে বেশ খানিকটা ভুগিয়েছেন ভারতের রোহিত শর্মা। ‘এটা খাব না, ওটা খাব না’ স্বভাব আছে তাঁর। সোনারগাঁওয়ের মিরাদুল বলছিলেন, ‘খিদে সহ্য করতে পারেন না রোহিত! মাঠ থেকে এলে বা প্র্যাকটিস শেষেই খাবারের জন্য হাঁক-ডাক শুরু করতেন। ওঁরা খাবারের বেলায়ও দারুণ পেশাদার। ভারতের তো কিছু সিক্রেট খাবারও ছিল। ওই খাবার ওঁরা নিজেরাই নিয়ে এসেছিল। এটা শচীনের বেলায়ও দেখেছি। প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবারেই ওঁরা বেশি মনোযোগী।’ অন্যদিকে ভারত অধিনায়ক ধোনি ছিলেন ঢাকার বিরিয়ানিতে মুগ্ধ। বাকিরা অবশ্য স্যামন মাছের বিভিন্ন পদ ও সবজিই বেশি খেয়েছেন। দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের খেলোয়াড়দের প্রিয় ছিল স্টেক স্যান্ডউইচ।
সোনারগাঁওয়ের ডিপার্টমেন্ট স্টোর কিওস্কে অধিনায়কদের অটোগ্রাফওয়ালা ব্যাটআমুদে আফ্রিদি
‘মুখে সারাক্ষণ বিশাল একটা হাসি।’ সোনারগাঁও হোটেলের হোম অ্যাটেনডেন্ট আবদুল করিম বলছিলেন, ‘দেখা হলেই আফ্রিদি এসে কাঁধে হাত রাখতেন। জানতে চাইতেন, কেমন আছি না-আছি। তিনি যে অনেক বড় তারকা, এটা কখনো বুঝতে দিতেন না। মনে হতো যেন পাড়ার বড় ভাই। আসলে বড় প্লেয়ারদের মন-মানসিকতাও বড়।’ আরেক হোম অ্যাটেনডেন্ট মাহবুবুর রহমান সরকার জানালেন, পাকিস্তানের খেলোয়াড়েরা সব সময় একই কক্ষে একসঙ্গে সবাই খেতে চাইতেন। আফগানিস্তানও ঠিক তেমনই। ঘরের মেঝেতে বসেই নাকি খাওয়াদাওয়ার পর্ব সেরেছেন পুরোটা সময়। আর তাঁদের প্রিয় মেন্যু ছিল নানরুটি। পাকিস্তানের প্রিয় খাবারের তালিকায় সবার ওপরে ছিল মধু ও গ্রিল চিকেন।
স্টেইন-গান
শরীরী ভাষায় ‘ওস্তাদ’ ছিলেন ডেল স্টেইন। দক্ষিণ আফ্রিকার এ স্পিড মেশিনের অন্ধ ভক্ত বনে গেছেন সোনারগাঁও হোটেলের আরেক ওয়েটার শফিকুল ইসলাম। ইংরেজিতে খুব একটা কথা না হলেও অনেক কিছুই বুঝে ফেলতেন স্টেইনের শরীরী ভাষায়, ‘রুমে খাবার নিয়ে গেলেই ও বাচ্চাদের মতো করত! মনে হতো কত পুরোনো পরিচয় আমাদের। আমার কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলত, “ওহ মাই ফ্রেন্ড, ইউ ব্রিং ফুডস ফর মি”!’ কেবল খাবার দেওয়ার সময়ই নয়, পাগলাটে স্টেইনের চঞ্চলতা শফিকুল খেয়াল করেছেন সব সময়। সারাক্ষণ মুখে একটা চওড়া হাসি, কানে এয়ারফোন। অবসরের বেশির ভাগ সময় গানই শুনতেন স্টেইন। মাঠে বল হাতে স্টেইনগানের মতো গুলি ছোটালেও স্টেইনের ভেতরটা নাকি ‘খুব নরম’।
হোটেলেও জনপ্রিয় সৌরভসৌরভের দাদাগিরি
সব মিলিয়ে জনপ্রিয়তার স্কেলের মাপামাপি করা হলে বুঝি ‘দাদা’ই সবচেয়ে ওপরে থাকতেন। ওয়েটার, রুম সার্ভিস, জিম, ডিপার্টমেন্ট স্টোরের মালিক থেকে হোটেল কর্মকর্তা—প্রায় সব পর্যায়েই দারুণ জনপ্রিয় সৌরভ গাঙ্গুলী। তাঁর আচার-ব্যবহার নাকি আমাদের মতোই। বলছিলেন রুম অ্যাটেনডেন্ট আবদুল করিম, ‘দাদাকে একদিন বললাম, “তুমি তো ‘দাদাগিরি’র দাদা! তুমি আমাদের মন জয় করেছ।” দাদা আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, “তোমরাও আমার মন জয় করেছ। তোমাদের আতিথেয়তার তুলনা হয় না, দাদা!” শুনে মনটা ভরে গেছে।’