• মঙ্গলবার , ২১ মে ২০২৪

আলু-পটোলের ব্যবসায়ীরাও রাজনীতিতে..


প্রকাশিত: ১২:২২ এএম, ২৫ সেপ্টেম্বর ১৪ , বৃহস্পতিবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ২৪৪ বার

 

Shahara_Cartoonমহিউদ্দিন আহমদ:  আমাদের সামাজিক মানসে যে কয়টি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আছে, ‘রাজনীতি’ তার মধ্যে অন্যতম। আমরা সবাই কমবেশি রাজনীতি চর্চা করি। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ না করলেও রাজনৈতিক মতামত দেওয়া কিংবা মন্তব্য করার ক্ষেত্রে আমরা খুবই পারঙ্গম।
রাজনীতি চর্চার একটি আবশ্যকীয় অনুষঙ্গ হলো নির্বাচন। সমাজে একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ ঘটানোর জন্য নির্বাচন–প্রক্রিয়া খুবই জরুরি। নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ তৈরি হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রসংগঠনগুলোর রাজনীতি চর্চার পক্ষে এটা উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ছাত্ররাজনীতির ফলে পরবর্তী সময়ে জাতীয় রাজনীতিতে ঢোকার পথ খুলে যায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ার ফলে এই ধারণা ক্রমেই জোরদার হচ্ছে যে এর ফলে জাতীয় রাজনীতির সাপ্লাই লাইন বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে সুস্থ নেতৃত্ব গড়ে উঠছে না। রাজনীতি ক্রমেই মাফিয়া চক্রের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ছে।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে ছাত্র সংসদের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নির্বাচিত ছাত্রনেতারা অনেক অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পান। একই সঙ্গে সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে সংযোগ ও সম্পৃক্ততার ফলে তাঁদের জবাবদিহির ক্ষেত্র তৈরি হয়। তবে সব সময় যে এটা ঘটে, তা নয়। একবার নির্বাচিত হয়ে গেলে তখন আর তাঁদের অনেকের টিকিটিরও নাগাল পাওয়া যায় না।

ছাত্র সংসদগুলোর আরও একটা ইতিবাচক দিক আছে। তারা ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে সংযোগ হিসেবে কাজ করার সুযোগ পায়। ফলে ছাত্র ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের কাজটা সহজতর হতে পারে।
এ দেশে একটা সময় ছাত্রসংগঠনগুলো ছিল স্বাধীন। অনেক ছাত্রসংগঠন জাতীয়ভিত্তিক রাজনৈতিক দলের সমর্থক ও সহযাত্রী হলেও তাদের মধ্যে সম্পর্ক হতো অনানুষ্ঠানিক। যেমন ছাত্রলীগ ছিল আওয়ামী লীগের সহগামী। অন্যদিকে ছাত্র ইউনিয়ন ছিল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সহযোগী।

বিপত্তি বাধায় জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি এই সংগঠনটিকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনেম খান নিজের পকেটে পুরে ফেলেন। ক্যাম্পাসে যদি একটি সংগঠন সরকারের পেটোয়া বাহিনী হয়ে যায়, তখন আর সুস্থ রাজনীতি থাকে না। জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন বা এনএসএফ এ দেশের ছাত্ররাজনীতিতে যে ধারার প্রবর্তন করেছিল, পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগ একই ধারাবাহিকতা বজায় রাখে।

১৯৭৩ সালে ডাকসুর ব্যালট বাক্স ছিনতাই করার মধ্য দিয়ে তারা কুদৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। পরবর্তী সময়ে বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় এলে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলও শিক্ষাঙ্গনে জবরদখলের ধারা বজায় রাখে। জিয়াউর রহমানের সেনাশাসনে একটা পরিবর্তন আনা হয়েছিল। তখন রাজনৈতিক দলবিধি জারি করা হয় এবং ছাত্রসংগঠনগুলোকে রাজনৈতিক দলগুলোর শাখা হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে হয়েছিল। সেই ট্র্যাডিশন চলছে এখনো।
এ দেশে যখন নিয়মিত ছাত্র সংসদের নির্বাচন হতো, তখন যে সব সময় সত্যিকার ছাত্ররাই নির্বাচিত হতেন, তা নয়। অনেকেই নির্বাচন করার জন্য বছরের পর বছর ছাত্র থেকে যেতেন। একটা উদাহরণ দিই। মাহমুদুর রহমান মান্না ঢাকা কলেজে আমার এক ক্লাস ওপরে পড়তেন।

ওবায়দুল কাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার দুই বছর সিনিয়র ছিলেন। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব শেষ করার পাঁচ বছর পরেও দেখেছি তাঁরা দোর্দণ্ড প্রতাপে ছাত্রত্ব বজায় রেখে চলেছেন এবং ডাকসুর নির্বাচন করেছেন। এটাও ছাত্রসংগঠনগুলোর একধরনের দেউলিয়াপনা। বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে আমার দেখা একমাত্র নির্বাচিত ছাত্র সংসদ নেতা ছিলেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, যিনি ছিলেন নিয়মিত ছাত্র। বাকিরা সবাই বছরের পর বছর জোর করে ছাত্র থেকে যেতেন নির্বাচন করার জন্য।
নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জনের জন্য নির্বাচনই একমাত্র পথ নয়। পাঠ্যক্রমের বাইরে নানা সৃজনশীল কাজের মধ্যে থেকেও একজন ছাত্র নানা গুণের অধিকারী হতে পারেন। এখানে আমি আরেকটা উদাহরণ দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না। হ্ুমায়ূন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সিনিয়র ছাত্র ছিলেন। তাঁকে জীবনে কোনো দিন কোনো মিটিং-মিছিলে অংশ নিতে দেখিনি।

