সেই ভয়ংকর নবী ধরা-
০০ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দিয়েছেন হাজার কোটি টাকা-
০০ রোহিঙ্গা রাষ্ট্র’র দাবিতে অরাজকতাকারী-
০০ ১৬ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার হয় সেই নবী-
লাবণ্য চৌধুরী : সেই ভয়ংকর নবী হোসেন ওরফে ইয়াবা মাফিয়া এখন লালঘরে-। এই সেই নবী যার রয়েছে বিশাল বাহিনী। যারা সরাসরি মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সেনাবাহিনীর নির্দেশে পরিচালিত। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী মিয়ানমারের সীমান্তে গড়ে ওঠা ২৮টি ইয়াবা কারখানা ও ভয়ংকর মাদক আইসসহ যাবতীয় চোরাচালান নবীর নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দিয়েছে। সেখান থেকে নবী মাসে অন্তত এক থেকে দুই হাজার কোটি অর্থাৎ বছরে ৬০ হাজার কোটি টাকা আয় করেন।এই অবৈধ টাকার ভাগ নিয়েছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর উর্দ্বতণ কর্মকর্তারা।
বহুল আলোচিত এই রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেনকে সম্প্রতি গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নবী হোসেন দীর্ঘদিন ধরে দেশের ভেতরে ও বাইরে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। গোয়েন্দা সংস্থার বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, তিনি ‘স্বাধীন রোহিঙ্গা রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্রসহ দেশের অভ্যন্তরে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির পরিকল্পনা করছিল।
নবীকে ধরতে ২০২২ সালে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে সরকার। গত ১৫ সেপ্টেম্বর নবী হোসেনকে কক্সবাজার আদালতে হাজির করা হয়।তখন নবী দাবি করেন, তাকে ছয় মাস আগেই গ্রেফতার করা হয়েছিল, তবে কোটি ডলার ও হাজার কোটি টাকা আদায়ের পর সম্প্রতি তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।
এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নবীকে গ্রেফতার দেখালেও রহস্যজনকভাবে তার বিস্তারিত তথ্য কাউকে জানানো হয়নি। বিগত সরকারের দুর্নীতিবাজ প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা নবীর কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও দেশের বিরুদ্ধে চলমান ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে দেখা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে।
অভিযোগ আছে, নবীকে দীর্ঘদিন নজরদারিতে রাখলেও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের হস্তক্ষেপের কারণে তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। তবে ছয় মাস আগে চট্টগ্রাম থেকে আটকের পরও সম্প্রতি তাকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে, যা প্রশাসনের অভ্যন্তরে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। নবীকে আটকে রেখে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ থেকে অন্তত ৫০ কোটি ডলার এবং দেশে হাজার কোটি টাকা আদায় করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তা এই অর্থ আদায় করেছেন বলে দাবি করা হচ্ছে।
বিশেষ সংস্থা সুত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের নেতৃত্বে অত্যাধুনিক অস্ত্রসজ্জিত একটি প্রশিক্ষিত বিশাল বাহিনী তৈরি করা হয়েছে, যার উদ্দেশ্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রোহিঙ্গা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা। নবীর সশস্ত্র শাখায় অন্তত ৭ থেকে ১০ হাজার সক্রিয় সদস্য রয়েছে বলে নানা সূত্রে জানা যায়। মাদক ও চোরাচালানের টাকায় প্রতি মাসে নবী বাহিনীর সশস্ত্র শাখার সদস্যদের ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন দেওয়া হয় বলে গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে। তথ্য