এমাজউদ্দিনের ফর্মুলায় চাঙ্গা বিএনপি নেক্সট রাষ্ট্রপতির চেয়ার আগেভাগে বুক!
এস এম রহমান.ঢাকা: সাবেক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদের ফর্মুলায় এবার চাঙ্গা বিএনপি জোট। জোটের নেতারা মনে করছেন এমাজউদ্দিন আহমেদের ফমুলা সফল হলে তিনি বড় ধরনের পুরস্কৃত হবেন বিএনপি চেয়ারপার্সনের কাছ থেকে। আর এই পুরস্কারটা হচ্ছে নেক্সট রাষ্ট্রপতির চেয়ার!অনেকের মনে করেন বিএনপির কপাল খুললে এমাজ উদ্দিনেরর কপাল খুলবে।
সূত্র জানায়, আসন্ন তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিগত তিন মাসের ‘গুলশানকেন্দ্রিক’ আন্দোলন থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে সংসদের বাইরে থাকা প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। দলের শীর্ষনেতারা কারাবন্দি ও আত্মগোপনে থাকায় দীর্ঘদিন ধরে দলটি চালিয়ে আসছিল কেবল ঝটিকা কর্মসূচি-নির্ভর আন্দোলন। কিন্তু এবার বিএনপির রাজনৈতিক কৌশলে পরিবর্তন আসছে।
এই লক্ষ্যেই প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালানোর প্রাথমিক-প্রস্তুতিও ইতোমধ্যে জোরালো হয়েছে দলটিতে। এ প্রস্তুতির পেছনে প্রধানত ফর্মুলা দিয়ে কাজ করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ। তার সঙ্গে রয়েছে বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ। তাদের পরামর্শ হচ্ছে, যেকোনও উপায়ে নেতাকর্মীদের জেল-রিমান্ডমুক্ত করে স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক চর্চার দিকে ফিরিয়ে আনা। অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদসহ এ ফর্মুলার সঙ্গে সম্পৃক্ত বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। একইসঙ্গে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের দায়িত্বশীল সূত্রও বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
সূত্র জানায়, এমাজউদ্দীন আহমদ প্রণীত ফর্মুলা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আসন্ন তিন সিটি নির্বাচনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সম্ভাব্য দল-সমর্থিত প্রার্থীদের বিজয়ী করার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো হবে। এতে দলের নেতাকর্মীদের মনোবল বাড়বে। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্র“তি অনুযায়ী সাংবিধানিক নিয়মরক্ষা করতে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে চালিয়ে যাওয়া হবে নতুন গণতান্ত্রিক সংগ্রাম। অন্যথায়, রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির টিকে থাকা নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ ।
সূত্র মতে, ঢাকার দুই সিটি ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের বিষয়টিকে শুরু থেকে ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করেন অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদসহ বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীরা। গত ৫ জানুয়ারি থেকে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে
লাগাতার অবরোধ-হরতালকে তারা জন-নিপীড়ক কর্মসূচি হিসেবে বিবেচনা করেছেন। এই বিবেচনাবোধ থেকে আসন্ন তিন সিটি নির্বাচনকে ‘এক্সিট পয়েন্ট’ হিসেবে বিবেচনা করছেন তারা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তাদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে অবগত করেন। ওই সময় গুলশানে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়ে গিয়ে দেখা করে সাংবাদিকদের কাছে তাদের অভিমত উপস্থাপন করেন। ওই সময় এমাজউদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের জানান, সিটি নির্বাচনের বিষয়ে খালেদা জিয়ার মনোভাবও ইতিবাচক। এরপরই পাল্টে যেতে থাকে পরিস্থিতি। দুই সিটি নির্বাচনেই দল-সমর্থিত প্রার্থী দেয় বিএনপি। এমাজউদ্দীনসহ নিজেদের দাবি-দাওয়া অনুরোধ আকারে নিয়ে যান নির্বাচন কমিশনের কাছে। ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল ফের ইসিতে গিয়ে দলীয় দাবি জানিয়ে আসে।
