• শনিবার , ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪

খুন গুমের মামলা আইসিসি ধরবে হাসিনাকে


প্রকাশিত: ৩:৩৭ এএম, ২৯ নভেম্বর ২৪ , শুক্রবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ২০ বার

 

শফিক রহমান : বিগত ১৬ বছর খুন গুমের মামলা দিয়ে ফ্যাসিবাদ কায়েম করা শেখ হাসিনাকে আইসিসির মাধ্যমে ধরবে সরকার। সে পরিকল্পনা নিয়েই এগুচ্ছে অন্তবর্তী সরকার। এলক্ষ্যে খুন গুমের মামলার সার্বিক প্রেক্ষাপট এগিয়ে নিতে দ্রুততার সঙ্গে কাজ করছে সরকার। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিসি) চিফ প্রসিকিউটর করিম এ খানকে বিষয়টি আনুষ্টানিকভাবে জানানো হয়েছে এবং এ লক্ষ্যে আইসিসির সার্বিক কার্যকরী হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূস।

ইতিহাস থেকে দেখা গেছে, ১৯৪৮ সালের আইন অনুযায়ী জুলাই-আগস্টের ম্যাসাকারকে ‘জেনোসাইড’ বলা সম্ভব না হলেও ‘মাস কিলিং’ অর্থে বাংলায় গণহত্যা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এ হত্যাযজ্ঞে সারা দেশে ১ হাজার ৫৮১ জন প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বাস্থ্যবিষয়ক উপকমিটি। ফেসিস্টরা এ হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করেছে বহুদিন ধরে। হাসিনার দেড় দশক ধরে চলমান একটি সিস্টেমেটিক কিলিং মিশনের চূড়ান্ত ধাপ ছিল জুলাই-আগস্টের গণহত্যা।

এটিকে ওয়াশিংটনভিত্তিক গণহত্যাবিষয়ক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ‘জেনোসাইড ওয়াচ’-এর প্রতিষ্ঠাতা ডক্টর গ্রেগরি স্ট্যানটন বিভিন্ন অঞ্চলে সংঘটিত জেনোসাইডগুলো পর্যালোচনা করে দেখিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যেকোনো গণহত্যা ১০টি ধাপে সম্পন্ন হয়। ১০টি ধাপ হচ্ছে—১. পৃথকীকরণ (ক্ল্যাসিফিকেশন) ২. প্রতীকীকরণ (সিম্বোলাইজেশন) ৩. বৈষম্য (ডিসক্রিমিনেশন) ৪. অমানবিকীকরণ (ডিহিউম্যানাইজেশন) ৫. সংগঠন (অর্গানাইজেশন) ৬. মেরুকরণ (পোলারাইজেশন) ৭. প্রস্তুতি (প্রিপারেশন) ৮. নিপীড়ন (পারসিকিউশন) ৯. নির্মূল (এক্সটারমিনেশন) ও ১০. অস্বীকার (ডিনায়াল)। এ ১০টি ধাপ ক্রমান্বয়ে না ঘটলেও ফেসিস্ট হাসিনা সরকার এর সব কটি দিক গত ১৫ বছরে প্রয়োগ করে সর্বস্তরের মানুষের নাভিশ্বাস তুলে দেশবাসীকে অতিষ্ট করে তুলেছিলেন। যার প্রেক্ষাপেটে ঘটেছিল ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট এর গণঅভ্যুত্থান। ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল ভারতে।

বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহ থেকে শুরু করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শহীদ আবু সাঈদ, ওয়াসিম আকরামদের হত্যাকাণ্ডের কথাও অস্বীকার করেছে। সরকার ও তাদের বশংবদ সাংবাদিক, শিক্ষকসহ অনেকে আয়নাঘরের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছে, গুম-ক্রসফায়ারে হত্যাকাণ্ডগুলো অস্বীকার করেছে, ভোট ডাকাতি অস্বীকার করেছে। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পরও বিভিন্ন সরকারি বাহিনী তাদের অপরাধের দায় অস্বীকার করেছে। এমনকি আন্দোলনের সময় হেলিকপ্টার থেকে গুলি করার দায়ে অভিযুক্ত র‍্যাবের পক্ষ থেকে সম্প্রতি দাবি করা হয়েছে, তারাও ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পক্ষে ছিল। অতীতে তারা গুম, খুন, ক্রসফায়ার ও হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