ইউনিভার্সিটির হলের করিডরে মিছিল হলে অনেক ‘ভালো ছাত্র’ দরজা বন্ধ করে বাতি নিভিয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতেন, যাতে অন্যরা তাঁদের মিছিলে যাওয়ার জন্য টানাটানি না করেন। হ্ুমায়ূন ছিলেন ওই রকম একজন ছাত্র। রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে লেখাপড়ার ক্ষতি হোক, এটা তিনি চাইতেন না। পরে তিনি দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক হতে পেরেছিলেন। আর ওই সময়ের অনেক সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মী এখনো ভবঘুরের মতো জীবনযাপন করেন।
কথা হচ্ছিল ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচন না হওয়া এবং ছাত্রদের নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জনের পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা নিয়ে। অনেকেই বলে থাকেন, এর ফলে সমাজে বিরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়া চালু হয়েছে।

কেউ কেউ এমনও বলে থাকেন যে সামরিক সরকারগুলো ইচ্ছে করেই তরুণ সমাজকে বিরাজনীতিকরণের পথে ঠেলে দিয়েছে। কথাটা এক অর্থে সত্য। রাজনৈতিক সচেতনতা না থাকলে এবং সমাজে প্রতিবাদী ধ্যানধারণা অনুপস্থিত থাকলে স্বৈরাচারের পথ সুগম হয়। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, এ দেশে স্বৈরাচার এসেছে বারবার, যখন ছাত্ররাজনীতি ছিল জোরদার। এটা ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৯ এবং ১৯৭৪ সালে দেখা গেছে। দেশে ১৯৯১ সালে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠনের অভিযাত্রা শুরু হওয়ার পর আমরা দেখলাম, ছাত্র সংসদ নির্বাচন পুরোপুরি নির্বাসনে চলে গেল।
যাঁরা কথায় কথায় বিরাজনীতিকরণের অভিযোগ তুলে ধরেন, তাঁদের কথায় রয়েছে মারাত্মক বৈপরীত্য। যাঁরা প্রবল প্রতাপে রাজনীতির মাঠ কাঁপিয়েছেন বা এখনো কাঁপাচ্ছেন, ব্যতিক্রম বাদে তাঁরা কেউই সন্তানদের ছাত্ররাজনীতিতে আনেননি। তাঁরা সময় ও সুযোগমতো তাঁদের সন্তানদের বিদেশে পাঠিয়ে দেন ‘উচ্চশিক্ষা’ নিতে, অথবা দেশেই রেখে দেন ব্যবসাপাতি করার জন্য। যখন সময় হয়, যখন তাঁদের শরীর-স্বাস্থ্যে কুলোয় না কিংবা যখন তাঁরা ইন্তেকাল করেন, তখন তাঁদের সুযোগ্য সন্তানেরা উত্তরাধিকার সূত্রে মা-বাবার নির্বাচনী এলাকাটির মালিকানা পেয়ে যান।

যেসব নেতা-নেত্রী ছাত্ররাজনীতির ‘নোংরা কাদা’ তাঁদের সন্তানদের গায়ে লাগতে দেন না, তাঁরা তাঁদের রাজনীতিতে কামানের খোরাক হিসেবে ব্যবহার করেন অন্যের সন্তানদের। এই প্রবণতা ডান, বাম, মধ্য সব রঙের রাজনীতিকদের মধ্যেই দেখা যায়।
একটা সময় ছিল, যখন এ দেশে শিল্পকারখানা ছিল না, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান তেমন একটা গড়ে ওঠেনি, একমাত্র আইন ব্যবসাই ছিল রাজনীতিকদের প্রধান পেশা। তাই রাজনীতিকদের মধ্যে আইন ব্যবসায়ীর ছড়াছড়ি দেখা যেত।

সময় বদলে গেছে। এখন যাঁরা ইট-পাথর কিংবা আলু-পটোলের ব্যবসা করেন, তাঁরাও রাজনীতিতে আসছেন। এটাকে অনেক আইন ব্যবসায়ী বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ার নমুনা হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু ইট-পাথর-আলু-পটোল ব্যবসায়ীদেরও যুক্তি আছে। তাঁরা মনে করেন, তাঁদের চাঁদায় যদি অন্যরা রাজনীতি করেন, পার্লামেন্টে আস্তিন গুটিয়ে হাঁকডাক করতে পারেন, তাহলে তাঁরাই বা পিছিয়ে থাকবেন কেন? প্রতিযোগিতামূলক বাজারে এটাই তো স্বাভাবিক।
আমাদের দেশে রাজনীতি অন্যান্য শিল্প-ব্যবসার মতোই এখন একটি লাভজনক বিনিয়োগ। রাজনীতি শুরুর আগে এবং বর্তমান অবস্থার মধ্যকার পার্থক্যটুকু খুঁজলেই এই সম্ভাবনাময় বিনিয়োগের ক্ষেত্রটি বুঝতে সুবিধা হয়। সুতরাং এই প্রক্রিয়ায় শামিল হচ্ছেন অনেকেই। এটাকে বিরাজনীতিকরণ বলব, নাকি এটাই স্বাভাবিক প্রবণতা? মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।