সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে হাসিনার পরামর্শ চায় যুক্তরাষ্ট
বিশেষ প্রতিবেদক.ঢাকা: বৈশ্বিক সন্ত্রাস ও চরমপন্থা মোকাবেলায় বাংলাদেশের পরামর্শ চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সন্ত্রাস মোকাবেলায় বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশকে উদাহরণ হিসেবে নিতে পারে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থা মোকাবেলায় বাংলাদেশের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে হবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার সন্ত্রাস দমনে অভাবনীয় সফলতা দেখিয়েছে। পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নেও শেখ হাসিনার নেতৃত্ব প্রশংসার দাবি রাখে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকায় সফররত মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের রাজনীতিবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ওয়েন্ডি আর শ্যারমেন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে সৌজন্য সাক্ষাতে এ কথা বলেন।শ্যারমেন বলেন, বিশ্বব্যাপী এখন সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।
যুক্তরাষ্ট্র মনে করে শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্ব বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদ দমনের উদাহরণ। তাই বাংলাদেশ থেকে সবারই শিক্ষা নেয়া উচিত। শ্যারম্যান বৈঠকে এই সফলতার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান।এ সময় প্রধানমন্ত্রী শ্যারমেনকে বলেন, সন্ত্রাসীদের কোনো দেশ নেই। সব সন্ত্রাসী ও উগ্রবাদের একই চিন্তা। আমি মনে করি, এজন্য সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। এর সঙ্গে প্রয়োজন হলো অবৈধ অস্ত্রের প্রবাহ বন্ধ করা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের রাজনৈতিকবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ওয়েন্ডি শারম্যান এবং দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্র মন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল এ বিষয়ে কথা বলেন।
বৈঠকের পরে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব একেএম শামীম চৌধুরী সাংবাদিকদের বৈঠকের বিষয়ে অবহিত করেন।শামীম চৌধুরী বলেন, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশের সফলতার উচ্ছসিত প্রশংসা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের প্রশংসা করেছে দেশটি।
কোনো দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস করতে বাংলাদেশের মাটিকে ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। বাংলাদেশ এ বিষয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ সন্ত্রাসীকে সন্ত্রাসী হিসেবেই বিবেচনা করে। সন্ত্রাসীদের কোনো সীমানা ও ধর্ম নেই।’ বৈশ্বিক সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে অবৈধ অস্ত্র পাচার বন্ধের ওপর গুরুত্বারোপ করেন প্রধানমন্ত্রী।
২০১৩ সালের রানা প্লাজা ধসের পর থেকে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের উন্নয়নের প্রশংসা করেন ওয়েন্ডি শারম্যান।এ সময় প্রধানমন্ত্রী শ্রমিকদের বেতন বাড়ানোর পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি পোশাকের দাম বাড়াতে যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারিকে সুপারিশ করেন।
সম্প্রতি নেপালের ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্পের কথা উল্লেখ করে শারম্যান দুর্যোগ মোকাবেলায় বিশেষ করে ভূমিকম্প মোকাবেলায় আঞ্চলিক প্রস্তুতির ওপর জোর দেন।এ সময় প্রধানমন্ত্রী কাঠমান্ডু বিমান বন্দরের সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে যুক্তরাষ্টের এই কর্মকর্তাকে জানান, আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায় নেপালে সড়ক পথে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছাতে বাংলাদেশের বিমানবন্দর ব্যবহার করতে পারে। বিশেষ করে সৈয়দপুর বিমানবন্দর ও লালমনিরহাট এয়ারস্ট্রিপ।
মিলোনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জনে বাংলাদেশের সফলতার ভূয়সী প্রশংসা করেন শারম্যান।এ সময় পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সচিব সুরাইয়া বেগম, বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শিয়া স্ট্রেপহেন্স ব্লুম বার্নিকাট উপস্থিত ছিলেন।বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ঢাকায় শুরু হওয়া দুই দিনব্যাপী ‘বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র চতুর্থ অংশীদারি সংলাপে’র প্রথমদিনে দু’দেশের কার্যদলের বৈঠকে এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের কাছে বক্তব্য তুলে ধরেন।
অংশীদারি সংলাপ নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট গতকাল তার টুইটার অ্যাকাউন্টে জানিয়েছেন, দুই দেশের সম্পর্ক আরো কার্যকর করতেই কৌশলগত দিকগুলো ঝালাই করে নেওয়া। আমরা সম্পর্কের পরিধি বাড়িয়ে পরিবেশ, স্বাস্থ্য, সংক্রামক ব্যাধি ও ব্লু-ইকোনমির ওপরও জোর দিচ্ছি।
