৪২০ তানভীর-বিনাভোটে শতকোটিপতি
লাবণ্য চৌধুরী সরেজমিনে উল্লাপাড়া থেকে : এলাকায় পরিচিত তিনি বিনা ভোটের এমপি ৪২০ তানভীর! তিনি বিনাভোটেই শত কোটিপতি বনেছে। এই সেই তানভীর যিনি আওয়ামী লীগ মনোনীত সিরাজগঞ্জ-৪ (উল্লাপাড়া) আসনের সাবেক এমপি ও প্রয়াত এইচ টি ইমামের ছেলে তানভীর ইমাম। বিনা ভোটের এই এমপি হয়ে উঠেছিলেন উল্লাপাড়ার মহা- নিয়ন্ত্রক। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, সরকারি অফিসের দরপত্র, চাঁদাবাজি ও মনোনয়ন বাণিজ্যসহ সবকিছুতেই তার একক নিয়ন্ত্রণ। স্থানীয়রা বলছেন, উপজেলা থেকে ওয়ার্ড পর্যন্ত নিজের ‘রাজত্ব’ ঠিক রাখতে টাকার বিনিময়ে পদে বসাতেন তিনি। এইচ টি ইমামের এই কু’পুত্রকে অপকর্মের বরপুত্রসহ বলছেন ৪২০ তানভীর।
সদ্যবিদায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন এইচ টি ইমাম। আর এ কারণেই ভাগ্য খুলেছিল ছেলে তানভীর ইমামের। এইচ টি ইমামের আশীর্বাদে রাজনীতি না করেই ২০১৪ সালে বিনাভোটে হন সংসদ সদস্য। এরপর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও হন তিনি। কিন্তু দলীয় কোন্দলের জেরে কেন্দ্রের নির্দেশে দেড় মাসের মাথায় সেটি বাতিল করা হয়।
পরবর্তীতে উপজেলা কমিটির সম্মেলনে সভাপতি পদে ফয়সাল কাদির ও সাধারণ সম্পাদক পদে গোলাম মোস্তফা নির্বাচিত হন। অবশ্য এরা দুজনই ছিলেন তানভীর ইমামের ঘনিষ্ঠ। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের রাতের ভোটেও দ্বিতীয়বারের মতো এমপি হন তিনি। তবে সর্বশেষ ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হন।
উপজেলায় সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, বিরোধী দলের মতো নিজ দলের নেতাকর্মীরাও তানভীর ইমামের কাছে জিম্মি ছিলেন। কিন্তু সরকার পতনের পর তিনি ও তার অনুসারীরা আত্মগোপনে চলে গেছেন।বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থী শামীম রেজাকে মারধর ও সরকারি প্রকল্পের কাজ দেওয়ার নামে ৬০ লাখ টাকা আত্মসাতের ঘটনায় তার বিরুদ্ধে এরইমধ্যে দুটি মামলা হয়েছে। এছাড়া বিদেশে অর্থপাচার, সরকারি প্রকল্পে অনিয়মসহ দেশে-বিদেশে বিপুল অবৈধ সম্পদ গড়েছেন। এসব অভিযোগে তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সেই সঙ্গে তানভীর ইমাম ও তার স্ত্রী মাহিন ইমামের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত।
স্থানীয়রা দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে জানায়, তানভীর ইমামের যেকোনো নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে ব্যস্ত থাকতো স্থানীয় প্রশাসন। তিনি ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারির এক ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ওইদিন উপজেলার পূর্বদেলুয়া বাসস্ট্যান্ডে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের রায়ের প্রতিবাদে হরতাল ঢাকে জামায়াত-শিবির।
এতে নেতাকর্মীদের ওপর অতর্কিতভাবে গুলি চালায় পুলিশ৷ এ গুলিতে স্থানীয় ফলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী শিবিরকর্মী মাহফুজুর রহমান গুলিবিদ্ধ হয়। পুলিশ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে থানায় নিয়ে যায়। এমপির নির্দেশে পুলিশ থানার ভেতর তার ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালায়। এতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ওই শিবিরকর্মীর মৃত্যু হয়।