বলছে, নবী পুরো মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও আমেরিকার কিছু দেশের রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন। নবী বাহিনীর কাছে বিপুল অত্যাধুনিক অস্ত্র ও গ্রেনেড, এমনকি রকেট লঞ্চার মজুত রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার জুমার নামাজের পর চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার পার্শ্ববর্তী জাহাজানপাড়া এলাকার একটি বাড়ি থেকে তাকে আটক করে র্যাবের একটি আভিযানিক টিম। এরপর ২৪ ফেব্রুয়ারি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলায় শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে র্যাবের তৎকালীন ডিজি এম খুরশীদ হোসেন নবীর নাম প্রকাশ না করে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মিয়ানমারের বড় মাদক ব্যবসায়ী আমাদের জালে।
যে কোনো সময় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ তার এ বক্তব্য দেশের প্রায় সব গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়। অভিযানের বিষয়টি জানার পর সংবাদ প্রকাশ করতে চাইলে বড় ধরনের অভিযানের কথা বলে প্রতিবেদকদের বাধা দেন প্রশাসনের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। কিন্তু ১ সেপ্টেম্বর রাত ১০টায় তাকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে গ্রেফতার দেখায় এপিবিএন পুলিশ। এরপর বিষয়টি নিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।
অভিযোগ আছে, দেশের জন্য হুমকি হলেও নবী হোসেন ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালের ‘টাকার মেশিন’। কামাল এবং প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তা নবীকে দীর্ঘদিন আটকে রেখে হাজার কোটি টাকা নিয়েছেন। এর আগে তাকে কয়েকবার আটক করেও ছেড়ে দিতে বাধ্য করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এক মন্ত্রীর এমন কর্মকাণ্ডে বিস্মিত হয় প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থাও।
এদিকে নবী হোসেনকে ১৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের হাটহাজারী থেকে গ্রেফতারের বিষয়টি স্বীকার করেছেন ওইদিন অভিযানের নেতৃত্বে থাকা র্যাবের একজন কর্মকর্তা (এএসপি)। তিনি এপিবিএন পুলিশ কর্তৃক ১ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে নবীকে গ্রেফতার দেখানোতে বিস্মিত হয়েছেন।
১৫ সেপ্টেম্বর (রোববার) নবী হোসেনকে কারাগার থেকে কক্সবাজার আদালতে তোলা হয়। এ সময় কোর্ট হাজতে তার সঙ্গে কথা হয়। ছয় মাস আটকে রেখে হাজার কোটি টাকা আদায় করার বিষয়টি স্বীকার করে নবী বলেন, মুখ বেঁধে ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়ে বিদেশে কোটি কোটি ডলার ও দেশে কয়েক দফায় হাজার কোটি টাকা দিতে বাধ্য করা হয়েছে। সাবেক মন্ত্রী কামাল ও প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা তার কাছ থেকে আগেও নিয়মিত টাকা ও ডলার নিয়েছেন বলে জানান তিনি।
কারাগার থেকে বের হলে এ বিষয়ে তিনি গণমাধ্যমকে বিস্তারিত জানাবেন বলেও উল্লেখ করেন। নবী আরও বলেন, আমার কাছে বিপুল পরিমাণ আধুনিক অস্ত্র মজুত রয়েছে সেটা সত্য। কিন্তু সেটা আমি আমার রোহিঙ্গাদের মুক্তির যুদ্ধে ব্যবহার করব। তবে বাংলাদেশের ভেতরে ‘স্বাধীন রোহিঙ্গা রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা চেষ্টার বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি। আদালতে আসা নবী গ্রুপের কয়েকজনও নবীর কাছ থেকে ডলার ও হাজার কোটি টাকা আদায়ের তথ্য জানান।
১৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের কারাগারের ইতিহাসে বড় ‘বন্দি’ নবীকে আদালতে আনা হয়েছে বিশেষ কোনো নিরাপত্তা ছাড়াই। এদিকে গ্রেফতার দেখালেও রহস্যজনক কারণে নবীকে নিয়ে কোনো সংবাদ সম্মেলনও করেনি প্রশাসন। ফলে নবী সম্পর্কে অনেকেই জানতে পারেনি। উখিয়া থানার ওসি শামীম হোসেন দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেন, থানায় হস্তান্তরের সময় সংশ্লিষ্টদের কেউ নবী হোসেন সম্পর্কে আমাকে বিস্তারিত অবগত করেননি। একই কথা বলেছেন, কক্সবাজার জেল সুপার মো. শাহ আলম।
২০২২ সালের ২৯ এপ্রিল নবীর রোহিঙ্গা রাষ্ট্র নিয়ে রিপোর্ট করে একাধিক পত্রিকা। এতে সরকার নড়েচড়ে বসে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এ বিষয়ে তথ্য এবং সহযোগিতা চেয়ে একাধিকবার যোগাযোগ করেছিল। তবে রহস্যজনকভাবে নবীর পক্ষ নেন সে সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
ওই সময় নবীর বিষয়ে বেশি বাড়াবাড়ি না করার কথা বলে হুমকি দেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং।তিনি এমনও বলেন যে, অনেকের মতো আপনিও গুম হয়ে যেতে পারেন, না হয় সাগরে লাশ ভেসে উঠতে পারে। ২০২২ সালের ২৬ মে সন্ধ্যায় কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে একটি পত্রিকার কক্সবাজার রিপোর্টারকে হুমকি দেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এর আগে তৎকালীন র্যাব-১৫ এর অধিনায়ক ও নানা অপরাধের দায়ে চাকরি হারানো লে. কর্নেল খাইরুল আলমও সরকার ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর রেফারেন্স দিয়ে হুমকি দিয়েছিল।
গোয়েন্দা তথ্য বলছে, নবী বাহিনী সরাসরি মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সেনাবাহিনীর নির্দেশে পরিচালিত হয়। এ কারণে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী মিয়ানমারের সীমান্তে গড়ে ওঠা ২৮টি ইয়াবা কারখানা ও ভয়ংকর মাদক আইসসহ যাবতীয় চোরাচালান নবীর নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দিয়েছে। সেখান থেকে নবী মাসে অন্তত এক থেকে দুই হাজার কোটি অর্থাৎ বছরে ৬০ হাজার কোটি টাকা আয় করেন।
আয়ের একটি অংশ দেওয়া হয় মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ফান্ডে। বাকি টাকা দিয়ে নবী তার বাহিনীর কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। রোহিঙ্গা সূত্র বলছে, নবীর হয়ে ১২ হাজারের মতো রোহিঙ্গা মাদক পাচারে জড়িত এবং ৭ থেকে ১০ হাজার রোহিঙ্গা সামরিক শাখায় নিয়োজিত রয়েছে।
এদিকে নবী হোসেন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, আমি নবী হোসেনকে কখনো দেখিনি। তবে তার যে পরিমাণ অনুসারী ইয়াবা পাচারকারী রয়েছে, নবী যদি আমার এলাকায় চেয়ারম্যান পদে দাঁড়ায় সে চেয়ারম্যান হয়ে যাবে বলে আমার ধারণা। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে নবী বাহিনীর হাতে ৫ শতাধিক অস্ত্র ছিল। এখন তা বেড়ে কয়েকগুণ হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অংজউয়িং নামে মিয়ানমারে একজন পার্লামেন্ট মেম্বার রয়েছেন। তার আসল নাম জকির আহমেদ। তিনি আরাকান রাজ্যের নাকপ্পুরার মৃত নুরুল আলমের ছেলে। বর্তমানে থাকেন ইয়াঙ্গুনে। এমপি অংজউয়িং নবী হোসেনের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় এবং সন্ত্রাসী মাস্টার মুন্নার আপন চাচা। অংজউয়িংয়ের পরামর্শে মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনী নবী হোসেনদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করে থাকে।
এরই অংশ হিসাবে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে গড়ে ওঠা অর্ধশতাধিক ইয়াবা ও আইসের কারখানার নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়া হয়েছে নবী ও মাস্টার মুন্নার হাতে। বিনিময়ে বাংলাদেশে মিয়ানমার সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে তারা। এছাড়া আমেরিকা প্রবাসী রোহিঙ্গা নেতা হাবিব উল্লাহ ও সৌদি প্রবাসী রোহিঙ্গা নেতা হাফেজ কবিরও নবী হোসেনদের পরিকল্পনায় জড়িত বলে তথ্য পাওয়া গেছে।