• শনিবার , ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

‘সংবিধান সংশোধন অন্তর্বর্তী সরকারের এখতিয়ার নাই’


প্রকাশিত: ১:৫৫ এএম, ১৭ নভেম্বর ২৪ , রোববার

নিউজটি পড়া হয়েছে ২৪ বার

 

 

বিশেষ প্রতিনিধি : অন্তর্বর্তী সরকারের সংবিধানে হাত দেওয়ার এখতিয়ার আছে কি না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পাওয়া মো. আসাদুজ্জামান।সংসদ ভেঙে যাওয়ার পর রাষ্ট্রপতির আদেশ প্রণয়ন ক্ষমতার ‘সীমাবদ্ধতার’ কথা তুলে ধরে রোববার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সেমিনারে তিনি এই প্রশ্ন তোলেন। আইন ও আদালত নিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করা সংগঠন ‘ল রিপোর্টার্স ফোরামের’ এই আয়োজনের বিষয় ছিল ‘খসড়া সংবিধানের প্রস্তাবনা’ ।

আসাদুজ্জামান বলেন, “বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশে যাদের রক্তের বিনিময়ে আমরা সংবিধান সংশোধনের কথা ভাবছি সেটা তাদের (শহীদদের) প্রতি এক ধরনের শ্রদ্ধা জানানো। আমাদের সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার কথা চিন্তা করতে হবে। সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদের দিকে যদি তাকাই, তাহলে এই প্রস্তাবনাগুলো…এই সরকারের জায়গা থেকে সংবিধান সংশোধনের কোনো সুযোগ আছে কি না সেটা ভেবে দেখা দরকার।”

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার যেসব বিষয়ে সংস্কারের কথা বলছে, তার মধ্যে সংবিধানও আছে।সংবিধান সংস্কার বিষয়ে প্রস্তাব করতে আলী রিয়াজকে প্রধান করে একটি কমিশন কাজ করছে, যিনি এই দায়িত্ব পাওয়ার আগে সংবিধান বাতিল করে নতুন করে লেখার প্রস্তাব করেছিলেন। এই কমিশনের সদস্য অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলমও নতুন সংবিধান লেখার পক্ষে অবস্থানের কথা বলেছেন।তবে সংবিধান পরিবর্তনের এখতিয়ার কেবল নির্বাচিত সংসদের হাতে আছে, বিএনপি এই বিষয়টি বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।

সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদের কথা তুলে ধরে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “এই অনুচ্ছেদে আপনি সবকিছু করতে পারবেন শুধু সংবিধান সংশোধন ছাড়া। এখন সংসদ নেই, গণভোট নেই- এসব প্রশ্নগুলো এখানে যৌক্তিক ও আইনগতভাবে আসবে।”এই অনুচ্ছেদে সংসদ ভেঙে গেলে বা সংসদ অধিবেশনে না থাকলে রাষ্ট্রপতি কী কী বিষয়ে অধ্যাদেশ জারি করতে পারবেন, সেই বিষয়ে সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে।

এই বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপ্রধান এমন কোনো অধ্যাদেশ জারি করবেন না যা

ক. এই সংবিধানের অধীন সংসদের আইন-দ্বারা আইনসঙ্গতভাবে করা যায় না;
খ. যাতে এই সংবিধানের কোনো বিধান পরিবর্তিত বা রহিত হয়ে যায়;
অথবা
গ. যার দ্বারা পূর্বে প্রণীত কোনো অধ্যাদেশের যে কোনো বিধানকে অব্যাহতভাবে বলবৎ করা যায়।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান সমুন্নত রাখার অঙ্গীকার নিয়েই শপথ নিয়েছে। আর সংবিধান রদ বা রহিতের কী সাজা, তাও শাসনতন্ত্রে রয়েছে। বিএনপির নেতাদের পক্ষ থেকে এ বিষয়েও সতর্কতা দেওয়া হচ্ছে।সরকার পতন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি তুললেও সংবিধানে সেই সুযোগ না থাকার কথা তুলে ধরে বিএনপি বিরোধিতা করলে এই আলোচনা পরে থেমে যায়।