এমাজউদ্দীনের ফর্মুলা :
সূত্র জানায়, জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে বিগত তিন মাসের আন্দোলন, খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে অবস্থান, সারাদেশে দেড় শতাধিকশ মানুষ নিহত এবং কয়েক হাজার আহত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত-আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। সরকারের নানা কৌশল ও চাপে অনেকটাই বিপর্যস্ত বিএনপির আগামী দিনের রাজনীতি। এসব কারণে নতুন করে ভাবতে, দলকে নতুন উদ্যোমে চাঙ্গা করতে অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমেদ এগিয়ে এসেছেন বলে জানা গেছে বিএনপি নির্ধারণী পর্যায়ের কয়েকজন নেতা ও দল-সমর্থিত কয়েকটি সূত্রে।
১. অধ্যাপক এমাজউদ্দীনের মতে, বিএনপি আগে দল হিসেবে বাঁচুক। এজন্য সবার আগে দলের গ্রেফতারকৃত নেতাকর্মীদের মুক্ত করতে হবে। এ ব্যাপারে এমাজউদ্দীন বলেন, ‘শত শত নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকে বয়সের ভারে ন্যুব্জ। অসুস্থ হয়ে পড়েছেন অনেকে। বৃদ্ধ বয়সে এসে জেল-হাজত-রিমান্ড এসব ধকল সইতে না পেরে অনেকের প্রাণহানির আশঙ্কা আছে।’ তিনি মনে করেন, ‘অনেক ছেলে-পেলে অযতেœ মরে গেছে, আরও মরবে।’ তিনি বলেন, ‘পরিবেশটা অন্তত শান্ত হয়েছে। মানুষের দুশ্চিন্তা কেটেছে। এটাকে ফলপ্রসূ করতে হবে।’
২. সিটি নির্বাচনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ তিন সিটির বিজয় দলকে পাল্টে দিতে পারে বলে মনে করেন এমাজউদ্দীন। এ কারণে নির্বাচনকেন্দ্রিক সমস্যা নিয়ে, লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে আরও একাধিকবার নির্বাচন কমিশনে বিএনপির প্রতিনিধি দলকে যেতে হবে। পাশাপাশি বিএনপি এবং ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের সামনে সংঘবদ্ধতার সময় এসেছে বলেও জানান এমাজউদ্দীন। আগামী দিনের আন্দোলনের অংশ হিসেবে সিটি নির্বাচনকে দেখার আহ্বান তার। তার মতে, এতে জনসংযোগও বাড়বে। তিনি বলেন, ‘সমস্যা তো আছে। সরকার তো স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দেবে না। চাপ দিতে হবে। চাপের জন্য বিএনপি থেকে আবারও যেতে হবে ইসিতে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখনও সরকারের অবস্থা বোঝার সময় আসেনি।’
৩. বিগত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্র“তিকে সামনে রাখতে হবে। এমাজউদ্দীনের মতে, ‘প্রধানমন্ত্রীর চারপাশের সাঙ্গ-পাঙ্গরা তাকে ভিন্নভাবে বোঝালেও প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যের বিষয়ে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্র“তি তো রয়েছে। তিনি তো বলেছেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সাংবিধানিক নিয়মরক্ষার নির্বাচন। একে মাথায় রেখেই কাজ করতে হবে। এমাজউদ্দীন আরও বলেন, ‘যদিও পরবর্তী সময়ে তার আশেপাশের সাঙ্গ-পাঙ্গরা নির্বাচন বিষয়ে বিভিন্ন কথাবার্তা বলছে, উচ্চবাচ্য করছে। কিন্তু দুটি জোটকে পাশাপাশি হাঁটতে হলে এসব বিষয় মনে রাখলে চলবে না।’
‘পরামর্শে সাড়া না দিলে দলটাই থাকে না’:
অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ জানান, দেখো, এসব পরামর্শে সাড়া না দিলে বিএনপি দলটাই থাকে না। সাড়া দিতে হবে। না হলে অসুস্থ হয়ে মরবে নেতারা। তিনি বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে আন্ডারস্ট্যান্ডিং রাখতে হবে। দু’পক্ষকেই ছাড় দিতে হবে। তা না হলে দেশের ভাগ্য খারাপ।’ কিন্তু এসব বিষয় খালেদা জিয়া কীভাবে দেখেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, ‘উনার সঙ্গে তো দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। আমাদের পরামর্শগুলোকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন।’
