• বৃহস্পতিবার , ৭ নভেম্বর ২০২৪

‘ডিভোর্স’-সন্তান পালনের কঠিন দায়িত্বটা….


প্রকাশিত: ৪:৩৬ পিএম, ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৫ , বৃহস্পতিবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৯০ বার

deovorse pic-www.jatirkhantha.com.bdআসমা খন্দকার.ঢাকা:
অনেক স্বপ্ন এবং আশা নিয়ে যে সম্পর্কের শুরু নানা কারণে সেই সম্পর্কের সুর বদলায়, ভাঙন ধরে। মা-বাবার সম্পর্কের টানাপড়েনে সবচেয়ে বেশি আঘাত লাগে কোমল শিশুমনে! নতুন জীবনে মানিয়ে নিতে সন্তানের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে আপনাকেই।

যখন ‘ডিভোর্স’ কিংবা সঙ্গীর মৃত্যুর কারণে সন্তান পালনের কঠিন দায়িত্বটা বাবা-মায়ের মধ্যে যেকোনো একজনের কাঁধে এসে পড়ে। শিশু জন্মায় অমিত সম্ভাবনা নিয়ে। আর তা স্বাভাবিকভাবে ধীরে ধীরে বিকশিত হয় মা-বাবার নিবিড় আশ্রয়ে, দুজনের শর্তহীন ভালোবাসার নিরাপদ ছায়ায়। মা-বাবার মধ্যে যখন একজন অনুপস্থিত থাকেন, তখন সেটা সন্তান আর তার অভিভাবক দুজনের জন্যই একটা বড় চ্যালেঞ্জ।

বাচ্চার সামনে সিনক্রিয়েট করবেন না। কথা কাটাকাটির সময়ই কটূক্তি বা একে অপরকে অনর্থক দোষারোপ করলে সন্তানের কাছে নিচু হয়ে যাবেন। বিচ্ছেদের জন্য তাহলে ও আপনাকেই দোষী সাব্যস্ত করবে। ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় সন্তানের সঙ্গে একান্তে আলোচনায় বসুন। সহজ ভাষায় কাউকে দোষ না দিয়ে আপনাদের মতানৈক্য এবং আলাদা থাকার সিদ্ধান্তের কথা ওকে জানান। সঙ্গে সঙ্গে এও জানাতে ভুলবেন না যে, আপনাদের সম্পর্কে চিড় ধরলেও ওর প্রতি ভালোবাসায় কোনো ঘাটতি নেই। বাবা-মায়ের সঙ্গে ছেলেমেয়ের যে কখনো ডিভোর্স হতে পারে না, সেটা ওর মনে গেঁথে দিন।

কাউকে যখন একক অভিভাবকত্বের দায়িত্ব নিতে হয়, তখন তাঁকে বোঝাপড়া করতে হয় দুটি ব্যাপারে। এক. সন্তানের বড় হওয়ার পুরো ও দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়ার দায়িত্ব এককভাবে নেওয়া। দুই. সামাজিক, অর্থনৈতিক, ব্যক্তিগত জীবনের বিভিন্ন চাহিদা সঙ্গীর সাহায্য ছাড়া একা পূরণ করার মানসিক চাপ এবং নিঃসঙ্গ জীবনের মানসিক ক্লান্তি।

এখানে আমাদের আলোচনার বিষয়টি মূলত প্রথম চ্যালেঞ্জটি নিয়েই। এ ক্ষেত্রে সন্তানের খাওয়া, পড়া, শিক্ষা ইত্যাদিকেই বোঝাচ্ছে এমন নয়। বরং মা-বাবার কোনো একজন না থাকায় তার মধ্যে যে শূন্যতা তৈরি হতে পারে, সেটাও বোঝানো হচ্ছে। বাবা বা মা যে-ই হোন না কেন, একক অভিভাবক বা সিঙ্গেল প্যারেন্টের ভূমিকায় যখন আসতে হয়, তখন তাঁকে হতে হয় আত্মবিশ্বাসী, সংবেদনশীল এবং মানসিকভাবে অনেক শক্তিশালী। তাঁর সংবেদনশীলতা সন্তানের শূন্যতা, ভালোবাসার চাহিদা বা কষ্ট বুঝতে সাহায্য করবে। তাঁর আত্মবিশ্বাস ও মানসিক শক্তি সন্তানের শূন্যতা মোকাবিলা এবং চারপাশের সঙ্গে নিজেকে সহজভাবে মানিয়ে নিতে সাহায্য করবে।
এ ক্ষেত্রে সন্তান লালন-পালনে একক অভিভাবকত্বে কিছু সমস্যাও দেখা যায়। সেগুলো হলো-

