• সোমবার , ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

সাত শিক্ষা বোর্ডে সাত রকমের প্রশ্ন- ৪৮০ হতে অসুবিধা কোথায়?


প্রকাশিত: ৭:০০ পিএম, ৭ জুন ১৪ , শনিবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ২২১ বার

 

manjorol-jatirkhanthaসৈয়দ মনজুরুল ইসলাম:  জুন ০৭, ২০১৪:   পাবলিক পরীক্ষাগুলোর প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়াটা এ দেশে নতুন নয়—অনৈতিক কাজে আমাদের মেধা যেভাবে খরচ করি, তাতে এই চর্চা নতুন হওয়ার কথাও নয়। কিন্তু ভাবনার কথা হলো ফাঁসের ঘটনা বাড়ছে। অনেক লোকের কাছে এটি লোভনীয় ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র সামাজিক যোগাযোগের নানা মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে ব্যবসানিরপেক্ষ আনন্দের ভাগীদারও হচ্ছেন অনেকে। কিন্তু ওই ফাঁস হওয়ার ব্যাপারটা যে আমাদের শিক্ষা-দর্শনের গলাতেই ফাঁস পরিয়ে এর দফারফা করছে, তা আমরা খেয়াল করছি না। কিন্তু আজ যা সামান্য একটু দমকা বাতাস, কাল যে তা ঝড়ের তাণ্ডবে রূপ নেবে না, তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে।
পত্রপত্রিকায় নানান সময়ে আমরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিভাগের অথবা মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার অথবা বিসিএস ২৫ বা ২৭ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার কথা পড়েছি। অনেক ক্ষেত্রে তদন্ত কমিটি হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে তদন্ত কমিটি হওয়া আর অপরাধের বিষয়টা একসময় চাপা পড়ে যাওয়া একই জিনিস বলে ফাঁসকারীদের বিরুদ্ধে তেমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে অপরাধীরা নিশ্চিন্ত মনে এবং বেপরোয়াভাবে কাজটা করার ধৃষ্টতা দেখায়। সর্বশেষ গত এইচএসসি পরীক্ষায় কয়েকটি প্রশ্নপত্র আগেভাগেই পরীক্ষার্থীদের হাতে চলে আসায় দেশব্যাপী ক্রোধ ও হতাশা তৈরি হয়েছে। পত্রপত্রিকায়, টিভি চ্যানেল এবং ফেসবুকে প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার পক্ষে প্রমাণ তুলে ধরা হয়েছে। এরপর আমাদের জন্য তিনটি পথই শুধু খোলা থাকল: এক. আমাদের সেই চিরাচরিত অস্বীকার করার এবং দায় এড়িয়ে যাওয়ার অভ্যাসের আরেক দফা চর্চা করে বিষয়টিকে আমরা গুরুত্বহীন করে দিতে পারি, দুই. একটি তদন্ত কমিটি করে কিছুদিন হইচই করে, নানাবিধ আওয়াজ তুলে, একসময় আমরা চুপ করে যেতে পারি এবং তিন. কোমর বেঁধে সর্বশক্তি নিয়ে এই সামাজিক ব্যাধিটি চিরতরে নির্মূল করার কাজে নামতে পারি।
প্রথম পথটি গ্রহণ করলে আমরা প্রমাণ করব জাতি হিসেবে আমরা সুনীতি, সুস্থতা এবং সততাকে বিদায় জানিয়ে দিয়েছি। দ্বিতীয় পথটি গ্রহণ করলে আমরা আত্মপ্রবঞ্চক জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করব। আর তৃতীয় পথটি ধরে এগোলে আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে বলতে পারব, আমরা দুর্নীতির সঙ্গে আপস করি না। আমরা আমাদের সন্তানদের জীবন ও ভবিষ্যৎ নিয়ে কাউকে ব্যবসা করতে দেব না। এমনিতেই পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, নদী হারিয়ে যাচ্ছে, খেলার মাঠ হাওয়া হয়ে যাচ্ছে, খাদ্যে বিষ ঢুকছে—আমরা শুধু অসহায়ের মতো দেখে যাচ্ছি। কিন্তু এখন আমাদের বলতে হবে, অনেক হয়েছে, আর না।pro-3
অনেকে হয়তো বলবেন, কয়েকটা প্রশ্নপত্র মাত্র ফাঁস হলো (কেউ কেউ বলবেন, ফাঁস হয়নি, হলেও যৎসামান্য), এ নিয়ে এমন যুদ্ধে নামার কী হলো? আমার উত্তরটা হলো, একটা বরফঢাকা পাহাড়ের ওপর থেকে যদি বরফের একটা পিণ্ড গড়িয়ে পড়ে, নিচের উপত্যকায় নামতে নামতে সেটি এক বিরাট দৈত্যের আকার নিতে পারে। শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য যেভাবে বাড়ছে—শিক্ষামন্ত্রী নিজেই বলেছেন, দেশের কোচিং-বাণিজ্যের পরিমাণ টাকার অঙ্কে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা—তাতে এই প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টাকে ওই বরফের গোলার সঙ্গে তুলনা করতে পারি। পিণ্ডটা আলগা হয়ে একটু নড়ে উঠছে, এটিকে এখনই ধরে গুঁড়ো করে না ফেললে এটি যে নিচের দিকে গড়িয়ে যাবে, তা তো নিশ্চিত। এবং অনেক নিচে নামতে নামতে এর আকার ও শক্তি এমন বাড়বে যে এটি প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়াবে।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টার যদি আমরা এখনই সুরাহা করতে না পারি, তাহলে কী হতে পারে, সেটি কিছু ভুক্তভোগীর মুখেই শুনুন। কয়েকটি টিভি চ্যানেলে দেখলাম, কয়েকজন এইচএসসি পরীক্ষার্থী বলছে, তারা ভয়ানক হতাশ। এক পরীক্ষার্থী বলল, অনেক খেটেখুটে যে পরীক্ষা দিয়েছে, নিয়মমতো পড়াশোনা করেছে, এখন সে যদি ‘এ’ পায় এবং একজন পরীক্ষার্থী ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে ‘এ প্লাস’ পায়, তাহলে সে আর পড়াশোনায় উৎসাহ পাবে না। আরেক পরীক্ষার্থী বলল, ছোটবেলা থেকে সে যে শুনে এসেছে, সৎ পথে থেকো, সৎ কাজে সিদ্ধি লাভ হয়, এ বিষয়টাই তো ভুল প্রমাণিত হবে। আমার বিভাগের প্রথম বর্ষের কিছু শিক্ষার্থী আমাকে অনুরোধ করেছে, প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে কাগজে লিখতে। তাদের কেন এ নিয়ে চিন্তা করতে হবে, তারা তো এইচএসসি পাস করে এসেছে? তারা বলল, স্যার, নকল করে পাস করা ডাক্তারের কাছে আপনি যাবেন? নকল করে প্রকৌশলী হওয়া কোনো লোকের কাছে দালান বা পুল বানানোর দায়িত্ব দেবেন?
একসময় দেশে খুব নকল হতো। গত বিএনপি সরকারের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী নকলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। তিনি গাড়িতে-হেলিকপ্টারে চড়ে পরীক্ষাকেন্দ্রে যেতেন। নকলবাজ, নকল সরবরাহকারীদের ধরতেন৷ মানুষ তাঁকে সাধুবাদ জানিয়েছে। তাঁর এই অবস্থানকে অবশ্য রাজনীতির কাচের ভেতর দিয়ে দেখার চেষ্টা হয়েছে, যেমন আমাদের দেশে সব সময়ই হয়। কিন্তু নকল রোধের ফলটা গেছে তাঁর দলের নয়, দেশের পক্ষেই। নকল সমস্যার সমাধান হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে আমরা একজন শিক্ষাবান্ধব ও নিষ্ঠাবান শিক্ষামন্ত্রী পেয়েছি। তাঁর উদ্যোগে নকলপ্রবণতা ফিরে আসার সম্ভাবনা বন্ধ হয়েছে। মুখস্থনির্ভর শিক্ষাপদ্ধতি থেকে সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতির দিকে যাওয়ায় নকলের সুযোগ কমেছে। পত্রপত্রিকায় দেখেছি, আবার নকলের

চেষ্টা হচ্ছে। একটা খারাপ চর্চা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে, এই দুঃখ সহ্য করতে পারে না তেমন মানুষের অভাব এ দেশে নেই, বিশেষ করে ওই খারাপ চর্চায় যখন ধনসম্পদ হাতে আসে। তার পরও নকল ব্যবসা রমরমা হতে পারেনি। একটা সামাজিক মতৈক্য তৈরি হয়েছে এ ব্যাপারে, সেটি এখনো ভেঙে পড়েনি। একইভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করলে সেটিও বন্ধ হবে। নকলের মতো ভয়ানক সংক্রামক ব্যাধিকে নিয়ন্ত্রণ করা গেছে, এই দ্বিতীয় ব্যাধিটাও নিশ্চয় বাগে আনা যাবে।
শিক্ষামন্ত্রীর ওপর আমার আস্থা আছে। কিন্তু তিনি একা সবকিছু করতে পারবেন, তা ভাবার কারণ নেই। তিনি নিজেই বলেছেন, শিক্ষা-কারবারিরা এখন এক বিরাট শক্তি, তারা প্রতিরোধ সৃষ্টি করবে। কিন্তু তিনি যদি কাজটা শুরু করেন, দেশ তাঁর সঙ্গে থাকবে। কারণ এই ক্ষেত্রে ব্যর্থ হওয়ার মানে হচ্ছে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে বঞ্চিত করা, নৈতিকভাবে দুর্বল করে দেওয়া এবং শিক্ষার ভিত নড়বড়ে করে দেওয়া। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা আপাতত তুচ্ছ মনে হতে পারে—ওই পচা শামুকের মতো কিন্তু একবার পা কেটে গেলে বোঝা যাবে এ ধরনের কোনো কিছুকে অবহেলা করতে নেই।
একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। আমি মনে করি, একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির অধীনে তদন্ত কমিটি হলে আন্তমন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি থেকে তা অনেক বেশি শক্তিশালী হবে। এ রকম কমিটি যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ পাবে, তারা যে-ই হোক, তাদের আইনের আওতায় এনে কঠিন শাস্তি দিতে হবে। একটি প্রজন্মের আশা-ভরসাকে পঁুজি করে যারা ব্যবসা করে, তাদের জাতিদ্রোহী ছাড়া আর কী বলা যায়?
২. যতগুলো পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে, প্রায় সবগুলোতেই আকারের ব্যাপকতা রয়েছে। অঙ্কের সোজা হিসাব হলো, পরীক্ষার্থী সেখানে, ধরা যাক, পাঁচ লাখ প্রশ্ন বেচে লাভটাও কোটি কোটি টাকার। কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের সম্ভাবনাটা সব সময়ই থেকে যায়।
প্রশ্নপত্র ফাঁস কীভাবে ঠেকানো যায়? দোষীদের কঠোর শাস্তি দিলে, নজরদারি বাড়ালে, দায়িত্বপ্রাপ্তদের জবাবদিহি নিশ্চিত করলে সুফল আসবে, কিন্তু যত দিন পর্যন্ত পরীক্ষার প্রশ্ন ছাপানো হবে ব্যাপকভাবে এবং কেন্দ্রীয়ভাবে, তেমন মানুষের অভাব হবে না, যারা মুগদাপাড়ায় একটা তিন কাঠা জমি কেনার জন্য অথবা বহদ্দারহাটে একটা ব্যবসা খোলার জন্য প্রশ্ন ফাঁসের অপকর্মকে বেছে নেবে। সে জন্য একটি সমাধান হতে পারে স্থানীয়ভাবে প্রশ্ন ছাপানো। ব্যাপারটা কীভাবে করা যায়?
আমাদের সাত শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র, ধরা যাক কেন্দ্রীয়ভাবে না হয়ে স্থানীয়ভাবে তৈরি ও ছাপা হলো। তাহলে কী হতে পারে? ধরা যাক কোনো শিক্ষা বোর্ডের অধীনে প্রতিটি উপজেলায় পরীক্ষার দিন ভোর (অথবা রাত দুই-তিনটা) থেকে কোনো স্কুল-কলেজের প্রধানের ঘরে উপজেলার নানা স্কুল-কলেজ থেকে শিক্ষকদের এনে বসিয়ে প্রশ্নপত্র করতে বলা হলো। ধরা যাক ১০ জন শিক্ষক মিলে বাংলার দিন বাংলা, ইংরেজির দিন ইংরেজি পরীক্ষার প্রশ্ন করলেন। সেটি যথারীতি পরিমার্জনা করা হলো। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পাঠানো দুজন বিশ্লেষক পরীক্ষা করে দেখলেন এটির মান সঠিক কি না। সেটি কম্পিউটারে তোলা হলো, প্রিন্ট আউট নিয়ে তা ফটোকপি করা হলো। এখন তো উন্নত ফটোকপিয়ারে কয়েক হাজার কপি করা যায়। তারপর সকাল নয়টার মধ্যে পুলিশি পাহারায় সেই প্রশ্ন চলে গেল উপজেলার সব পরীক্ষা কেন্দ্রে।
স্কুল-কলেজপ্রধানের ঘরে যতক্ষণ কাজ চলবে, সবাই সম্মত হবেন, তাঁরা প্রশ্নপত্র পাঠিয়ে দেওয়ার আগে বাইরে যাবেন না এবং সৌজন্য দেখিয়ে মোবাইল ফোনগুলো আলমারিতে তুলে রাখবেন।
প্রশ্নপত্র তাহলে আর ফাঁস হবে কীভাবে? মান নিয়েও প্রশ্ন উঠবে না। আর যদি বলেন, ৪৮০ উপজেলায় ৪৮০ ধরনের প্রশ্ন হবে, এ কেমন কথা? তাহলে বলি, সাত শিক্ষা বোর্ডে সাত রকমের প্রশ্ন হলে ৪৮০ হতে অসুবিধা কোথায়? এতেও খুশি না হলে বলব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে স্কুলের পরীক্ষা হয় স্থানীয়ভাবে। সারা যুক্তরাষ্ট্রে পরীক্ষা হয় অসংখ্য প্রশ্নপত্রে। সে দেশের শিক্ষার মান নিয়ে নিশ্চয় প্রশ্ন উঠছে না।
খরচ? নগণ্য৷ উপজেলা শিক্ষা অফিসারের নেতৃত্বে কাজটি হবে। শিক্ষা বোর্ড একজন প্রতিনিধি পাঠাবে, মন্ত্রণালয় দুজন বিশেষজ্ঞ। মামুলি খরচ। কিন্তু যা লাভ হবে, একটি পরিচ্ছন্ন পরীক্ষাপদ্ধতি, শিক্ষার্থীদের আস্থা ও কৃতজ্ঞতা এবং অনাচারের অপসারণ।
৩. শিক্ষা নিয়ে আমাদের নিরন্তর ভাবতে হবে। বিশ্বমানের শিক্ষায় শিক্ষিত একটি প্রজন্ম তার জীবৎকালেই দেশটাকে চাঁদে পৌঁছে দিতে পারবে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।