• শুক্রবার , ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪

সিনহা শপথ ভঙ্গ করেছেন-খায়রুল


প্রকাশিত: ১:২০ পিএম, ২০ আগস্ট ১৭ , রোববার

নিউজটি পড়া হয়েছে ১১১ বার

স্টাফ রিপোর্টার  :  আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক বলেছেন, সংসদকে অকার্যকর বলে sinha-khairul-www.jatirkhantha.com.bdপ্রধান বিচারপতি সবচেয়ে আপত্তিকর কথা বলেছেন। সংসদকে অকার্যকর বলা একজন জজ বা জুডিশিয়ারির ভাষা হতে পারে না। সুপ্রিম কোর্টের ভাষা হতে পারে না। জজ সাহেবরা একটা শপথ নেন। শপথে বলা হয়, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে আমি কিছু করবো না; কিন্তু রায়ের পর্যবেক্ষণে যা বলা হয়েছে তাতে অনুরাগ না হোক, বিরাগ আছে কি না এবং তা থাকলে তার ফলাফল আপনারা জানেন।

প্রসঙ্গত, ইতোপূর্বে হাইকোর্ট সংসদ সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছিল  সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ বাতিল করে দেওয়া রায়ে সেটি অনাঙ্ক্ষিত ও অনুচিত বলে মন্তব্য করা হয়েছে। আলোচ্য রায়ে বলা হয়- আমরা কেউ কারো এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারি না। বরং সংসদ ও বিচার বিভাগের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হবে। ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেওয়া পর্যবেক্ষণে বলা হয়- আমাদের দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র এখনো পরিপক্বতা অর্জন করতে পারেনি।

বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, তিনি ওনার এই বক্তব্যগুলো বিরাগের বশবর্তী হয়ে যদি বলে থাকেন তাহলে সে রায়ের কি অবস্থা হবে- তা আপনারাই বিবেচনা করবেন। তিনি বলেন, কোনো রায় অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হতে পারবে না। আমরা জজ সাহেবরা শপথ গ্রহণ করি কোনো অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে কোনো কিছু করবো না; কিন্তু রায়ে যদি অনুরাগ বা বিরাগের প্রভাব বিস্তার করে তাহলে রায়ের কি অবস্থা দাঁড়ায়? এক্ষেত্রে আমার বলার কিছু নাই। ‘জাতীয় শোক দিবস, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় ও জননেত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নের রাজনীতি’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় বিচারপতি খায়রুল হক এসব কথা বলেন।

বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, সংসদ সদস্যরা ইমম্যাচিউরড, সংসদ অকার্যকর, সংসদ আমাদের নির্দেশ মানেনি এ কথাগুলো যদি অনুরাগ, বিরাগের মধ্যে চলে আসে তাহলে সে জজ সাহেবের পজিশনটা কি হবে, তার শপথ থাকছে কি না সেটাও আপনাদের বিচার করা উচিত বলে আমি মনে করি। আমি পয়েন্ট আউট করে দিলাম। কখনো কোনো বিচারপতি অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে কিছু লিখতে পারবেন না। যদি লেখেন তাহলে তার শপথ ভেঙে যায়। আর শপথ ভঙ্গ হলে কি হতে পারে তা আপনারাই ভালো জানেন?

গতকাল শনিবার নগরীর সিরডাপ মিলনায়তনে এই সভার আয়োজন করে বাংলাদেশ হেরিটেজ ফাউন্ডেশন। সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের চেয়ারম্যান ও সাবেক সচিব ওয়ালিউর রহমান। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক উপস্থিত ছিলেন না। তবে আরেক বিশেষ অতিথি খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম এমপি বলেন, প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা আপিল বিভাগের বিচারক থাকাকালে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আপিল বেঞ্চের একজন সদস্য ছিলেন। এছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ও আমাদের পক্ষে দিয়েছেন। এসব অনেক কিছুতেই দেখছি যে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের পক্ষের মানুষ। কিন্তু ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের পর্যবেক্ষণে তিনি পুরো ইউটার্ন করেছেন, এতে আমার ভয় হয়।

বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, উচ্চ আদালতের একটি রায় কিন্তু আইন। প্রধান বিচারপতি রায়ের মধ্যে যে সব কথা বলেছেন সেটা যদি বাইরে বলতেন তাহলে হয়তো এত কথা উঠতো না। কিন্তু রায়ের মধ্যে বলেছেন, তখন সেটা আইনের অংশ হয়ে গিয়েছে এ কারণেই এতো আপত্তি। তিনি তার রায়ের মধ্যে সংসদকে অকার্যকর বলেছেন এটাই সর্বনাশী ব্যাপার। সে কারণে এটাতো আমাদের মনিটরিং করতে হবে সেটা কারো পছন্দ হোক বা না হোক। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে এটা আমার দায়িত্ব।

