সচিবালয়ে হাসিনার ‘বুলেটপ্রুফ গ্লাস’ গণপূর্ত শামীমের ধান্ধা
” ফ্যাসিস্ট হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল তারেক আহমেদ সিদ্দিক। বাংলাদেশের এই বিষফোঁড়া আয়নাঘরেরও মূল পরিকল্পনাকারী। তার নেতৃত্বে বুলেটপ্রুফ গ্লাস প্রকল্পে শতকোটি টাকার ধান্ধা চূড়ান্ত করেছিল গনপূর্ত মন্ত্রণালয়ের একটি সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের সক্রিয় সহযোগী ছিল গণপূর্ত অধিদপ্তর এর প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার।ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালিয়ে গেলেও শামীমের টিকিটিও কেউ স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি এখনও বহাল তবিয়তে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। ”
প্রিয়া রহমান : চরম মৃত্যু ভয় ছিল ফ্যাসিস্ট হাসিনার। ভয় দূর এবং অজানা আতংক-ঘাতক থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সচিবালয়েও বুলেটপ্রুফ গ্লাস লাগাতে চেয়েছিল। এ প্রকল্পে জড়িত ছিল ফ্যাসিস্ট হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল তারেক আহমেদ সিদ্দিক। বাংলাদেশের এই বিষফোঁড়া আয়নাঘরেরও মূল পরিকল্পনাকারী। তার নেতৃত্বে বুলেটপ্রুফ গ্লাস প্রকল্পে শতকোটি টাকার ধান্ধা চূড়ান্ত করেছিল গনপূর্ত মন্ত্রণালয়ের একটি সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের সক্রিয় সহযোগী ছিল গণপূর্ত অধিদপ্তর এর প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার।ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালিয়ে গেলেও শামীমের টিকিটিও কেউ স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি এখনও বহাল তবিয়তে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। বিষয়টি নিয়ে তার দফতরে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি। উপরন্ত তার দফতরের কর্মকর্তারা প্রতিবেদককে বলেছেন, এসব লিখে কোনো কাজ হবেনা। অন্তবর্তী সরকারের শামীম আখতারের লোক রয়েছে।
গনপূর্তের বতর্মান প্রধান প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে গণপূর্ত অধিদপ্তরের কাজ কমিশনের মাধ্যমে পাইয়ে দেয়ার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। মোহাম্মদ শামীম আখতারের আরেকটি পরিচয়ও রয়েছে । তিনি নারায়ণগঞ্জের ভূঁইগড়ের হাকিমাবাদ খানকা-ই-মোজাদ্দেদিয়ার ‘পীর সাহেব’। পীর হিসেবে তার নাম আল্লামা হযরত মোহাম্মদ শামীম আখতার (মাদ্দাজিল্লুহুল আলিয়াহ)। কম্বোডিয়াসহ বাংলাদেশের কয়েকটি ¯’ানেও রয়েছে এ খানকার শাখা। পীরের মুরিদরা এখন গণপূর্ত অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত ঠিকাদার। বাস্তবায়ন করছেন মোটা অংকের উন্নয়নকাজ। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরসহ গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সং¯’া থেকে সুযোগ-সুবিধাও আদায় করে নি”েছন। এ সংক্রান্ত অভিযোগ আমলে নিয়ে ইতিমধ্যেই মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সরকারের সর্বো”চ পর্যায়ে জানানো হলেও কাজ হয়নি।
গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলীর পদে আসার আগে মোহাম্মদ শামীম আখতার ছিলেন হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এইচবিআরআই) মহাপরিচালকের দায়িত্বে। সেখানে কখনো কখনো প্রকল্প পাস না করে, কখনো টেন্ডার হওয়ার আগে কোটি কোটি টাকার উন্নয়নকাজ পেয়ে যান মুরিদ ঠিকাদাররা। মাসে লাখ টাকা বেতনে প্রকল্পের পরামর্শক, কর্মকর্তা-প্রকৌশলী থেকে বাবুর্চি-মালির মতো পদগুলোয়ও নিয়োগ পান তার মুরিদরা। মুরিদদের সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রে তৎকালীন মহাপরিচালকের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছে এইচবিআরআই থেকে একটি তদন্ত কমিটি। মুরিদদের ঠিকাদারিসহ নানা সুযোগ-সুবিধা প্রদানসহ আর্থিক ও প্রশাসনিক অনিয়মের সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগ নিয়ে সম্প্রতি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে জমা পড়লেও শামীমের কেউ কিছু নড়াতে পারেনি। এইচবিআরআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদন ধামাচাপা দেয়া হয়েছে।
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এইচবিআরআইতে যেসব মুরিদ নিয়মবহির্ভূতভাবে সুবিধা পেয়েছেন, তারা এখন গণপূর্ত অধিদপ্তরে সক্রিয়। মোহাম্মদ শামীম আখতার গণপূর্তের শীর্ষ পদে যোগ দেন ২০২০ সালের ডিসেম্বরে। এরপর গণপূর্ত প্রশিক্ষণ একাডেমি, একটি পূর্ত ভবনের উন্নয়ন, প্রধান প্রকৌশলীর বাসভবন সংস্কারসহ একাধিক প্রকল্পের কাজ পেতে শুরু করেন মুরিদরা। এরই মধ্যে তারা জায়গা করে নিয়েছেন গণপূর্ত অধিদপ্তর ঠিকাদার সমিতিতে।
ফ্যাসিস্ট হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অন্যতম সহযোগীও এই শামীম।
