• শুক্রবার , ১৫ নভেম্বর ২০২৪

সাহিত্যে নজরুলের দুই দশকের যুদ্ধ-


প্রকাশিত: ৩:১১ পিএম, ২৮ মে ১৪ , বুধবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ২৫৬ বার

 
শান্তনু কায়সার : তাঁর সাহিত্য যতটা জনপ্রিয়, ঠিক ততটা শিল্পিত নয়—কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে এমন মূল্যায়ন কারও কারও। আবার এই বক্তব্যের ভিন্নমতও আছে। নজরুল জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে এ সংখ্যার দুটি রচনায় রয়েছে নজরুলের লেখার শিল্পগুণ ও জনপ্রিয়তার নানা মাত্রা অনুসন্ধানের প্রয়াস

কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ মে ১৮৯৯—২৯ আগস্ট ১৯৭৬), প্রতিকৃতি: মাসুক হেলালদুই দশকের বেশি সাহিত্যজীবনে নজরুল বহু যুদ্ধ করেছেন৷ সামাজিক অন্যায় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে, স্বসম্প্রদায় ও প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে, সামন্ত ও পশ্চাৎপদ মানসিকতার বিরুদ্ধে, উন্নাসিক কিন্তু কূপমণ্ডূক শিক্ষিত সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে, ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে৷ কিন্তু একই সঙ্গে নান্দনিকতার নতুন সংজ্ঞা ও দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্যও তিনি যে সাহিত্যচর্চা ও সাধনার শেষ দিন পর্যন্ত লড়াই করেছেন, সেটা হয় দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে, নয় তা উপযুক্ত মনোযোগ আকর্ষণ কিংবা গুরুত্ব লাভ করেনি৷
সাহিত্যজীবনের প্রারম্ভিক পর্বে কবিকে স্বীকৃতি দিতে এবং তাঁর কবিতার মূল্যায়ন করতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসেছিলেন মোহিতলাল মজুমদার৷ মোসলেম ভারত-এর সম্পাদককে লেখা চিঠিতে তিনি বলেন, ‘কাজী সাহেবের কবিতায় কী দেখিলাম বলিব? কাব্যের যে অধুনাত্ম ছন্দঝঙ্কার ও ধ্বনিবৈচিত্র্যে এককালে মুগ্ধ হইয়াছিলাম, কিন্তু অবশেষে নিরতিশয় পীড়িত হইয়া যে সুন্দরী মিথ্যারূপিণীর ওপর বিরক্ত হইয়াছি কাজী সাহেবের কবিতা পড়িয়া সেই ছন্দঝঙ্কারে আবার আস্থা হইয়াছে৷’ ‘খেয়াপারের তরণী’র একটি স্তবক উদ্ধৃত করে তিনি দেখিয়েছেন, কাকে প্রকৃত কবি ও কাব্যশক্তি বলে৷ ‘ছন্দ যেন ভাবের দাসত্ব করিতেছে—কোনখানে আপন অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করে নাই…৷’ ‘কবিতাটি আবৃত্তি করিলেই বোঝা যায় যে শব্দ ও অর্থগত ভাবের সুর কোনখানে ছন্দের বাঁধনে ব্যাহত হয় নাই৷ বিস্ময়, ভয়, ভক্তি, সাহস, অটল বিশ্বাস এবং সর্বোপরি প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত একটা ভীষণ গম্ভীর অতিপ্রাকৃত কল্পনার সুর, শব্দবিন্যাস ও ছন্দঝঙ্কারে মূর্তি ধরিয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে৷’ বহু পরে ১৯৬৬-এর ৪ জুন কলকাতার দেশ পত্রিকায়, ‘সুনন্দর জার্নাল’-এ নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ‘কাজী নজরুল ইসলাম’-এ ‘কবির বাচন, রূপচিন্তা ও অকুতোভয় ছন্দবিস্তারে অনন্ততান্ত্রিকতা’র যে উল্লেখ করেছেন, তাতেও কবির এ স্বীকৃতি মেলে৷