 আবেগনির্ভরতা–
একধরনের নিরাপত্তাহীনতার কারণেই হয়তো সন্তানের প্রতি অতিরিক্ত আবেগনির্ভরতা তৈরি হয়। ফলে সন্তান ও অভিভাবক পরস্পরের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে সন্তানকে অতিরিক্ত আগলে রাখার প্রবণতা দেখা যায়। সার্বক্ষণিক চোখে চোখে রাখা, ব্যক্তিগত প্রতিটা কাজ করে দেওয়া, সব সময় বাচ্চার সঙ্গে সঙ্গে থাকা ইত্যাদি। সাধারণত এ ধরনের আচরণ সন্তানকে স্বাধীনভাবে ও আত্মবিশ্বাসী হিসেবে বেড়ে উঠতে বাধা দেয়। এ কারণে বড় হওয়ার পর নানা রকম জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন জীবনসঙ্গী বা বন্ধুবান্ধবের প্রতি অতিমাত্রায় অধিকারবোধ, যেকোনো ব্যর্থতা সহজে মেনে না নেওয়ার প্রবণতা, অল্পতেই ভেঙে পড়া ইত্যাদি।

অতিরিক্ত শাসন–
একরকম উদ্বেগ ও মানসিক চাপ থেকেই কঠোর শাসন, তিরস্কারের ঘটনা। কঠিন নিয়মের বেড়াজাল, ভালোবাসা প্রকাশ না করা ইত্যাদিও অনেক অভিভাবকের মধ্যে দেখা যায়।
সন্তান যদি মা-বাবার কোনো একজনের অনুপস্থিতি সহজভাবে মেনে না নিতে পারে, তখন যেসব সমস্যা হতে পারে-
 বিষণ্নতা
 সহজে কোনো কিছুর সঙ্গে মানাতে না পারা
 বন্ধুদের সঙ্গে সহজে মিশতে না পারা
 অতিরিক্ত অন্তর্মুখিতা
 হীনম্মন্যতাবোধ ইত্যাদি।
সঠিকভাবে সন্তান পালন করলে একক অভিভাবকত্বেও সে বেড়ে উঠবে আর দশটা সাধারণ ছেলে বা মেয়ের মতো।

যত্নশীল হোন–
ডিভোর্স বা জীবনসঙ্গীর মৃত্যুর কারণে সাধারণত একক অভিভাবকত্বের দায়িত্ব নিতে হয়। তাই ‘একক অভিভাবকত্ব’ শব্দের মধ্যেই বিষণ্ন এক সুর রয়ে যায়। অনেকেই পুরো বিষয়টা ঠিকমতো মানিয়ে নিতে পারেন না এবং নিজেকে সবকিছু থেকে গুটিয়ে নেন বা
বিচ্ছিন্ন থাকেন।

মনে রাখা প্রয়োজন, মানসিকভাবে আপনার ভালো থাকার সঙ্গে সন্তানকে গুণগত সময় দেওয়া নিবিড়ভাবে যুক্ত। তাই নিজেকে ভালো রাখার চেষ্টা করুন, নিজের ভালোলাগার উপাদানগুলো মূল্যায়ন করুন।
 ব্যস্ততার মধ্যেও নিজের জন্য আলাদা সময় রাখুন।
 নিজস্ব সময়টা কাটান বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে। নিজের মতো করে ঘুরতে বের হোন, পছন্দের কাজ করুন।
 নিজের শরীর ও চেহারার প্রতি যত্নশীল হোন। নিয়মিত শরীরচর্চা আপনার শারীরিক ফিটনেসের সঙ্গে সঙ্গে মানসিকভাবেও ফিট রাখতে সাহায্য করবে।
 নিজের জন্য বের করা এই আলাদা সময় আপনাকে ভিন্ন এক মানসিক শক্তি জোগাবে, যা একক অভিভাবকত্বের মতো কঠিন অবস্থাও সহজ করে তুলতে পারে।

