• শুক্রবার , ১৫ নভেম্বর ২০২৪

আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্য-কুপ্রবৃত্তি দমন, আত্মসংশোধন, আত্মসংযম-খোদাভীতি অর্জন


প্রকাশিত: ৫:১০ এএম, ২৫ অক্টোবর ১৪ , শনিবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৪৭৮ বার

 


romadan-minar

 

মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান :

মানুষের মনে সুপ্রবৃত্তি বা মানবিক গুণাবলি এবং কুপ্রবৃত্তি বা পশুত্ব আছে। সুপ্রবৃত্তিগুলো মানুষের অন্তরে ইসলাম নির্দেশিত সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা, সাম্য-মৈত্রী, ঐক্য-ভ্রাতৃত্ব, প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা প্রভৃতি মহৎ কাজের প্রতি গভীর অনুরাগ এনে দেয়। আর মানুষের চরম শত্রু কুপ্রবৃত্তি বা কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য—এই ষড়রিপুগুলো মানবজীবনে অনৈক্য, হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, অন্যায়-অত্যাচার, পাপাচার-ব্যভিচার, নির্মমতা-নৃশংসতা, স্বার্থপরতা-পাশবিকতা, অশান্তি-বিশৃঙ্খলা প্রভৃতি অনৈসলামিক ও অমানবিক কার্যকলাপের উদ্ভব ঘটায়। মানুষের মনের ভেতরে আত্মশুদ্ধির উপায় ও উন্নততর জীবনাদর্শের অনুসারী হওয়ার জন্যই ইসলামের ন্যায়নীতি ও সামাজিক বিধিবিধান প্রবর্তন করে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘এরপর আমি তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করেছি দ্বীনের বিশেষ বিধানের (শরিয়তের) ওপর; সুতরাং তুমি তার অনুসরণ করো, অজ্ঞদের খেয়ালখুশি বা প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না।’ (সূরা আল-জাছিয়া, আয়াত: ১৮)

শরিয়তের দিকনির্দেশনা অনুসরণের মধ্য দিয়ে ধর্মপ্রাণ মানুষ আল্লাহর হুকুম পালন এবং তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জনের নিয়ামক শক্তি আয়ত্ত করতে পারেন। কুপ্রবৃত্তি ত্যাগের ফলেই ইমানদার ব্যক্তি রিপুর তাড়না ও জৈবিক কামনা-বাসনা থেকে দূরে থাকতে সক্ষম হন। তার পক্ষে যাবতীয় অন্যায় ও অসৎ কাজ যেমন: চুরি-ডাকাতি, সুদ-ঘুষ, দুর্নীতি, পরচর্চা-পরনিন্দা, মিথ্যাচার প্রভৃতি পরিহার করা মোটেই কঠিন ব্যাপার নয়। ত্যাগ সাধনার মাধ্যমে কুপ্রবৃত্তির ওপর বিবেকের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়, এর দ্বারা মানুষের পাশবিক শক্তি অবদমিত হয় এবং রুহানি শক্তি বৃদ্ধি পায়। এতে মনুষ্যত্ব জাগ্রত হয় ও অন্তর বিগলিত হয়।

মুমিন বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কুপ্রবৃত্তি দমন এবং যাবতীয় খারাপ কাজ পরিত্যাগ করে নিজেকে আল্লাহর কাছে বিলিয়ে দেওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালান। তখনই প্রতিটি সৎ কাজ ও আল্লাহর বিধিবিধান পালনে মানুষ খুঁজে পাবে প্রশান্তি। অসৎ কাজ ও পাপাচার মানুষকে মর্মপীড়া দেবে। ধর্মীয় অনুশাসন অমান্য করা তার জন্য হবে চরম কষ্টকর। মানুষের ভেতর মনুষ্যত্ব, মায়া-মমতা, প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা, ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যের মতো মানবিক গুণাবলি ও আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি দরদ জাগ্রত হতে হবে। ফলে একজন সচ্চরিত্রবান মানুষ অপরের হিত সাধন করেন, কারও ক্ষতি করেন না; বরং সবার মঙ্গল কামনা করেন এবং নিজের স্বার্থের ওপর অন্যের স্বার্থকে প্রাধান্য দেন। তাই নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘চরিত্রের বিচারে যে ব্যক্তি উত্তম, মুমিনদের মধ্যে সেই পূর্ণতম ইমানের অধিকারী।’ (আবু দাউদ)
যাবতীয় অপকর্ম পরিহারের ফলে ইমানদার ব্যক্তি স্বীয় আত্মাকে কলুষমুক্ত, পরিশুদ্ধ ও আত্মশুদ্ধির এক অপার সুযোগ লাভ করেন।