তিনি বলেন, ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে ইস্যুর বাইরেও কিছু কথাবার্তা হয়েছে। সাধারণত যে ইস্যুগুলা থাকে ওই ইস্যুর বাইরে যাওয়ার সুযোগ থাকে না। গেলেও সেটার খুব কাছাকাছি থাকতে হয়। ইস্যুর বাইরে গিয়ে কিছু বলা উচিত নয়। এ রায়ের সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে অনেক কিছু বলা হয়েছে। ১১৬ তে নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধান রয়েছে।

তিনি বলেন, ১১৬ নিয়ে বর্তমানে একটি দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা চালু আছে। দ্বৈত শাসন মানে এ রকম যে, নিম্ন আদালতের বিচারকদের প্রমোশন বা বদলি সংক্রান্ত প্রস্তাব মন্ত্রণালয় থেকে সুপ্রিম কোর্টে পাঠিয়ে দেয়া হয়। জিএ কমিটি বা ফুল কমিটি তা বিচার বিবেচনা করে হয় তাতে একমত করেন বা দ্বিমত করেন। বর্তমান ব্যবস্থা হলো এই। আমি মনে করি এই ব্যবস্থাটাই উত্তম। কারণ এখানে কোনো পক্ষেরই এক্সিট্রিম কোনো কিছু করার সুযোগ থাকে না।

কারণ এখানে সম্পূর্ণ ক্ষমতাই যদি সরকারের উপর ন্যস্ত থাকে তাহলে হয়তো কিছুটা অপব্যবহার করার সুযোগ থাকে। আবার সমস্ত ক্ষমতা যদি সুপ্রিম কোর্টের ওপর থাকে, সুপ্রিম কোর্টে যে সমস্ত বিচারকগণ আছেন তারা কিন্তু ফেরেস্তা না। তাদেরও ভুল-ভ্রান্তি হতে পারে। তাদেরও নানা রকম দুর্বলতা থাকতে পারে। নানা রকম সমস্যা থাকতে পারে। কাজেই এক হাতে এই গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটা না থাকাই ভালো বলে আমি মনে করি।

তিনি বলেন, দু’জনের হাতেই আছে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা। যদি সুপ্রিম কোর্ট কিছু বলতে চান অবশ্যই তারা মন্ত্রণালয়কে বলতে পারেন আমরা এই জিনিসটা চাচ্ছি। তাতে মন্ত্রণালয় কখনো ডিসঅবলাইজ (অবাধ্যচারণ) করে বলে আমার মনে হয় না। আবার মন্ত্রণালয় যদি কোনো কিছু চায় তাহলে তারা সুপ্রিম কোর্টকে অনুরোধ করতে পারে।

এই ব্যবস্থাটাই চালু থাকা উচিত। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে ষোড়শ সংশোধনীর রায় এ বিষয়ে ছিল না। যদিও প্রধান বিচারপতি এটাকে টেনে নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। যেটা বিয়ন দ্যা ইস্যু। যেটা ওনার বলাটা ঠিক হয়েছে বলে আমি মনে করি না। তিনি বলেন, এছাড়াও উনি (প্রধান বিচারপতি) সংসদকে নিয়ে নানা রকম মন্তব্য করেছেন। সংসদ সদস্যরা আর কিছু না হোক তারা জনগণের প্রতিনিধি। সেটাই তাদের প্রথম যোগ্যতা। এটাই তাদের সব থেকে বড় পরিচয়, সম্মানের পরিচয়।

তারাই জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন। সেটা যিনিই হোন না কেন। সবাইকে যে পিএইচডি ডিগ্রিধারী হতে হবে এমনতো কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। অবশ্য অনেকে সংসদ সদস্যই পিএইচডি ডিগ্রিধারী আছেন। ইংল্যান্ড আমেরিকাতেও সব সময় অত বড় শিক্ষিত পার্লামেন্টারিয়েন পাওয়া যায় না। যদিও এটা অবাক লাগতে পারে।