সন্তান পালন–
সন্তান বেড়ে ওঠার জন্য সাধারণত বাবার পুরুষ সত্তা ও মায়ের নারী সত্তার সমন্বিত প্রভাব প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে একধরনের পারিবারিক কাঠামোতে বেড়ে ওঠা ভালো। যেখানে অন্তত মামা, খালা, চাচা, নানি, দাদি-নারী ও পুরুষ উভয়েরই সাহচর্য পাওয়া যেতে পারে। তবে পরিবারের সব সদস্যের সহমর্মিতা লাগবে এ ব্যাপারে।

 ইতিবাচক ধারণা–
স্বামী বা স্ত্রী সম্পর্কে অতীত অভিজ্ঞতা যতই তিক্ত থাকুক না কেন, সন্তানকে অবশ্যই তার বাবা-মা সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা দিতে হবে। সন্তানের মূল উৎস যেহেতু তার বাবা-মা, তাই তাদের কারও সম্পর্কে কোনো খারাপ ধারণা সন্তানের মনে গভীর উদ্বেগ, হীনম্মন্যতা ও আস্থাহীনতা তৈরি করতে পারে।
বাবা-মায়ের ডিভোর্সের ক্ষেত্রে একটু পরিণত বয়সে ডিভোর্সের কারণ হালকা করে বলা যেতে পারে। তবে বিষয়টা এমনভাবে বলা উচিত, যাতে বাবা-মা সম্পর্কে বড় ধরনের কোনো খারাপ ধারণা গড়ে না ওঠে।

 সময় কাটানো–
আপনি সন্তানকে কতটুকু সময় দেবেন, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে সময়টা দিচ্ছেন। একসঙ্গে খেলা, গল্প করা, বন্ধুবান্ধব নিয়ে কথা বলা, বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, জীবনের প্রয়োজনীয় বিষয়ে তথ্য দেওয়া-এ সবই গুণগত সময়ের অংশ।

আবার বিয়ে করা
নিঃসঙ্গ জীবনের ক্লান্তি থেকে বেরোতে নতুন করে সঙ্গী নির্বাচন বা বিয়ে করার ভাবনা মাথায় আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে সন্তানের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা ও একধরনের সংকট তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। সম্ভাব্য সৎবাবা অথবা সৎমাকে নিয়ে; নতুন পরিবারে তার অবস্থান নিয়েও নানা আশংঙ্কা অমূলক নয়। তাই বিয়ের আগে সন্তানের সঙ্গে এ বিষয়ে স্পষ্ট আলোচনা করা, তাকে পুরো বিষয়টা জানানো এবং তার মনের যে কোনো আশঙ্কা ও সংকট দূর করার দায়িত্ব অপনারই। তবে জীবনের এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে হুট করে সিদ্ধান্ত নেওয়া বা তাড়াহুড়া না করাই ভালো। সন্তানদের এ বিষয়ে জানানোর পর সেটার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে তাকে যথেষ্ট সময় দেওয়া উচিত।
পারিবারিক ও সামাজিক সংবেদনশীলতা
কোনো কারণে সন্তান পালনের দয়িত্বটা একক অভিভাবকের ওপর বর্তালেও আমাদের আশপাশের মানুষেরও কিছু দায়িত্ব রয়েছে। চারপাশের মানুষের সংবেদনশীলতা, সমব্যথী আচরণ বিষয়টি সহজ করে তুলতে পারে। কটু মন্তব্য, অযাচিত কৌতূহল, সমালোচনা না করাই উচিত।
আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তোলা
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সন্তানকে নিজের দায়িত্ব নিতে উৎসাহ দিন। যেমন-নিজ হাতে খাওয়া, নিজের ব্যাগ গোছানো ইত্যাদি। একটু বড় হলে ঘরের হালকা কিছু দায়িত্ব দিন এবং প্রশংসা করুন। শিশুকে বেশি বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে উৎসাহ দিন, প্রয়োজনে একা ছাড়ুন। এ সবকিছুই আপনার সন্তানকে আত্মবিশ্বাসী বা আত্মপ্রত্যয়ী হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। মনে রাখতে হবে, জীবনের দীর্ঘ পথ চলায় নানা চড়াই-উতড়াই একা পার হতে হয়। শৈশবে তৈরি হওয়া আত্মপ্রত্যয় ও আত্মবিশ্বাস সহজে এগুলো মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।