islamইসলামের বিধিবিধানের উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি আর মূল লক্ষ্য হলো কুপ্রবৃত্তি দমন, আত্মসংশোধন, আত্মসংযম ও খোদাভীতি অর্জন। যাতে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক স্নেহ-ভালোবাসা, মায়া-মমতা, সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, আন্তরিকতা-মহমর্মিতা, সমবেদনা-সহানুভূতি সর্বোপরি তাকওয়া সৃষ্টি হয়। ফলে আল্লাহ তাআলা মানুষের কুপ্রবৃত্তিকে দমন করেন। রিপুর তাড়না থেকে মানুষকে মুক্ত করে তার মনের ভেতর তাকওয়া-খোদাভীতি ও আল্লাহপ্রেম জাগ্রত করতে চান। রাসুলুল্লাহ (সা.) মানবজাতিকে কুপ্রবৃত্তি বর্জনের উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘তোমরা অন্যের দোষ অন্বেষণ করবে না, গুপ্তচরবৃত্তি করবে না, পরস্পর কলহ করবে না, হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করবে না, একে-অপরকে ঘৃণা করবে না, অন্যের ক্ষতি সাধনের কোনো কৌশল অবলম্বন করবে না, আর তোমরা আল্লাহর প্রকৃত বান্দা ও পরস্পর ভাই ভাই হয়ে যাও।’ (বুখারি ও মুসলিম)
যখন মানুষ খোদাভীতি অর্জন করেন, সৃষ্টিকর্তার শোকর আদায় করতে শেখেন এবং আল্লাহর বিধানের কদর বুঝতে পারেন; তখন সব কাজকর্মের মধ্য দিয়ে মানুষ মূলত আল্লাহর আদেশ-নিষেধগুলোকে মেনে চলার চেষ্টা করেন। একসময় এতে তিনি সফলকাম হন, তখন তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করেন। এভাবেই মুমিন বান্দা আল্লাহর সান্নিধ্যে এগিয়ে যান, আর এটাই হলো মানবজীবনের পরম লক্ষ্য এবং উন্নতি ও সাফল্য লাভের মূলমন্ত্র। আল্লাহর ওপর প্রগাঢ় বিশ্বাসে ইমানদার ব্যক্তির অন্তরে আল্লাহর প্রতি ঐকান্তিক ইমান জন্মে এবং খোদাপ্রেমে তাঁর অন্তর উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।
ইসলামের বিধানে প্রতিটি বিধিবদ্ধ ইবাদতই একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য হয়ে থাকে; যা পালনের মাধ্যমে মানবজাতি আল্লাহকে পাওয়ার জন্য ঐকান্তিক প্রচেষ্টা চালায়। মানুষ তার সব কামনা-বাসনা ও লোভ-লালসা পরিত্যাগ করে বিভিন্ন যাতনা ও কষ্ট সহ্য করে খোদাভীতি অর্জনে ব্রতী হয়। তাই যদি কোনো ইমানদার লোক একাগ্রতার সঙ্গে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য নিজের কুপ্রবৃত্তি দমনপূর্বক ইবাদত করেন এবং ধৈর্যের সঙ্গে যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেন, তাহলে তিনি অবশ্যই সৌভাগ্যের অধিকারী হতে পারেন। ইমানদারদের পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা, সহৃদয়তা ও সহানুভূতির ফলে বিশ্বমানবতার ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব গড়ে ওঠে।
প্রকৃতপক্ষে ইসলামের পঞ্চস্তম্ভ কলেমা, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত প্রভৃতি মানুষের মনের গহিনের কুপ্রবৃত্তি দমন ও তাকওয়া বা খোদাভীতিপূর্ণ ইবাদতের মানসিকতা সৃষ্টিতে যথেষ্ট অনুপ্রেরণা জোগায়। প্রত্যেক ইমানদার ব্যক্তির মধ্যে যখন মানবিক গুণাবলি বিকশিত হবে, প্রত্যেক মানুষ যখন হবেন প্রকৃত মানুষ; তখন সমাজে থাকবে না হিংসা-বিদ্বেষ, মারামারি-হানাহানি, সন্ত্রাস-দুর্নীতি, অরাজকতা, সাম্প্রদায়িকতা ও মানুষে মানুষে ভেদাভেদ। চূর্ণ-বিচূর্ণ হবে মানুষের অহমিকা ও আমিত্ববোধ। সৃষ্টি হবে মানুষে মানুষে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। এই অশান্ত পৃথিবীর বুকে বয়ে চলবে শান্তির সুশীতল সমীরণ!
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com