ঢাকার ইস্কাটনে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন মেঘনায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমেরিকা অনুবিভাগের মহাপরিচালক মাহফুজুর রহমান ও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি এসিসটেন্ট সেক্রেটারি স্টিভেন ফেল্ড স্টেইন বৈঠক করেন। সকাল দশটায় শুরু হওয়া বৈঠক মধ্যাহ্ন বিরতি দিয়ে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত চলে। মহাপরিচালক পর্যায়ের কর্মকর্তার নেতৃত্বে দিনভর এই সেশনে উভয়পক্ষে দশ জন করে কর্মকর্তা অংশ নেন। ঢাকার পক্ষে পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র, বাণিজ্যসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। গতকালের বৈঠকে আলোচনা হওয়া বিষয়গুলো নিয়ে আজ সকালে ‘প্লেনারি সেশনে’ চূড়ান্ত আলোচনা হবে।
সূত্র মতে, অন্যান্য দ্বিপাক্ষিক ইস্যুর পাশাপাশি বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার মতো বিষয়গুলো বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে অংশীদারিত্ব সংলাপে। অংশীদারী সংলাপ ও শ্যারমেনের সফর সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দপ্তরের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ওয়েন্ডি আর শ্যারমেন তার ঢাকা সফরে রাজনৈতিক বিষয় উত্থাপনের পরিকল্পনা নিয়েছেন।
এই বিষয় উল্লেখ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, সে হিসেবে শ্যারমেন সিটি নির্বাচন ও সাম্প্রতিক সহিংসতার রাজনীতি নিয়ে কথা তুলতে পারেন আজকের প্লেনারি সেশনে। অবশ্য রাজনৈতিক বিষয় সকল জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে প্রস্তুতিও নিয়েছে বাংলাদেশ। সিটি নির্বাচনে অনিয়মের কথা বলা হলে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক তদন্ত হওয়ার কথা জানানো হবে। আর সহিংসতার বিষয়ে সরকার থেকে দেওয়া আগের জবাব আবারো জানানো হবে।
ঢাকার পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার এবং জিএসপি ফিরে দেওয়ার বিষয়টি উত্থাপন করা হবে বলে গতকালের প্রস্তুতি বৈঠকে জানানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের জিএসপি ইস্যুতে সংস্কার কার্যক্রম চালু রাখার পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
প্রথমদিনের বৈঠকে অংশ নেওয়া একজন কর্মকর্তা বলেন, এদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করার কথা যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই বলে আসছে। এছাড়া এদেশের উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সুশাসন নিশ্চিত করতেও তারা সরকারকে আরো সক্রিয় হওয়ার কথা বলছে। এছাড়া আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে মানবাধিকারবিষয়ক সচেতনতা আরো বাড়ানোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
কূটনৈতিক সূত্রের খবর, কার্যদলের বৈঠকে গত অক্টোবরে হয়ে যাওয়া তৃতীয় অংশীদারী সংলাপে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান শক্তিশালীকরণ, সুশীল সমাজ, আইনের শাসন, জলবায়ু পরিবর্তন, অভিবাসন ও রোহিঙ্গা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, শ্রম অধিকার, ব্লু-অর্থনীতি (সমুদ্রসম্পদ ব্যবহারের অর্থনীতি) ও শান্তিরক্ষা কার্যক্রম নিয়ে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো কতটা বাস্তবায়ন হলো তা নিয়ে আলোচনা হয়।
এছাড়াও ঢাকা-ওয়াশিংটনের মধ্যে সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র বাণিজ্য, বিনিয়োগ, সাহায্য, নিরাপত্তা, জনগণের যোগাযোগ, উন্নয়ন ও সুশাসন নিয়ে উভয়পক্ষের প্রস্তুতিমূলক আলোচনা হয়। এসবের পাশাপাশি জ্বালানি, শ্রম অধিকার ও সন্ত্রাসবাদের বিষয়েও মূল আলোচনা হবে আজকের প্লেনারি সেশনে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে শ্যারমেন নেতৃত্বে থাকবেন। বাংলাদেশের পক্ষে থাকবেন পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হকের নেতৃত্বে ১৫ সদস্যের প্রতিনিধিদল। আনুষ্ঠানিক বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে শেষ হবে সংলাপ।
সংলাপের প্লেনারি সেশনে অংশ নিতে গতকাল বিকেলে ঢাকা আসেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের রাজনীতিবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ওয়েন্ডি আর শ্যারমেন। সঙ্গে আছেন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল। তারা দু’জন গতকাল সন্ধ্যায় সাক্ষাত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। নিশা দেশাই আজ সাক্ষাত করবেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সঙ্গে।
অন্যদিকে, দুই দিনের সফরে গতকাল বিকালে নয়াদিল্লি থেকে ঢাকা এসে পৌঁছেন ওয়েন্ডি আর শ্যারমেন ও নিশা দেশাই বিসওয়াল। বিকালে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করার পর সন্ধ্যায় গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাত করেন শ্যারমেন। আজ রাতে ঢাকা ত্যাগ করার আগে তারা সংলাপে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি সাক্ষাত করবেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদের সঙ্গে।
দুপুরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে সাক্ষাত করবেন। সকালে প্রাতরাশ বৈঠকে সুশীল সমাজের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনা হবে যুক্তরাষ্ট্রের এই দুই কর্মকর্তারা। এছাড়া বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধি ও সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে তিনি কথা বলবেন।