সালতামামি ২০১৪: আলোচিত ঘটনা
লাবণ্য চৌধুরী.ঢাকা:
৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঘিরে শঙ্কা নিয়ে বাংলাদেশে শুরু হয়েছিল খ্রিস্টীয় এই বছর। নানা প্রশ্ন উঠলেও ভোট হয়ে যাওয়ার পর রাজনীতিতে উত্তাপ কমে গিয়েছিল অনেকটাই, বছরজুড়ে পরিস্থিতি একই রকম থাকলেও শেষ ভাগে এসে কিছুটা উত্তাপ দেখা যাচ্ছে।বহুল আলোচিত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর বছরজুড়ে যে সব ঘটনা দেশজুড়ে আলোচনার ঝড় তুলেছিল, ২০১৪ সালের বিদায় লগ্নে জেনে নেওয়া যাক সেসব ঘটনাগুলো।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন
ভোট ঠেকানোর ঘোষণা ছিল বিএনপির, ভোটের আগের দিনও হামলা হয়েছিল ভোটকেন্দ্র ও নির্বাচন কর্মকর্তাদের ওপর, সব মিলিয়ে এক ধরনের শঙ্কায় ছিল দেশবাসী। এর মধ্যেই দশম সংসদ নির্বাচনে জিতে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ।

বহু কেন্দ্রে ব্যালটবক্স ছিল এমনই শূন্য—————————————————————
সংসদের মোট ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টির প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় এবং এর মধ্যে আওয়ামী লীগেরই ১২৭ জন হওয়ায় ভোটের ফল নিয়ে কারও আগ্রহ তেমনটা ছিল না। গণনা শেষে নির্বাচন কমিশন যে তথ্য জানিয়েছে, তাতে দেখা গেছে ভোটের হার ৪০ শতাংশ। সংসদের অর্ধেকের বেশি আসনের ভোটাররা এবার ভোট দেওয়ার সুযোগ পাননি, যা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে। বিএনপির ভাষ্য, এতে জনগণের ভোটাধিকার হরণ হয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতাদের যুক্তি, এর দায় বিএনপির, কারণ তারা ভোটে আসেনি।দেশে-বিদেশে প্রশ্নবিদ্ধ এই নির্বাচনের পর সরকার গঠনের সময়ও আরেকটি চমক দেখেছে দেশবাসী। বিএনপিবিহীন সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসার পাশাপাশি সরকারেও অংশ নিয়েছে জাতীয় পার্টি। দলটির তিনজন মন্ত্রী হয়েছেন, চেয়ারপারসন এইচ এম এরশাদ হয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত।
৭ খুন আর র্যাব
বিশ্বকাপ উৎসবের রেশ কাটতে না কাটতে এপ্রিলের শেষে নারায়ণগঞ্জে এক কাউন্সিলর এবং এক আইনজীবীসহ সাতজনকে অপহরণ করে হত্যাকাণ্ড থমকে দেয় দেশবাসীকে। এরপর এই হত্যাকাণ্ডে সন্ত্রাস দমনে গঠিত বাহিনী র্যাবের কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততার তথ্য প্রকাশ দেশবাসীকে করে স্তম্ভিত।
নদীতে ভেসে ওঠা লাশ তোলা হচ্ছে————————————————————–
২৭ এপ্রিল সড়কে গাড়ি থামিয়ে তুলে নেওয়া হয়েছিল এই সাতজনকে, যা নিয়ে তুমুল আলোচনার মধ্যে তিন দিন পর শীতলক্ষ্যা নদীতে তাদের হাত-পা বাঁধা লাশ ভেসে ওঠে। এরপর নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের পরিবারের পক্ষ থেকে র্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হলে তা আলোচনার ঝড় তোলে।
এরপর আদালতের নির্দেশে র্যাবের তিন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগে তাদের সামরকি বাহিনী থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। এই কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, সেনাবাহিনীর এই লেফটেন্যান্ট কর্নেল নারায়ণগঞ্জে র্যাবের শীর্ষ কর্মকর্তা ছিলেন।
সাত খুনে র্যাবের সম্পৃক্ততার প্রমাণ বিভিন্ন তদন্তে উঠে এলেও এই হত্যাকাণ্ডের মূল আসামি নারায়ণগঞ্জেরই আরেক কাউন্সিলর নূর হোসেন। হত্যাকাণ্ডের পর দেশ পালিয়ে যাওয়া এই ব্যক্তি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ধরা পড়ে এখন সেখানে কারাগারে রয়েছেন। ধরা পড়ার আগে নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমানের সঙ্গে তার টেলিফোন কথোপকথনও আলোচিত হয়।
প্রশ্ন ফাঁস
প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ভর্তি পরীক্ষা থেকে নিয়োগ পরীক্ষা সবখানে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ছিল বছরজুড়ে। এ নিয়ে কঠোর সমালোচনায় পড়তে হয়েছে সরকারকে। সেই সঙ্গে কৌশল বদলানোরও উদ্যোগ নেওয়া হয়। আগামী বছর থেকে প্রাথমিক সমাপনীর প্রশ্ন বিজি প্রেসে না ছাপিয়ে পরীক্ষা কেন্দ্রেই ছাপিয়ে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে কর্মসূচিতে অধ্যাপক জাফর ইকবাল
ফেইসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে ‘সাজেশন’ আকারে ছড়িয়ে পড়ে প্রাথমিক সমাপনী, জেএসসি-জেডিসি, এসএসসি এবং এইচএসসির প্রশ্ন।প্রশ্ন ফাঁসের প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে একদিন অবস্থান কর্মসূচিও পালন করেন লেখক-অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল।
প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ বছরজুড়ে যেমন ছিল, তেমনি প্রতিবারই তা অস্বীকার করেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, যদিও এইচএসসিতে একটি পরীক্ষা বাতিল করতে হয়েছিল মন্ত্রণালয়কে। এক পর্যায়ে প্রশ্নফাঁস প্রতিরোধে পরীক্ষার সময় মোবাইল ফোন ও ফেইসবুক বন্ধ রাখার কথা বলে নতুন করে সমালোচনায় পড়েন শিক্ষামন্ত্রী।
ফাঁসি এড়ালেন সাঈদী
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ড হলেও স্বাধীনতা যুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রায়ে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড হয় আপিলের রায়ে।

দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী
আপিল বিভাগ গত ১৭ সেপ্টেম্বর এই রায় দিলে ক্ষোভে ফেটে পড়ে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে আন্দোলনকারীরা, সরকারের বিরুদ্ধে আপসের অভিযোগও ওঠে। আপিল বিভাগের এই রায়কে অপ্রত্যাশিত বললেও আপসের অভিযোগ নাকচ করা হয় সরকারের পক্ষ থেকে।
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া সাজা আপিলে বহাল না থাকার জন্য ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার ও প্রসিকিউশনের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও একই অভিযোগ তুললে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রসিকিউশন দল পুনর্গঠনের আশ্বাস দেন, তবে বছরজুড়ে তা আর হয়নি।
এর মধ্যে ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী, মীর কাসেম আলী, এ টি এম আজহারুল ইসলামসহ পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়। আপিলের রায় হয় সাঈদী ও মো. কামারুজ্জামানের। সাঈদীর সাজা কমলেও কামরুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে।
আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর পতন
একটি মাত্র মন্তব্যের জন্য দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের দৃশ্যত ইতি ঘটল আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর। প্রবাসে হজ নিয়ে করা ওই মন্তব্যের জন্য মন্ত্রিত্ব-দলীয় পদ সব খুইয়ে এখন কারাগারের বাসিন্দা তিনি। অথচ এর আগড় পর্যন্ত দল কিংবা মন্ত্রিসভায় দুটোতেই দাপটের সঙ্গে বিচরণ ছিল তার।
শেখ হাসিনার গত সরকারে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সামলানোর পর এবার দুটো মন্ত্রণালয় দেওয়া হয়েছিল তাকে। টাঙ্গাইলের প্রভাবশালী সিদ্দিকীদের সব কিছু ঠিকঠাকই ছিল গত ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্রে উপস্থিতির মধ্যে নিউ ইয়র্কে এক অনুষ্ঠানে লতিফ সিদ্দিকী বলেন, তিনি হজের বিরোধী।

