• মঙ্গলবার , ১২ নভেম্বর ২০২৪

হামিদ মীরকে হত্যা করতে চেয়েছে আইএসআই


প্রকাশিত: ৩:৩৪ এএম, ২৬ এপ্রিল ১৪ , শনিবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ১০৮ বার

 

মশিউল আলম:   করাচির আগা খান হাসপাতালের শল্যচিকিৎসকেরা সাংবাদিক হামিদ মিরের শরীর থেকে মোট ছয়টি বুলেট বের করেছেন। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে হামিদ মির আবারও বলেছেন, তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছে আইএসআই। তাঁর ছোট ভাই আমির মির বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলন ডেকে সেই অভিযোগ আবার প্রচার করেছেন।

গত শনিবার করাচিতে হামিদ মির গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় বেসরকারি টিভি চ্যানেল জিয়ো টিভির পর্দাজুড়ে দেখানো হয় আইএসআইয়ের প্রধান লে. জেনারেল জাহির উল-ইসলামের ছবি। হামির মির বলেছেন, তাঁর ওপর হামলার জন্য এই জেনারেলই দায়ী। আইএসআই খেপে গিয়ে জিয়ো টিভি বন্ধ করে দিতে বলে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে পাকিস্তানের সম্প্রচার গণমাধ্যম পরিচালনা কর্তৃপক্ষকে (পেরমা) চিঠি পাঠিয়ে বলা হয়, জিয়ো টিভির লাইসেন্স বাতিল করুন। কিন্তু পেরমা কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগেই ইসলামাবাদ, রাওয়ালপিন্ডিসহ অনেক শহরের সেনানিবাস এলাকায় জিয়ো টিভির সম্প্রচার বন্ধ হয়ে গেছে। বিভিন্ন সেনানিবাস থেকে কেব্ল অপারেটরদের হুকুম দিয়ে এটা করা হয়েছে।
হামিদ মিরের ওপর হামলার পেছনে আইএসআইয়ের হাত ছিল—হামিদ মিরের এই অভিযোগ জিয়ো টিভি প্রচার করেছে বলে পেরমা জিয়ো টিভিকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠিয়েছে। এই অভিযোগের পক্ষে জিয়ো টিভির হাতে কী প্রমাণ আছে—এটাও পেরমার একটা জিজ্ঞাসা। পাকিস্তানে এমন একটা সাধারণ ধারণা বেশ জোরালো হয়ে উঠেছে যে আইএসআই সাংবাদিকদের ভয়ভীতি দেখায়, অপহরণ ও নির্যাতন করে, এবং কখনো কখনো হত্যাও করে। পাকিস্তানের সাংবাদিকেরা এখন আর এ কথা লিখতে বা বলতে ভয় পান না।
হামিদ মির গুলিবিদ্ধ হওয়ার এক দিন পর পাকিস্তানের আরেক সাংবাদিক ও ঔপন্যাসিক মোহাম্মদ হানিফ লন্ডনের দৈনিক গার্ডিয়ান পত্রিকায় একটি বড় নিবন্ধের এক জায়গায় লিখেছেন, তিন বছর আগে ইসলামাবাদে টিভি সাংবাদিক সালিম শেহজাদ বাসা থেকে টিভি স্টুডিওতে যাওয়ার পথে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। তার কয়েক মাস আগে তিনি মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন যে তিনি আইএসআইয়ের কাছ থেকে হুমকি পেয়েছেন। নিরুদ্দেশ হওয়ার পরদিন তাঁর লাশ পাওয়া যায় একটা খালে, নির্মম নির্যাতনের চিহ্ন ছিল তাঁর সারা শরীরে। মোহাম্মদ হানিফ লিখেছেন, তিনি তখন ডজন খানেক সাংবাদিকের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলেন, প্রত্যেকেই তাঁকে বলেছিলেন, সালিম শেহজাদকে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে ফেলে দিয়েছে আইএসআই। কিন্তু এক বর্ষীয়ান সাংবাদিক মোহাম্মদ হানিফকে বলেছিলেন, আইএসআইয়ের বিরুদ্ধে সাংবাদিক হত্যার অভিযোগ তোলার আগে তোমাদের সতর্ক হওয়া উচিত। কারণ, ‘আইএসআই কখনো কখনো সাংবাদিকদের তুলে নিয়ে যায় বটে, কিন্তু হত্যা করে না।’