গুলশানে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়সূত্রে জানা গেছে, অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বিএনপির পরীক্ষিত বন্ধু। ব্যক্তিগতভাবে খালেদা জিয়াও তাকে সম্মান ও গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
সূত্রের দাবি, গত কয়েক বছরে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ফরহাদ মজহার, শফিক রেহমানসহ কয়েকজন পেশাজীবী বিএনপির কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করেছেন। দলের জন্য নিজেদের ফর্মুলাও দিয়েছেন। তবে এক্ষেত্রে এমাজউদ্দীন আহমদ ব্যতিক্রম।
কারণ হিসেবে সূত্রের যুক্তি, বিগত তিন মাসে অবরোধকালীন খালেদা জিয়ার পাশে তো তাদের দেখা যায়নি। অধ্যাপক এমাজউদ্দীন বয়োবৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও সশরীরে কাজ করছেন। বুদ্ধিজীবীদের সংঘবদ্ধ করার চেষ্টা করছেন।
সূত্র জানায়, বিএনপির হয়ে কাজ করতে গিয়ে এমাজউদ্দীন বৃদ্ধ বয়সে এসে মামলার মুখোমুখি হয়েছেন। যে সময়টাতে বিএনপির ঢাকা মহানগরের শীর্ষনেতারা পলাতক হয়ে বেড়াচ্ছেন, সেখানে মামলার আসামি হয়েও দৌড়ঝাঁপ করছেন নিয়মিত।
এ বিষয়ে খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাস কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে বিএনপির মহানগরের এক দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, উনি তো রাষ্ট্রপতি হতে শেষ বয়সে দৌড়াচ্ছেন।
অধ্যাপক এমাজউদ্দীন ‘রাষ্ট্রপতির হওয়ার আশা-আকাক্সক্ষাকে বাজে কথা’- বলে উড়িয়ে দেন। তিনি বলেন, ‘বয়স তো শেষ। আর কত। এগুলো মাথায় রেখেই কাজ করি। আমার তো রাষ্ট্রপতি হওয়ার বয়স নেই। তাছাড়া আমি এসবে মুগ্ধ নই। শেষ বয়সে এসে দেশের ক্রান্তিলগ্নে কিছু করতে চাই। সমালোচকরা এসব বলছে। আমি তো আমার শেষ আত্মজীবনী গ্রন্থটি লেখার চেষ্টা করছি।’
বিএনপির নেতারা যা বললেন:
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সারোয়ারী রহমান বলেন, ‘বুদ্ধিজীবীরা ইন্টারেস্ট দিচ্ছেন, এটা তো ভালো। তারা দেশের এই পরিস্থিতিতে এগিয়ে এসেছেন। ইসিতে যাচ্ছেন। এটা অবশ্যই ভালো দিক। মতামত দিচ্ছেন। কথা বলছেন, এটা শুভদিক। সবাই চায়, দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে আসুক।’
ভাইস-চেয়ারম্যান হারুন আল রশিদ বলেন, ‘ভালো না মন্দ, এটা দেখতে আরও কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হবে। আওয়ামী লীগ তো খুব কৌশলী দল। ফলে, কার ভূমিকা কী, তা আরও খতিয়ে দেখতে হবে।’
অধ্যাপক এমাজউদ্দীনের পরামর্শ এবং তিন সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তার কর্মকা-কে স্বাগত জানিয়েছে বিএনপি ও ২০ দলীয় জোট। তিনি বলেন, দেশের এই রাজনৈতিক মহাসংকটকালে অধ্যাপক এমাজউদ্দীনের মতো শ্রদ্ধাভাজন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এগিয়ে এসেছেন, এটা আমাদের জন্য, জাতীয়তাবাদী শক্তির জন্য সৌভাগ্য।
আহমদ আযম খান মনে করেন, ‘প্রফেসর এমাজউদ্দীন সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। যখন বিএনপি ও জোটের নেতাকর্মীরা গৃহহারা, অন্তরীণ, আত্মগোপনে রয়েছেন; তখন তিনি সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন, এটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক।’ তিনি বলেন, ‘রাজনীতিতে একই পরিস্থিতি সবসময় থাকে না। আমাদের প্রায় ৭০ হাজারের মতো নেতাকর্মী গ্রেফতার। ৫০ লাখ মানুষ হামলা-মামলায় জর্জরিত। এখন তিনি সিটি নির্বাচনের হাল ধরেছেন। কাজ করছেন। এটি বিরাট। তার এই মুহূর্তের ভূমিকা যথাযথ।’