আব্দুল কাদের সিদ্দিকী
হজ নিয়ে লতিফ সিদ্দিকীর ওই মন্তব্যে সারাদেশে আলোচনার ঝড় ওঠে, গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে রাজপথে নামে ইসলামী বিভিন্ন দল ও সংগঠন। নিজ দল আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও সোচ্চার হন তার বিরুদ্ধে।
এরপর ধর্ম অবমাননার অভিযোগে একটির পর একটি মামলা হতে থাকে লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে। এর মধ্যেই মন্ত্রিসভা ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলী থেকে বাদ দেওয়া হয় তাকে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতে গিয়ে কিছুদিন অবস্থানের পর গত ২৩ নভেম্বর দেশে ফেরার দুদিন পর আদালতে আত্মসমর্পণের পর থেকে তিনি কারাগারে।
ইতিহাস বিতর্ক
দেশে এ কে খন্দকার আর বিদেশে তারেক রহমান- ইতিহাসের কয়েকটি বিষয় নিয়ে রজনীতিতে দুই মেরুর এই দুজনের লেখা ও বক্তব্য বছরজুড়েই ছিল আলোচিত। আওয়ামী লীগের গত সরকারের মন্ত্রী খন্দকার লিখেছেন বই ‘একাত্তর ভেতরে-বাইরে’, জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার ছেলে দিয়েছেন কয়েকটি বক্তৃতা।
মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান সেনাপতি খন্দকার তার বইয়ে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের শেষ ‘জয় পাকিস্তান’ বলার মধ্য দিয়ে শেষ হয় বলে দাবি করেন। আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি ছিল না বলেও লেখেন তার বইয়ে।
খন্দকারের লেখার তীব্র সমালোচনা আসতে থাকে আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্য থেকে। তার একাত্তরের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। এর মধ্যেই তিনি সমর্থন পেয়ে যান প্রবাসে থাকা তারেক রহমানের; আরও কয়েকটি বিষয়ে নিজের বক্তব্যের ক্ষেত্রে খন্দকারের বইয়ের উদ্ধৃতি ব্যবহার করতে থাকেন খালেদা জিয়ার ছেলে।

এ কে খন্দকারের বই

তারেক রহমান
তারেক প্রথমে দাবি করেন, বঙ্গবন্ধু ছিলেন ‘অবৈধ’ প্রধানমন্ত্রী, তার বাবা জিয়া ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ‘ঘোষক’ ও ‘প্রথম’ রাষ্ট্রপতি। এনিয়ে দেশে সমালোচনার মধ্যে তারেক আরেক বক্তৃতায় বলেন, মুজিব পরিবার বাংলাদেশের জন্য অভিশাপ। সমালোচনা ও মামলার মধ্যে গত ১৫ ডিসেম্বর আরেক বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধুকে ‘রাজাকার’ আখ্যায়িত করেন।
এ কে খন্দকারের মতোই প্রতিটি বক্তৃতার পর ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের তীব্র বাক্যবাণ ছোটে তারেককে লক্ষ্য করে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সম্প্রতি তারেককে সামলানোর জন্য তার মা খালেদা জিয়াকে হুঁশিয়ার করে দেন। খন্দকারের পাশাপাশি দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে শারমিন আহমেদের লেখাও দৃশ্যত বিপাকে ফেলেছে আওয়ামী লীগকে, ক্ষমতাসীনদের আক্রমণে তাজউদ্দীনকন্যার লেখাকেও হাতিয়ার করছেন খালেদা জিয়াসহ বিএনপি নেতারা।
সুন্দরবনের জলে তেল
বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের শেলা নদীতে গত ৯ ডিসেম্বর সাড়ে তিন লাখ লিটারের বেশি ফার্সেন অয়েল নিয়ে একটি ট্যাংকার ডুবে গেলে তেল ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক উদ্বেগের সৃষ্টি হয়, যা বনের ভেতরে দিয়ে বাণিজ্যিক নৌচলাচল নিয়েও নতুন করে প্রশ্ন তুলে দেয়।

সুন্দরবনের জলে তেলের স্তর
তেল নিঃসরণের কারণে সুন্দরবনের প্রতিবেশ এবং জলজ প্রাণী বিশেষ করে ইরাবতী ডলফিনকে নিয়ে বেশি উদ্বেগ দেখা দিয়েছিল। কারণ যেখানে ট্যাংকারটি ডুবেছিল, তার কাছেই এই ডলফিনের অভয়াশ্রম। জলের ওপরে তেলের স্তর ভাসা অবস্থায় কয়েকদিন এই ডলফিনের দেখাও মিলছিল না।
সুন্দরবনে এই তেল নিঃসরণ নিয়ে জাতিসংঘও উদ্বেগ জানায়। এরই মধ্যে নদীতে ভাসমান তেলের স্তর তুলতে স্থানীয় মানুষদের কাজে লাগায় সরকার। তাদের সংগ্রহ করা তেল কিনে নেওয়া হয়। এরপর বন বিভাগও তেল অপসারণের উদ্যোগ নেয়।
জল থেকে তেলের স্তর সরিয়ে নেওয়ার পর ধীরে ধীরে ডলফিনের দেখা মেলাসহ পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হলেও ওই স্থান দিয়ে বাণিজ্যিক নৌচলাচল বন্ধের দাবি রয়েছে জাতিসংঘসহ পরিবেশবিদদের। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এর পক্ষে হলেও নৌমন্ত্রণালয়ের আপত্তিতে তা ধোপে টেকেনি।