সংবিধানকে সার্বভৌম করার পরামর্শ দিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “সংস্কারের মাধ্যমে সংবিধানে একটি জায়গা নিশ্চিত করুন, ৫ বছর পর-পর জনগণ তার স্বাধীন সার্বভৌম ক্ষমতা যাতে প্রয়োগ করতে পারে।“সেই বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য যা যা করা দরকার তা করলেই আমার মনে হয় এই সংবিধান সার্বভৌম হবে। সেই সংবিধানে বাংলাদেশের মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে।”

ভোটের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরামর্শ

জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত হলে সংবিধানে আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, ন্যায় বিচার, মৌলিক মানবাধিকার, মৌলিক অধিকারসহ আরও যা যা প্রত্যাশার জায়গা আছে সব নিশ্চিত হবে উল্লেখ করে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “সেখানে যদি গরমিল থাকে, তাহলে যতভাবেই প্রতিষ্ঠানকে ঢেলে সাজান না কেন, কোনো প্রতিষ্ঠানই কাজ করবে না। যেমন কাজ করেনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।

“এমনকি সুপ্রিম কোর্টও রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার হয়েছে আমরা দেখেছি। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য একমাত্র পথ দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। ভোটের মাধ্যমে জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।”

আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন অবশ্য অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যের বিপরীত মত দেন। তিনি বলেন, “যে সংবিধান ‘ফ্যাসিস্টদের’ জন্ম দিয়েছে, বিপ্লবের পর সেই সংবিধান গুরুত্ব হারিয়েছে।”‘বিপ্লব’ সংবিধানের আওতায় হয়নি বলে মত দিয়ে তিনি বলেন, “এই ‘বিপ্লব’ ব্যর্থ হলে ‘বিপ্লবীদের’ ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হত। যারা জীবন দিল, তাদের যে চিন্তা ভাবনা, তাদের যে চাওয়া–পাওয়া এগুলোকে ধারণ করে সংলাপের ভিত্তিতে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা করা এবং একটি নির্বাচন করাই হোক লক্ষ্য।”

আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, “সংবিধানের কিছু জায়গায় নতুন চিন্তা ভাবনা হতেই পারে। তাই মৌলিক মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিতে কী কী ধরনের প্রতিকার আমরা পেতে পারি, ভবিষ্যতে কী করতে পারি, সেটা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।”

রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী হাসনাত কাইয়ুম বলেন, “৫৩ বছরে আমরা একটা ভালো নির্বাচনি ব্যবস্থা তৈরি করতে পারিনি। গত ১৫ বছরে ‘আইন করে লুটপাটের’ ব্যবস্থা করা হয়েছে। মৌলিক অধিকার চর্চার মতো পরিস্থিতি তৈরি না করলে কোনো চেষ্টাই ফলপ্রসূ হবে না।”

গণমাধ্যম কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ বলেন, “সংবিধান বার বার ‘ব্যর্থ হয়েছে’। নাগরিকের ক্ষমতা নেই। সংসদ সদস্যরা যতক্ষণ পর্যন্ত জবাবদিহিতার আওতায় না আসবেন ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদেরকে ‘প্রজা’ হয়েই থাকতে হবে।” নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “সংবিধান শুধু আইনজ্ঞদের বিষয় নয়, এটি জনগণের বিষয়। এখানে নাগরিকদের মতামতও থাকতে হবে।”

পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান ও নির্বাচন ব্যবস্থাকে ‘ধ্বংস’ করার অভিযোগ এনে তিনি বলেন, “ওই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানকে ‘কলুষিত’ করা হয়।”
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে ‘খসড়া সংবিধানের’ প্রস্তাব তুলে ধরেন ল রিপোর্টার্স ফোরামের সাবেক সভাপতি ও দৈনিক ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক সালেহ উদ্দিন।

তিনি দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইন সভা, ‘রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী কেউ দুই বারের বেশি নির্বাচিত হতে পারবেন না’, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং বিচারক নিয়োগে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কমিশন গঠনের প্রস্তাব তুলে ধরেন।ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মিশন, আইনজীবী রাজা দেবাশীষ রায়, আহসানুল করিম, মোস্তাফিজুর রহমান খান, মোহাম্মদ শিশির মনির, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ মাসদার হোসেনও এ সময় বক্তব্য রাখেন।