শুধু তাই নয়, এমপির নির্দেশে ২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি উপজেলার সদর ইউনিয়নের জামায়াত সেক্রেটারি সাইদুর রহমানকে আটক করে পুলিশ। এ আটকের পর পুলিশ তার পায়ে গুলি করে। এতে প্রচুর রক্ত ক্ষরণ হলে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে পুলিশ স্থানীয় কাওয়াক হাসপাতালে নেয়। কিন্তু হাসপাতালে নেওয়ার বিষয়টি তানভীর ইমাম জানার পর পুলিশকে ফোন করে এ জামায়াত নেতার চিকিৎসা করতে নিষেধ করেন। এতে সাইদুর রহমানেরও রক্তক্ষরণের কারণে মৃত্যু হয়।
তানভীর ইমামের নির্দেশে বিগত সময়ে আমাদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মিথ্যা মামলা হয়েছে। আমাদের নেতাকর্মীরা নিজ বাড়িতে ঘুমাতে পারেনি। মসজিদে নামাজ পড়ার সময়ও তার লোকজন আমাদের পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছে। জেলে থাকা অবস্থায় অনেক নেতাকর্মীর মা-বাবা মারা গেছেন। প্যারোলে মুক্তি পেলেও জানাজায় অংশ নিতে দেয়নি তার অনুসারীরা। -উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব আজাদ হোসেন
উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব আজাদ হোসেন অভিযোগ করে বলেন, তানভীর ইমামের নির্দেশে বিগত সময়ে আমাদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মিথ্যা মামলা হয়েছে। আমাদের নেতাকর্মীরা নিজ বাড়িতে ঘুমাতে পারেনি। মসজিদে নামাজ পড়ার সময়ও তার লোকজন আমাদের পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছে। জেলে থাকা অবস্থায় অনেক নেতাকর্মীর মা-বাবা মারা গেছেন। প্যারোলে মুক্তি পেলেও জানাজায় অংশ নিতে দেয়নি তার অনুসারীরা।
উপজেলা জামায়াতের আমির ও সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক শাহজাহান আলী বলেন, আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে ক্ষমতা নিয়েই জামায়াত-শিবির দমন শুরু করে। স্বৈরাচার শেখ হাসিনার আমলে কয়েক দফায় সাড়ে তিন বছর আমাকে কারাগারে থাকতে হয়েছে। কথিত গোপন বৈঠক ও নাশকতা পরিকল্পনার নামে তারা সম্পূর্ণ মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাদের নেতাকর্মীদের হয়রানি করেছে। এমনকি কারাগারে থাকা অবস্থাতেও আমার নামে মামলা দিয়েছে।
আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে ক্ষমতা নিয়েই জামায়াত-শিবির দমন শুরু করে। স্বৈরাচার শেখ হাসিনার আমলে কয়েক দফায় সাড়ে তিন বছর আমাকে কারাগারে থাকতে হয়েছে। কথিত গোপন বৈঠক ও নাশকতা পরিকল্পনা নামে সম্পূর্ণ মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাদের নেতাকর্মীদের হয়রানি করেছে তারা। এমনকি কারাগারে থাকা অবস্থাতেও আমার নামে মামলা দিয়েছে বলেন -জামায়াত নেতা অধ্যাপক শাহজাহান আলী।
তিনি বলেন, ওরা শুধু জামায়াত-শিবির ও বিএনপির নেতাকর্মীদের তারা এমন নির্যাতন করেই ক্ষান্ত হয়নি। এলাকার সাধারণ মানুষও কাহিল ছিল তাদের অত্যাচারী শাসনে। চাঁদাবাজি, দুর্নীতি-অনিয়ম, টেন্ডারবাজি ও মাস্তানিতে ভরে গিয়েছিল পুরো উপজেলা। যেন মগের মুল্লুকে পরিণত হয়েছিল।
তিনি আরও বলেন, এমপির কড়া নির্দেশে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সকল নেতাকর্মীও হয়ে উঠেছিলেন বেপরোয়া। মতের বাইরে গেলেই বিএনপি-জামায়াত তকমা দিয়ে অজ্ঞাত আসামি হিসেবে পুলিশে ধরিয়ে দিতেন। বাড়িতে ছেলেকে না পেলে বাবাকে, বাবাকে না পেলে ছেলেকে ধরতো পুলিশ।