অভিযোগ রয়েছে, সরকারি বিভিন্ন সংস্থায় কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিতে তারিক ও তাঁর স্ত্রী শাহনাজ সিদ্দিকীকে সহায়তা করেছেন এই শামীম। এই তারিক সিদ্দিকের মাধ্যমেই সচিবালয়ে বুলেটপ্রুফ গ্লাস লাগানোর প্রস্তাব দেয়া হয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুই ফ্লোরে বুলেটপ্রুফ গ্লাস লাগানোর প্রস্তাবটি অনুমোদন দিয়েছিল শেখ হাসিনার বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ)। ‘বাংলাদেশ সচিবালয়ের ২০তলা বিশিষ্ট নতুন অফিস ভবন নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পে বুলেটপ্রুফ গ্লাস বসানোর বিষয়টি বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারতে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে নেওয়া উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে গেলে প্রকল্পটির কাজ শেষ হতে দেরি হবে। বর্তমান বাস্তবতায় বুলেটপ্রুফ গ্লাস বসানোর বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনার জন্য প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয়েছে।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রীকে অফিস করতে হতো বিধায় ভবনের তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় বুলেটপ্রুফ গ্লাস লাগাতে বলা হয়েছিল। সেই বিবেচনায় বুলেটপ্রুফ গ্লাস লাগাতে প্রস্তাব করেছিল মন্ত্রণালয়। প্রস্তাবটি বাস্তবায়ন করতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) কাছ থেকে চূড়ান্ত অনুমোদন নিতে হয়। তারা সেটি অনুমোদনও করে।
প্রকল্প পরিচালক এ কে এম কামরুজ্জামান বলেন, নির্মাণাধীন ভবনের তৃতীয় তলায় বুলেটপ্রুফ গ্লাসের স্পেসিফিকেশন এসএসএফ চূড়ান্ত করে। বুলেটপ্রুফ গ্লাস ডব্লিউ-৪ প্যাকেজে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বান করতে বলা হয়। যা লেটার ক্রেডিট (এলসি)-এর মাধ্যমে বিদেশ থেকে আনার কথা। কিন্তু এলসি করে বুলেটপ্রুফ গ্লাস আনতে হলে প্রকল্পটির সময় বাড়তে হবে— বলেন প্রকল্প পরিচালক।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,, ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পায় ‘বাংলাদেশ সচিবালয়ের ২০তলা বিশিষ্ট নতুন অফিস ভবন নির্মাণ’ প্রকল্পটি। এটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয় ৪২০ কোটি ৯৮ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। একনেকে প্রকল্পটি অনুমোদনের পর ২০১৯ সালে সচিবালয়ের ভেতর ২০তলা ভবনের নির্মাণকাজ শুরু করে মন্ত্রণালয়। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে, নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পটি শেষ না হওয়ায় এর মেয়াদ ও অর্থ বাড়ানোর প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান প্রথম সংশোধনীতে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ এবং ৪০ কোটি ৩৩ লাখ ১৬ হাজার টাকা বাড়িয়ে এটির অনুমোদন দেন। ফলে প্রকল্পের মোট ব্যয় দাঁড়ায় ৪৬১ কোটি ৩১ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
সম্প্রতি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের স্টিয়ারিং কমিটির সভায় বিষয়টি উঠে আসে। সভায় সভাপতিত্ব করেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নবীরুল ইসলাম। সভায় নির্ধারিত মেয়াদে প্রকল্পের কাজ শেষ করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
প্রকল্প সূত্র জানায়, বৈশ্বিক সংকটময় পরিস্থিতিতে সাইটে পৌঁছাতে বিলম্ব হওয়ায় ফলস সিলিং ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ বিলম্বিত হচ্ছে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অতিরিক্ত ও অবশিষ্ট কাজের ব্যয় আরডিপিপি বরাদ্দ থেকে বেশি হওয়ায় অতিরিক্ত অর্থ পণ্য ‘জি-১’ ও পণ্য ‘জি-১১’ এর বেঁচে যাওয়া অর্থ থেকে মেটানো হবে। প্রকল্পটির মালামাল ক্রয়ে দরপত্র আহ্বান করা হবে। যা পরবর্তীতে আন্তঃখাত সমন্বয়ের মাধ্যমে সমাধান করা হবে। তৃতীয় ও চতুর্থ তলার টাইলস, মার্বেলের সিদ্ধান্ত এখনও পাওয়া যায়নি। সার্বিক বিবেচনায় প্রকল্পের মেয়াদ জুন ২০২৫ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
চলতি বছরের জুন পর্যন্ত প্রকল্পটির অনুকূলে ব্যয় হয়েছে ৩২৯ কোটি ৭২ লাখ টাকা। যা মোট ব্যয়ের ৭২ শতাংশ এবং ভৌত অগ্রগতি ৮২ শতাংশ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এডিপিতে প্রকল্পটির অনুকূলে ১২৯ কোটি ৩৭ লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এ অর্থবছরে কোনো অর্থ অবমুক্ত করা হয়নি। সভায় চলতি অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ করা অর্থ সুষ্ঠুভাবে এবং গুণগতমান বজায় রেখে শতভাগ ব্যয়ের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে যেহেতু বুলেটপ্রুফ গ্লাসের কারণে প্রকল্পটি নির্ধারিত সময়ে সমাপ্ত করা সম্ভব হবে না, সেহেতু বর্তমান প্রেক্ষাপটে বুলেটপ্রুফ গ্লাস বসানোর পরিকল্পনা পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানানো হয়েচে এক বৈঠকে।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, আগে সেন্ট্রাল এসির কুলিং টাওয়ার ইউটিলিটি ভবনের চতুর্থ তলার ছাদে স্থাপনের কথা ছিল কিন্তু বর্তমানে ষষ্ঠ তলার ছাদে বসাতে হবে বিধায় ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। সভায় ভবনের তৃতীয় তলায় বুলেটপ্রুফ গ্লাস স্থাপনের বিষয়টি পরিবর্তিত পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।