পাকিস্তানের বর্ষীয়ান সাংবাদিকেরা নাকি এখনো এমন বিশ্বাসই বুকে ধারণ করে আছেন। হামিদ মির গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরও নাকি তাঁরা টিভি চ্যানেলগুলোতে হাজির হয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন, আইএসআইয়ের দিকে অভিযোগের আঙুল তাক করার বিপদটা কী। কিন্তু মোহাম্মদ হানিফ কিংবা হামিদ মির, কিংবা রাজা রুমি—পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়সের পাকিস্তানি সাংবাদিকেরা এখন অকপটে ও প্রকাশ্যে বলছেন, আইএসআই আগে সাংবাদিকদের সেন্সর করত, এখন তারা আমাদের গুলি করছে। হামিদ মিরের সপ্তাহ তিনেক আগেমলা হয়েছে; তিনি ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন, কিন্তু তাঁর গাড়িচালক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। হামলার পর রাজা রুমি পাকিস্তানের বাইরে চলে গেছেন। হামিদ মিরও যে আরও আগেই আক্রান্ত হননি, সেটাই বরং অস্বাভাবিক ঠেকছে এখন। কারণ, তিনি অনেক আগে থেকেই বলে আসছিলেন যে আইএসআই তাঁকে হত্যা করবে। এমনকি তিনি রিপোর্টার্স সান্স ফ্রন্টিয়ার্সের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে এই আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন যে আইএসআই তাঁর ‘ক্ষতি করবেহামিদ মির গুলিবিদ্ধ হয়ে চেতনা হারিয়েছিলেন। হাসপাতালের বিছানায় যখন তাঁর চেতনা ফিরে আসে, তখন তিনি বলেন, তিনি আইএসআইকে সবচেয়ে বেশি ভয় পান। কারণ, এই সংস্থার পক্ষ থেকে হুমকি শুধু তাঁর নিজের ওপর নয়, তাঁর পরিবারের সদস্যদের ওপরও আছে। তিনি বলে রেখেছেন, তাঁর পরিবারের কোনো সদস্যের যদি কিছু হয়, তাহলে সে জন্য দায়ী থাকবে রাষ্ট্রীয় সংস্থা ও সরকার। তিনি আরও বলেছেন, আইএসআই তাঁর ওপর ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়েছে জিয়ো টিভিতে মামা কাদির বালুচের লংমার্চ প্রচার করার পর। বেলুচিস্তানে বিপুলসংখ্যক মানুষ গুম হওয়ার প্রতিবাদে কোয়েটা থেকে করাচি ওই লংমার্চ হয়েছিল মামা কাদির বালুচ নামে ৭২ বছর বয়সী এক ব্যক্তির আহ্বানে। হামিদ মির শুধু জিয়ো টিভিতেই ওই লংমার্চ প্রচার করেননি, একই মিডিয়া গ্রুপের উর্দু ও ইংরেজি ভাষার সংবাদপত্রগুলোতে লেখালেখিও করেছেন। তিনি বেলুচিস্তানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে খুব সোচ্চার সাংবাদিকদের একজন। হামিদ মির মনে করেন, তাঁর ওপর আইএসআইয়ের ক্রুদ্ধ হওয়ার আরও একটা কারণ হলো, তিনি সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক বিষয়ে নাক গলানোর বিরুদ্ধে টিভিতে ক্রমাগত কথা বলেছেন এবং পত্রিকায় লিখেছেন। আইএসআইয়ের ব্যাপারে তিনি লিখেছেন, কোনো সংস্থাই জবাবদিহির ঊর্ধ্বে থাকতে পারে না, আইন ও সংবিধানের ঊর্ধ্বে কেউ নয়।
হামিদ মিরকে হত্যা করার চেষ্টা এর আগেও হয়েছে। কিশোরী মালালা ইউসুফজাইয়ের পক্ষে লেখালেখি করার কারণে তালেবান তাঁর ওপর ক্রুদ্ধ হয়েছে এটা তিনি জানেন; আবার এ-ও জানেন, তালেবান তাঁকে হত্যা করলে আইএসআই খুশি হবে। বছর দেড়েক আগে তাঁর গাড়ির নিচে আধা কেজি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক পাওয়া গিয়েছিল। পুলিশ পরে বলেছিল, যারা ওই বিস্ফোরক পেতেছিল, তারা রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে তা ফাটাত। কিন্তু কোনো কারণে সেটা ঘটেনি। পরে তালেবান বোমা পেতেছিল বলে স্বীকার করেছিল এবং বলেছিল, তারা হামিদ মিরকে অবশ্যই হত্যা করতে চায়। তারপর তিনি ফোনেও হত্যার হুমকি পেয়েছেন; সেসব ফোন নম্বর ইসলামাবাদের পুলিশ কর্তৃপক্ষকে দিয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ বা সরকার এ নিয়ে আর কিছুই করেনি বলে হামিদ মিরের সন্দেহ, এর পেছনেও আইএসআই থাকতে পারে।
একবার গোয়েন্দা সংস্থার কিছু লোক হামিদ মিরের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে বলেছিল, তারা একটা হিট লিস্ট পেয়েছে, যাদের হত্যা করা হবে। ওই হিট লিস্টে অন্যান্য সাংবাদিকের সঙ্গে হামিদ মিরেরও নাম আছে। কিন্তু গোয়েন্দারা এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছুই তাঁকে বলেননি। হামিদ মির এটাকেও পরোক্ষভাবে একধরনের ভীতি প্রদর্শন বলে মনে করেন। তিনি করাচির ডন পত্রিকাকে বলেছেন, রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো লোকজনকে হুমকি দেয় বিভিন্ন গোষ্ঠীর নাম ব্যবহার করে।
হামিদ মিরের ওপর হামলার পর পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের দ্বন্দ্ব একটা লড়াইয়ের রূপ নিয়েছে। আইএসআইয়ের
প্রধানের ছবি টিভির পর্দায় দেখিয়ে বলা হয়েছে, সাংবাদিকের ওপর হামলার জন্য এই ব্যক্তি দায়ী। পাকিস্তানে এমন ঘটনা এর আগে কখনো ঘটেনি। এটা যে সম্ভব, সে কথাও হয়তো কেউ ভাবেনি। আইএসআইয়ের প্রধানসহ পুরো সেনাবাহিনী প্রথমে হকচকিয়ে গেছে, তারপর হয়েছে ক্রুদ্ধ।
কিন্তু তাতে সংবাদমাধ্যম ভয় পেয়ে চুপ করে থাকেনি, বরং প্রচণ্ড শোরগোল উঠেছে। নানা গোষ্ঠীস্বার্থে বিভক্ত সংবাদমাধ্যম ঐক্যবদ্ধ হয়েছে; সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়িয়েছেন মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবীসহ পুরো নাগরিক সমাজ। প্রচণ্ড এক সামাজিক চাপ তৈরি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ হাসপাতালে হামিদ মিরকে দেখতে গিয়েছিলেন; গঠন করা হয়েছে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন। তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, যেসব জায়গায় জিয়ো টিভির সম্প্রচার বন্ধ করা হয়েছে, সেখানে তা আবার চালু করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এসব হয়তো লোক দেখানো ব্যাপার। হয়তো হামিদ মিরের ওপর হামলাকারীদের টিকিরও নাগাল পাবে না বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে আচরণের ব্যাপারে আইএসআইকে হয়তো এবার কৌশল পরিবর্তনের কথা ভাবতে হবে।