এসব প্রেক্ষাপটেই বিগত ১৬ বছরে হাজার হাজার গুম ও জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলনে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য পতিত সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা দিবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বুধবার (২৭ নভেম্বর) ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিসি) চিফ প্রসিকিউটর করিম এ খান সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে এলে প্রধান উপদেষ্টা এ কথা বলেন।

ড. ইউনূস বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আইসিসিতে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনবে, যা তার প্রায় ১৬ বছরের দীর্ঘ শাসনকালে জুলাই-আগস্ট গণ-আন্দোলনের সময়ের হত্যাকাণ্ড এবং হাজার হাজার গুমের ঘটনা অন্তর্ভুক্ত। আইসিসি চিফ প্রসিকিউটর জানান, তারা বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে সহযোগিতা করতে চান। এই আদালত শেখ হাসিনা এবং তার রাজনৈতিক দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে।

এ সময় তারা রোহিঙ্গা সংকট, মিয়ানমার পরিস্থিতি, রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা এবং জুলাই-আগস্ট গণ-আন্দোলনের সময় নৃশংসতার বিচার ও জবাবদিহিতা নিয়ে আলোচনা করেন।করিম এ খান প্রধান উপদেষ্টাকে জানান, মিয়ানমার সামরিক সরকারের প্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের বিরুদ্ধে আইসিসি অফিস রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেছে।

করিম খান রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার একটি বিশেষ আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনের আহ্বানকে সমর্থন করেন। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ২০২৫ সালে এই সম্মেলন আয়োজনের সম্মতি দিয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, সম্মেলন থেকে সংকট সমাধানের একটি নতুন টেকসই দিকনির্দেশনা পাওয়া যাবে। সম্মেলনের স্থান ও তারিখসহ সামগ্রিক বিষয় নিয়ে ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এই সম্মেলন আন্তর্জাতিক সব অংশীদারকে একত্রে নিয়ে এসে সংকটের একটি স্থায়ী সমাধানের পথ বের করতে সাহায্য করবে, বিশেষ করে বাংলাদেশে শরণার্থী শিবিরে বসবাসরত রোহিঙ্গা এবং তাদের শিশুদের দুরবস্থার বিষয়ে।অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস আরও বলেন, আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে এই সংকট বিস্ফোরিত না হয়। শিবিরে বেড়ে ওঠা হতাশাগ্রস্ত যুবকদের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন, সম্প্রতি বাংলাদেশে আরও কয়েক হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর ঢল এবং মিয়ানমারের সর্বশেষ পরিস্থিতি বাংলাদেশে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।

প্রধান উপদেষ্টা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে একটি সুরক্ষিত অঞ্চল প্রতিষ্ঠার জন্য তার সাম্প্রতিক আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, এই সুরক্ষিত অঞ্চল বাস্তুচ্যুত মানুষকে সহায়তা এবং চলমান মানবিক সংকট মোকাবিলায় কার্যকর হবে।তিনি আরও বলেন, ‘এই অঞ্চলের নিরাপত্তা জাতিসংঘ দ্বারা নিশ্চিত করা উচিত। যখন লড়াই বন্ধ হবে, এই সুরক্ষিত অঞ্চলে থাকা মানুষ সহজেই তাদের নিজ নিজ স্থানে ফিরে যেতে পারবে।

প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা বিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমান, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রিয়াজ হামিদুল্লাহ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।এর আগে, রোহিঙ্গা বিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমান প্রসিকিউটর করিম এ খান এবং তার আইসিসি প্রতিনিধিদলের সদস্যদের জন্য মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করেন।খলিলুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ আইসিসি প্রতিষ্ঠার জন্য রোম সংবিধি স্বাক্ষরকারী প্রথম এশীয় দেশগুলোর মধ্যে একটি এবং আমরা আগামী দিনগুলোতে আমাদের সহযোগিতা আরও গভীরভাবে করার অপেক্ষায় আছি।