কিন্তু মোহিতলালের ওই প্রথম মন্তব্যের পর পরবর্তীকালে তিনি যেমন নজরুলকে অস্বীকার ও অগ্রাহ্য করার জেদ ধরেছিলেন কিংবা হিন্দু ও মুসলিম রক্ষণশীলদের মতো ভেবেছিলেন, তিনি কেন হিন্দুদের দেব-দেবী নিয়ে কবিতা লিখবেন, তেমনি তাঁর ছাত্র নীরদচন্দ্র চৌধুরীর কাছেও কবির কবিতা চিৎকারের বেশি কোনো স্বীকৃতি অথবা মর্যাদা পায়নি৷ তিনি একে অশিক্ষিত পটুত্ব ছাড়া আর কিছুই ভাবেননি৷ (দ্র.: ষষ্ঠ অধ্যায়: দ্য লিটারেরি সিচুয়েশন ইন বেঙ্গল; দাই হ্যান্ড গ্রেট অ্যানার্ক, ইন্ডিয়া-১৯২১-১৯৫২)৷
ফলে, তাঁর জীবনের একটা অংশ কেটেছে সাহিত্যের সেই পর্বকে সংজ্ঞায়িত ও ব্যাখ্যা করতে গিয়ে৷ এ ক্ষেত্রে তাঁর দুটি রচনা বিশেষভাবে উল্লেখ্য—কবিতা ‘আমার কৈফিয়ত’ এবং প্রবন্ধ ‘আমার সুন্দর’৷ সাহিত্যে এটাও বিরল ঘটনা যে আবির্ভাবের স্বল্প সময়ের মধ্যেই লেখককে তাঁর রচনার সমর্থন ও ব্যাখ্যা করার জন্য এগিয়ে আসতে হচ্ছে৷ ১৯২১-এর ডিসেম্বরে ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে যাঁর প্রকৃত আবির্ভাব, তাঁকে ১৯২৫-এর সেপ্টেম্বরেই (১৩৩২-এর আশ্বিন) এর কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে৷
‘আমার সুন্দর’ অবশ্য তাঁর সাহিত্যজীবনের অন্তিম পর্বে নবযুগ-এর স্বাক্ষরিত সম্পাদকীয় প্রবন্ধ হিসেবে ১৯৪২-এ প্রকাশিত৷ ফলে, এ দুটি রচনা তাঁর সাহিত্যজীবনকে যেমন শুরু ও শেষের যুগলবন্দীতে ঋদ্ধ করেছে, তেমনি তাঁর অখণ্ড শিল্পমাত্রা হিসেবেও নিজেকে ব্যক্ত করছে৷ ‘আমার কৈফিয়ত’-এ আমরা তাঁর বিষয়ে সমকালীন প্রতিক্রিয়ার তালিকা যেমন পাই, তেমনি এখানে কবিকে আত্মপক্ষ সমর্থন করতেও দেখি৷ নিজের ও প্রতিবেশী ধর্মসম্প্রদায় এবং নানা বিচিত্র ও খণ্ডিত পরিচয় খারিজ করে দিয়ে কবি এখানে তাঁর আসল সত্তাকে তুলে ধরতে চেয়েছেন৷ তাতে প্রধান হয়ে উঠেছে কয়েকটি প্রসঙ্গ:
ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন৷
পরোয়া করি না বাঁচি বা না বাঁচি যুগের হুজুগ
কেটে গেলে৷
মাথার উপর জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে৷
প্রার্থনা করো—যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি
মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্তলেখায় তাদের সর্বনাশ৷
এই ক্ষোভ, যন্ত্রণা এবং তাঁকে শিল্পে রূপান্তরের জন্য নতুন আঙ্গিক ও কাঠামো আবিষ্কারের অসম্ভব আকাঙ্ক্ষা ও অস্থিরতা থেকে কবি বলেন:
বন্ধু গো আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে৷