কিন্তু এটাই ফ্যাক্ট। একজন সংসদ সদস্যের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা কোনো ক্রাইটেরিয়া হতে পারে না। জন মেকার্স গ্রেট ব্রিটেনের প্রাইম মিনিস্টার ছিলেন। ওনার তো এ লেভেল ও লেভেল পাস ছিল না। কিন্তু ওনিতো ছিলেন স্কিল ও (দক্ষ) লিডার। একজন সংসদ সদস্যের ক্রাইটেরিয়া হচ্ছে আপনি দেশের মানুষকে ভালোবাসেন কি না বা জনগণ আপনাকে ভালোবাসে কি না সেটা । আর অন্য কোনো কিছু নয়। এখানে প্রধান বিচারপতি সেই সংসদকে বলেছেন ‘ইমম্যাচিউরড’। এটা শকিং (দুঃখজনক)।

তিনি বলেন, সংবিধানের ৬৫ (৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মহিলাদের নির্বাচনের অংশ গ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছে। এটাই গণতন্ত্রের ম্যাচিউরিটি। কোনটা ম্যাচিউরড সেটা উনি বলার কে?  কোনটা কি হবে, না হবে তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক হলো সংসদ সদস্যরা, জুডিশিয়ারির নয়। এ বিষয়ে একজন বিচারপতি বলতে পারেন না।

উনি বলেছেন ১৫২ জন ঠিকভাবে নির্বাচিত হয়ে আসেনি। তাহলে ওনারা (বিচারপতিরা) কি ঠিকভাবে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন নাকি? এক জায়গায় উনি বলেছেন, আমরা সংসদকে যে নির্দেশনা দিয়েছিলাম সে নির্দেশনা সংসদ মানেনি। সংসদকে নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের নেই। সেই নির্দেশ যদি দিয়েও থাকে তাহলে তা মানতে সংসদ বাধ্য নয়। সংসদ হলো সার্বভৌম। সংসদ দেশের সমগ্র প্রতিষ্ঠানের মালিক।

অ্যামিকাসকিউরিদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেন বিচারপতি খায়রুল হক। তিনি বলেন, এ রায়ে ৮/৯ জন অ্যামিকাস কিউরি এটাকে সাপোর্ট করেছে। জোরেশোরে সাপোর্ট করেছে। তারা অত্যন্ত বিদ্বান লোক, বোদ্ধা মানুষ তাতে কোনো সন্দেহ নেই্। তারাতো সুপ্রিম কোর্টেই প্র্যাকটিস করেন। সেখান থেকে তারা বিপুল টাকা আয় করেন।

এখন থেকে প্রায় ৪৮ বছর আগের কথা । তখন আমি শিক্ষানবিস আইনজীবী ছিলাম। আমার সিনিয়র আমাকে বলেছিল ‘যে দেবতা যে মন্ত্রে তুষ্ট, সেই দেবতাকে সেই মন্ত্রেই সুধাবা।’ আমি কি বলেছি, আশা করি আপনারা বুঝতে পেরেছেন। অ্যামিকাসকিউরিদের সম্পর্কে বাকি কিছু বলার নেই।

তিনি বলেন, আরেকটি কথা প্রায়ই উঠে আমি আইন কমিশনের চাকরি করি। এখানে বসে এত কথা বলা উচিত কি না? তাদের হয়তো আইন কমিশন সম্পর্কে কোনো আইডিয়া না থাকারই কথা। আইন কমিশন কিন্তু এমন একটা প্রতিষ্ঠান যেখানে আইন নিয়েই গবেষণা।

আইনকে মনিটর করাও আমাদের আরেকটা কাজ। সরকার কোন আইন কখন করছে, কোন আইনে কি সমস্যা আছে সেটা পয়েন্ট আউট করা। সরকারকে জানানো প্রয়োজনে মন্ত্রীকে সরাসরি জানানো এবং নতুন আইন তৈরি করা। বিদ্যমান আইন সময়োপযোগী করা।

খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, আমার খুব ভয় হচ্ছে। আমি ভরসা পাচ্ছি না। পঁচাত্তরের পরবর্তী সময়ের মতো আরেকটি বড় আঘাত আসতে পারে। আমার মনে হচ্ছে জিয়ার মতো বিচারপতি সিনহাও একই রূপ ধারণ করছেন। দুষ্ট লোকেরা বলে তিনি ১/১১’র কুশিলবদের হয়ে কাজ করছেন।

রাজনৈতিক বিবেচনাই তাকে ১৯৯৯ সালে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। রাজনৈতিক মতাদর্শী চিন্তাধারায় তিনি নিয়োগ পেয়েছিলেন।  বিএনপি বা এরশাদ যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল তাকে কিন্তু তখন নিয়োগ দেয়নি। যেই সংসদকে তিনি অকার্যকর বলেছেন সেই সংসদের প্রধানমন্ত্রীর আমলেই তিনি প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন।