‘সরকারের পরিস্থিতি ঢিলেঢালা’
অন্তর্বর্তী সরকারের দুই মাস শীর্ষক গোলটেবিল-
গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, বিপ্লবী সরকারের যে চরিত্র হওয়া দরকার এই সরকারের ভেতরে সেটা দেখছি না-মৌলবাদী সরকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য এক গ্রুপ উঠে পরে লেগেছেবলেন,-সাবেক সংসদ সদস্য নিলুফার ইয়াসমিন মনি, বিনা পরীক্ষায় এইচএসসি পরীক্ষার অটো পাশ করিয়ে দেয়াটা কোনো ভালো কাজ হয়নি বলেন-বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী
স্টাফ রিপোর্টার : গত দুই মাসে অন্তর্বর্তী সরকার অনেক সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান। তিনি বলেছেন, সরকারের দুইমাসের ভিতরে অন্ততপক্ষে ১০টি অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে। অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে সরকার সেগুলো মোকাবেলা করেছে। এ সময় দ্রুত সংস্কার কাজ শেষ করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার তাদের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার আহ্বান জানান তিনি। ওদিকে একই অনুষ্টানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিস্থিতি অনেকটাই ঢিলেঢালা বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
মঙ্গলবার ( ৮ অক্টোবর) দুপুরে গুলশানের একটি হোটেলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুই মাস শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে তাঁরা এসব কথা বলেন। বৈঠকের আয়োজন করে ইন্সটিটিউট ফর ডেমোক্রেসি এন্ড হিউম্যান রাইটস, মিলিনিয়াম ইউনিভার্সিটি। ‘দি মিলেনিয়াম’ বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারপারসন, বোর্ড অফ ট্রাস্টি এডভোকেট রোকসানা খন্দকারের সঞ্চালনায় বৈঠকে আরো বক্তব্য রাখেন- বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, সাবেক সংসদ সদস্য নিলুফার ইয়াসমিন মনি, গণফোরামের সভাপতি সুব্রত চৌধুরী, গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বক জোনায়েদ সাকি, সাংবাদিক মাসুদ কামাল, মায়ের ডাকের সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম তুলি, সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবীর।
মঈন খান বলেন, আজকে দেশ থেকে স্বৈরাচার মুক্ত হয়েছে বলে মুক্ত পরিবেশে কথা বলতে পারছি। গত দুই মাস আগে ড. ইউনুস বলেছিলেন কমিশনগুলোকে তিন মাস সময় দেয়া হবে। তিনি বলেছেন, নির্বাচন ও সংস্কার এক সঙ্গে চলবে। ভিন্নমত সরকারের কানে পৌঁছেছে। তাই তারা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসেছে। তবে সরকার যে কাজ গুলো করবে, তা দেশের জনগণসহ রাষ্ট্রের প্রতিটি স্টেকহোল্ডারের মতামত নিয়ে করতে হবে।
বিএনপির এই সিনিয়র নেতা আরো বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন দুই মাস অনেক সময়। ৯০ দিনের মধ্যে সর্বজন গ্রাহ্য নির্বাচন বাংলা দেশের ৫১ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য। তবে সংস্কার ও নির্বাচন সমান্তরালভাবে চলবে। সমালোচনা রয়েছে, গণতন্ত্রের বিভিন্ন সংজ্ঞা রয়েছে। এই সরকার কাজগুলো যতদ্রুত করতে পারছে। জনগণকে নতুন কোন শক্ত মেসেজ কি দিতে পারছে গত দুই মাসে? এমন প্রশ্ন সামনে এলেও; সরকারের দুইমাসের ভিতরে অন্ততপক্ষে ১০টি অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে। সরকারের কাজ মূল্যায়ন করতে হলে বলতে হবে সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের দুই মাসের কাজের মূল্যায়ন করা কঠিন। এতে এলোমেলোর মধ্যে তারা দায়িত্ব নিয়েছেন, যে কোনটা আগে এবং কোনটা পরে ধরবেন। এ বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হচ্ছে। তিনি বলেন, কতোজন শহীদ হয়েছেন, কতোজন আহত হয়েছেন তাদের সংখ্যা নির্ধারণ করা এবং যে এলোমেলো লুটপাট চলছে তা বন্ধ করা এই মূহুর্তে সবচেয়ে জরুরি।
অন্তর্বর্তী সরকারের ভালো কাজগুলো তুলে ধরে রিজভী বলেন, এই সরকারের সফলতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- পূর্বাঞ্চলের বন্যা নিয়ন্ত্রণে তাদের ভূমিকা ছিলো অপরিসীম। তবে বিনা পরীক্ষায় এইচএসসি পরীক্ষার অটো পাশ করিয়ে দেয়াটা কোনো ভালো কাজ হয়নি। যেভাবে হোক ছাত্রদের বুঝিয়ে শুনিয়ে হলেও পরীক্ষা নেয়া দরকার ছিল। পরীক্ষা ছাড়া এই অটোপাশ নেয়াটা শিক্ষা ব্যবস্থায় নেতিবাচক ঘটনা হয়ে থাকলো।
গণহত্যায় জড়িতদের বিচার অবশ্যই করতে হবে দাবি করে বিএনপির এই নেতা বলেন, স্বৈরাচার সরকারের দোসরদের বিচারের ব্যাপারে এ বিষয়ে সরকারের ভূমিকা বা আচরণ যা দেখছি তা অনেকটাই ঢিলেঢালা। ড. ইউনূসের মত গুণী মানুষের কাছে এ জাতি আরো ভালো কিছু আশা করে। তাকে দেশের প্রতি আরো নজর দিতে হবে। কারণ, সরকারের অবস্থান যদি এমন ঢিলেঢালা অবস্থায় থাকে, তবে স্বৈরাচার আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে।
বিএনপির এই নেতা বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য কঠোর হতে হবে। নরসিংদীতে ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় থাকা একজনকে ছুরিকাঘাত করলো এই সময় এসে, যখন আওয়ামী লীগের নেতারা পালানোর রাস্তা খুঁজে পাচ্ছে না। এটা কীভাবে সম্ভব? এমন ঘটনায় প্রশ্ন এসেই যায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা কি পদক্ষেপ নিলেন? শেখ হাসিনার দেশে ফেরার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শেখ হাসিনার ভারত ছাড়া কোন দেশে আশ্রয় পাচ্ছে না, এর কারণ একটাই আন্তর্জাতিক বিশ্ব জানে তিনি কতো বড় ভয়ংকর ফ্যাসিস্ট।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বক জোনায়েদ সাকি বলেন, এতোদিনের সংগ্রামের পর যখন একটি সরকারকে সমর্থন দিয়েছে, তারা দুই মাসে কি কি করার সমর্থন আছে সেটা হিসেব করতে হবে। তাদের সামনে করণীয় কি হবে তা আমাদেরই ঠিক করতে হবে। এই সরকারকে প্রতিপক্ষ ভাবার সময় কিংবা সুযোগ এখনো আসেনি। তবে সরকারের সমস্ত সংস্কার প্রক্রিয়ার রাজনৈতিক দলগুলোকে সবার আগে রাখতে হবে। রাষ্ট্রের সমস্ত স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে অতি দ্রুত একটি রোডম্যাপ ঠিক করতে হবে। সংস্কার ও নির্বাচনকে মুখোমুখি দাঁড় না করিয়ে এই দুটো জিনিসকে গুরুত্ব সহকারে পাশাপাশি রেখে এগিয়ে যেতে হবে।
গণফোরামের সভাপতি সুব্রত চৌধুরী বলেন, গত দুই মাসে আহতদের চিকিৎসার ব্যাপারে কোন অগ্রগতি দেখিনি। বাজার নিয়ন্ত্রণেও সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। ১৫ বছরের যে জঞ্জাল যেখান থেকে মুক্ত হওয়া আসলেই কঠিন। তিনি বলেন, দুই মাসের মাথায় আমরা বেশি অধৈর্য্য হয়ে যাচ্ছি। পুরো রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এখনো কোনো স্থিতিশীলতা আসেনি। আমাদের ধৈর্য্য ধরতে হবে; নির্বাচনই একমাত্র এজেন্ডা নয়। তবে সংস্কার করতে গিয়ে বছরের পর বছর লেগে গেলে সমস্যা। আমাদের মধ্যে যেন কোনো বিভক্তি না আসে, সে জন্য সরকারকে সর্বাত্মক সহায়তা করতে হবে।
সাংবাদিক মাসুদ কামাল বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের দুই মাসের মাথায় জনগণ ইতোমধ্যে বলতে শুরু করেছে আগেই ভালো ছিলো। তাহলে এই বিপ্লবের কি লাভ হলো? যেভাবে জিনিস পত্রের দাম বাড়ছে, বাণিজ্য উপদেষ্টা একটা কথাও বলেননি। তার কি কোনো দায়িত্ব নেই? তিনি বলেন, সরকার সংস্কারের জন্য যে কমিটি করেছে; সেখানে কোনো রাজনৈতিক দলের কাউকে রাখা হয়নি কেনো? পরবর্তী যারা ক্ষমতায় আসবে তারা কিভাবে কাজ করবে। ড. ইউনুসের প্রতি আহ্বান জানাই ‘রিসেট বাটনে’ এমনভাবে চাপুন; যেন দ্বিতীয়বার এসে আর কাউকে খুব শীঘ্রই ওই বাটনে চাপতে না হয়। তা না হলে জনগণ এমন ভাবে রিসেট বাটনে চাপবে যে এই সরকারের নাম নিশানা মুছে যাবে।
সাবেক সংসদ সদস্য নিলুফার ইয়াসমিন মনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের দুই মাস মানে সময়টা কম নয়। পতিত সরকারের পতিত পেতাত্নারা যেখানে সরব সেখানে সফলতা আসে না। মৌলবাদী সরকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য এক গ্রুপ উঠে পরে লেগেছে। তিনি বলেন, বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোকে বাদ দিয়ে কোন চিন্তা করলে তারা সফল হবে না। আমরা সরকারকে সহযোগিতা করতে চাই, কিন্তু তাদের রহস্যজনক আচরণ আমাদের বিস্মিত করে। আমাদের সব চেতনা চলে গেছে; শেষ যে চেতনা ছাত্রচেতনা সেটা ধ্বংস হয়ে গেলে আমাদের চেতনার কোনো অস্তিত্ব থাকবে না।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবীর বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ২ মাসে কিছু কাজ হয়েছে, কিছু হয়নি। তবে এই সরকারকে ব্যর্থ হতে দেয়া যাবে না। শুধু সরকারের ওপর ভরসা করে থাকলে হবে না। নিজ জায়গা থেকে সবাইকে সংস্কার কাজে এগিয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ সমস্যা দূর করতেও দলের ভেতরে সংস্কার জরুরি। পাশাপাশি সংস্কার কাজে সাধারণ মানুষকেও সুযোগ দিতে হবে যারা এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিল।
গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, বিপ্লবী সরকারের যে চরিত্র হওয়া দরকার এই সরকারের ভেতরে সেটা দেখছি না। ফলে নানা সমালোচনার জন্ম দিচ্ছে। লোক দেখানো সংলাপের জন্য দুই মাস পরে রাজনৈতিক দলগুলোকে ডাকা হয়েছিলো সেখানে কোন রোডম্যাপ দেয়া হয়নি। দুই মাসে আহত পরিবারগুলোর হাতে সহায়তা পৌঁছায়নি। গণ অভুথ্যানের স্বৈরাচারের মূল তালিকা এখনো প্রকাশ করা হয়নি। এতো অন্ধকারে থেকে সংস্কার হয় না।