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে
কই মুখে৷
মনে রাখতে হবে, নজরুল পরাধীন বঙ্গ ও ভারতবর্ষে আর সবার মতো পরিতৃপ্ত জীবন যাপন না করে উপনিবেশের অসহনীয় জ্বালা অনুভব এবং সেখান থেকে বেরিয়ে আসার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তিনি নিজের মধ্যে লালন করতেন৷ অধিকন্তু, তিনি বাস করতেন সামন্ততান্ত্রিক পিছুটান ও তার অবশেষের পশ্চাৎপদ এক সমাজে৷
তাঁর আবির্ভাবের আগেই শুরু হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আর তিনি যখন বাস্তবে পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত, তখন শুরু হয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ৷ তার প্রারম্ভিক পর্বে কবির পক্ষে তাই সবকিছু ‘দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া’ যাওয়া ছিল খুবই স্বাভাবিক৷ সাধারণ গড়পড়তা মানুষ অথবা কবি হলে কিংবা নবযশপ্রার্থী হিসেবে তাঁর পক্ষে রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কাব্য ও সাহিত্য বাস্তবতায় প্রচলিত ভাষা ও আঙ্গিকে আত্মসন্তুষ্ট কবিতা ও সাহিত্য রচনা হতো স্বাভাবিক৷ কিন্তু নজরুল সে পথের পথিক ছিলেন না৷ ফলে, ‘ক্ষেপিয়া’ যাওয়ার ভাব ও অনুভূতি প্রকাশের আঙ্গিকই তাঁকে খুঁজতে হয়েছিল৷ তাই বুকের ‘বিষ-জ্বালা’কে তিনি আপাতত যা মুখে আসে, তা হিসেবেই প্রকাশ করেছেন, তবু খাঁটি সেই অনুভবকে তরল, নমনীয় অথবা বিকৃত করেননি৷
একটি উদাহরণ থেকে বিষয়টিকে বোঝা যায়৷ বয়সে সামান্য বড় (জীবনানন্দের জন্ম ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯-এ, নজরুল একই সালের মে-তে) হলেও বাংলা সাহিত্যে জীবনানন্দের আবির্ভাব ১৯৩০-এর দশকে, নজরুল এসেছিলেন তার আগের বিশের দশকে৷ নজরুল ছিলেন দাহকালের প্রতিনিধি আর জীবনানন্দ স্থির প্রজ্ঞা ও প্রশান্তির মানুষ৷ তাঁর পক্ষে অপেক্ষা করা সম্ভব ছিল, নজরুলের পক্ষে নয়৷ তাই বয়স ডিঙিয়ে নজরুলের আগমন ঘটেছিল আগের দশকে, জীবনানন্দর পরের দশকে৷
নজরুল তাঁর সাহিত্যজীবনে একে পরিশীলিত ও পূর্ণ করেছেন৷ তারই শিল্পিত ও ঘনীভূত প্রকাশ ‘আমার সুন্দর’৷ সামান্য দুটি অংশ শুধু উদ্ধার করি৷ ১. ‘কোন্ নিষ্ঠুর এই সৃষ্টি করে, কেন সে শিশু-সুন্দরকে কেড়ে নেয়? এই শোকের মাঝে জেগে উঠল স্রষ্টার বিরুদ্ধে প্রগাঢ় অভিমান, সেই অভিমান ঘনীভূত হয়ে আমার সর্ব অস্তিত্বে দেখা দিল ভীষণ মৌন বিদ্রোহ হয়ে, বিপ্লব হয়ে৷ চারিদিকে কেবল ধ্বনি উঠতে লাগল, “সংহার কর! ধ্বংস কর! বিনাশ কর!” কিন্তু শক্তি কোথায় পাই৷ কোথায়, কোন্ পথে পাব সেই প্রলয়-সুন্দরের, সংহার-সুন্দরের দেখা?’ ২. ‘আগে তোমাকে এই অসুন্দরকে সুন্দর করতে হবে’, ‘তবে দাও আমার কণ্ঠে এই পৃথিবীর বিষ, করো আমার বিষ-সুন্দর নীলকণ্ঠ৷’

দুই.
নজরুল সম্পর্কে অভিযোগ ওঠে, তিনি উচ্চকণ্ঠ ও তাৎক্ষণিকতা-আক্রান্ত এবং হুজুগে৷ ‘আমার কৈফিয়ত’-এ স্বয়ং কবি অভিমানাহত হয়ে বলেছেন:
ভক্তরা বলে, ‘নবযুগ-রবি!—
যুগের না হই হুজুগের কবি
বটি ত রে দাদা,…
কিন্তু নজরুল যে হুজুগের নন, নন তাৎক্ষণিকতা-আক্রান্ত, তার সাক্ষ্য তাঁর লেখাতেই রয়েছে৷ ‘পলিটিক্যাল তুবড়িবাজি’ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘৩১ ডিসেম্বর, ১৯২৩ বা ফেব্রুয়ারির শেষ, ১৯২৬-এর ভিতর তাকে সীমাবদ্ধ করলে চলবে না৷’ তাঁর কবিতা ‘গোকুল নাগ’-এ কবি বলেছেন, ‘আজটাই সত্য নয়, কটা দিন তাহা?/ ইতিহাস আছে, আছে ভবিষ্যৎ৷’ এমনকি ‘কবিতার কথা’র অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধে নজরুল-কবিতা প্রসঙ্গে জীবনানন্দ যে বলেছেন, তিনি যেভাবে জনসাধারণের মনকে স্পর্শ করতে পেরেছেন, সেই লক্ষ্যে লেখা কবিতাকে পদ্যের স্তরে নামিয়ে এনেও অন্যরা তা করতে পারেননি, সেখান থেকেও নজরুলের ক্ষমতা ও শিল্পমূল্যকে বোঝা যায়৷ জীবনানন্দেরই ভাষায় নজরুলের কবিতা ‘মনন-প্রতিভা ও অনুশীলিত সুস্থিরতা’র মধ্য দিয়ে গিয়ে ‘অনুকরণযোগ্য’ হওয়ার ঊর্ধ্বে উঠতে এবং শিল্পমূল্যে ঋদ্ধ হতে পেরেছিল৷
মোহিতলাল মজুমদারও শনিবারের চিঠি-তে ‘নিরক্ষর’ বলে কবিকে কটাক্ষ করেছিলেন৷ বলেছিলেন, ‘কাজী সাহেব চেষ্টা করিয়া Marx, Lenin প্রভৃতি কম্যুনিস্টদিগকে স্বপক্ষে যুদ্ধে নামাইতে পারিতেন কিন্তু নিজে নিরক্ষর হওয়ায় তাহাদিগকে পাইয়াও সুবিধা করিতে পারিতেন না, ইহা নিশ্চিত৷ নিরক্ষরতাই তাঁহার পরাজয়ের প্রধান কারণ?’ কিন্তু নজরুলের জবানবন্দি থেকে বোঝা যাবে শিক্ষা ও জগৎ সম্পর্কে তাঁর প্রকৃত দৃষ্টি কী ছিল: ‘যখন আমি বালক তখন সকলের দিকে তাকিয়ে আমার কান্না আসত—বুকের মধ্যে বায়ু যেন রুদ্ধ হয়ে আসত৷ আমার কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে বলতাম—ঐ আকাশটা যেন ঝুড়ি, আমি যেন পাখির বাচ্চা, আমি অই ঝুড়িচাপা থাকব না—আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে৷ তাই ইউনিভার্সিটির দ্বার থেকে ইউনিভার্সের দ্বারে হাত পেতে দাঁড়ালাম৷’ ইউনিভার্সিটিকে ক্ষুদ্র ভেবে যিনি ইউনিভার্সের দ্বারে এসে দাঁড়ান, তাঁকে যাঁরা ওভাবে হেয় অথবা হীন করতে চান, তাঁদের শিক্ষা, নান্দনিক বোধ এবং আলংকারিক কাণ্ডজ্ঞান সম্পর্কেই বরং সংশয় জাগে৷

তিন.
নজরুল তাঁর একটি ভাষণে বলেছিলেন, ‘জীবনের পাত্র আমরা আবর্জনা দিয়ে বোঝাই করে রেখেছি৷’ যিনি সারা সাহিত্যজীবন আবর্জনা ঝেঁটিয়ে তাকে পরিষ্কার করে রাখতে চেয়েছেন, তিনি কী করে অশিল্পকে লালন করতে পারেন? যিনি মনে করেন, ইসলাম বা কোনো ধর্মের শাস্ত্র নিয়ে সাহিত্য করা যায় না, তার সত্য নিয়ে করা যেতে পারে, যিনি সবার বা নিজ সম্প্রদায়ের প্রিয় হওয়ার জন্যও লোভ ও প্রলোভনের কাছে আত্মসমর্পণ করেন না, উল্টো নির্মোহ ও অবিচল থাকেন, যিনি ধর্মের নির্যাসকে মানবসমাজে সম্পদ বলে গণ্য করেন, যিনি ‘অসুন্দরে ছেদন’ করে ‘ভয়ংকর সুন্দর’ ও ‘মধুর হাসি’কে আহ্বান করেন, তাঁর পক্ষে কখনোই অসুন্দর অথবা শিল্পশূন্যতার পক্ষে অবস্থান নেওয়া কিংবা নিজের রচনাকে স্থূল অথবা শিল্পহীন করা সম্ভব নয়৷ তাঁর রচনায়ই বরং সাক্ষ্য নেওয়া যাক: ‘আমি ফুলকে চুম্বন করলাম, অধরে, বক্ষে কপোলে রেখে আদর করলাম৷ ফুল বলল, “আমার সুন্দরকে পেয়েছি, আমার এই রূপ-রস-মধু-সুরভি নিয়ে তোমার মাঝে নিত্য হয়ে থাকব৷” এই আমি প্রথম পুষ্পিত সুন্দরকে দেখলাম৷ এইরূপে চাঁদের আলো, সকাল-সন্ধ্যার অরুণ-কিরণ, ঘনশ্যাম সুন্দর বনানী, তরঙ্গ-হিল্লোলিতা ঝর্ণা, ডাইনি, কুলহারা নীল-ঘন সাগর, দশদিক বিহারী সমীরণ আমার জড়িয়ে ধরল৷ আমার সাথে মধুর ভাষায় বন্ধুর মত সখার মত কথা কইল৷ আমার “আমার সুন্দর” বলে ডাকল৷’
প্রায় সবাই সমকালে বুঝতে ব্যর্থ হলেও অগ্রজ কবি তাই নজরুলকে শুরুতেই বুঝতে এবং তাঁর শিল্পমূল্য নিরূপণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন৷ রবীন্দ্রনাথের ‘অশীতি-বার্ষিকী’তে কবিকে ‘অশ্রুপুষ্পাঞ্জলি’ নিবেদন করতে গিয়ে তাই স্বয়ং নজরুল যা লিখেছেন, তা রবীন্দ্রভাষ্যে তাঁরই চিত্র ও চারিত্র হয়ে উঠেছে:

দেখেছিল যারা শুধু মোর উগ্ররূপ,
অশান্ত রোদন সেথা দেখেছিলে তুমি!
হে সুন্দর, বহ্নি-দগ্ধ মোর বুকে তাই
দিয়েছিলে ‘বসন্তে’র পুষ্পিত মালিকা৷
একা তুমি জানিতে হে মহাঋষি,
তোমারই বিচ্যুত-ছটা আমি ধূমকেতু!
আগুনের ফুলকি হল ফাগুনের ফুল,
অগ্নি-বীণা হল ব্রজ-কিশোরের বেণু৷